পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দেশের কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক মহলের মধ্যে কিছুটা আত্মতুষ্টি লক্ষ করা যায়। যদিও ধানের ফলন ও উৎপাদন বৃদ্ধিসহ কৃষিখাতের ক্রমবর্ধমান সাফল্যের পেছনে দেশের কৃষি উদ্যোক্তা, কৃষি গবেষক, সাধারণ কৃষক ও খামারিদের অবদানই মূল ভূমিকা রাখছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের কৃষিবান্ধব নীতিমালা কৃষকদের আগ্রহী ও অনুপ্রাণিত করলেও কৃষি ব্যবস্থার টেকসই উন্নয়ন, কৃষকের জীবন মান উন্নয়নে সরকারের নীতি কৌশল কোনো কাজে আসছে না। এ কারণে ধান, পাট, আলু থেকে লবণ চাষিরা পর্যন্ত প্রায় প্রতি মওসুমে ফসলের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে লোকসান দিতে বাধ্য হন। প্রতিবাদে তারা রাজপথে ফসল ছড়িয়ে, মানববন্ধন করে অথবা আগুন লাগিয়ে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করেন। স্বাধীনতার পর থেকে দেশে জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুনের বেশি, কিন্তু খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে তিনগুণের বেশি। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার মূল কারিগর কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটেনি। একেকবার বাম্পার ফলনের মধ্য দিয়ে সারাদেশে প্রায় চারকোটি টন ধান উৎপন্ন হওয়ার পরও ভরা মওসুমে একশ্রেণির ব্যবসায়ীকে ভারত থেকে লাখ লাখ টন চাল আমদানির সুযোগ দিয়ে দেশীয় ধান-চালের মূল্যে ধস নামিয়ে কৃষকদের মেরদ-ের উপর শক্ত আঘাত হানা হয়। পর্যাপ্ত মূলধন না থাকা এবং ধান সংরক্ষণের নিজস্ব ব্যবস্থা না থাকায় দরিদ্র কৃষকরা উৎপাদন খরচের চেয়ে কমদামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হন। এরপর শুরু হয় মিলারদের মূল্যবৃদ্ধির সিন্ডিকেটেড কারসাজি। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। বাজার ব্যবস্থাপনায় কৃষকদের স্বার্থ যেমন রক্ষিত হচ্ছে না, একইভাবে সাধারণ ভোক্তাদের স্বার্থও রক্ষিত হচ্ছে না। যখন তখন যে কোনো পণ্যের উপর টার্গেট করে আমদানি ও মজুদ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশীয় উৎপাদনকারীদের বিনিয়োগকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা এবং কোটি কোটি ভোক্তার পকেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সিন্ডিকেটেড চক্র। জনগণের নিরব প্রতিবাদ, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে মাঝে মধ্যে পণ্যমূল্য সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের হুমকি দিতে দেখা গেলেও এসব এখন ফাঁকা বুলি হিসেবেই প্রতীয়মান হচ্ছে। বছরের শুরুতে তিরিশ টাকার পেঁয়াজের মূল্য বাড়তে বাড়তে ৩০০ টাকায় উঠার পরও মূল্য সন্ত্রাসী চক্রের হোতাদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। মিয়ানমার থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ আমদানি করে তা পাইকারি বাজারে দেড়শ টাকায় বিক্রির হোতাদের ধরা সরকারের সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোর জন্য কোনো কঠিন কাজ নয়। মজুদ ধরে রেখে কৃত্রিমভাবে সংকট সৃষ্টি করে মূল্য বৃদ্ধি করতে গিয়ে টনে টনে পেঁয়াজ গুদামে পঁচে যাওয়ার পর তা নদীতে ফেলার খবরও গত কয়েকদিনে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের মূল্য সন্ত্রাসী মজুদদারদের কারো কারো নামও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তির দাবি গণদাবিতে পরিণত হলেও কোনো অদৃশ্য-অজ্ঞাত কারণে তাদের কিছুই হয় না। অথচ, কোটি কোটি দরিদ্র ভোক্তার জিম্মিদশা থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব সরকারের।
বিশ্বের কৃষিব্যবস্থা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদী ও কর্পোরেট এগ্রো কোম্পানির এজেন্ডা অনেক পুরনো। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্যকে সামনে রেখে গ্রিন রেভ্যুলেশন থেকে শুরু করে জিএমও গবেষণা ও জিএমও কৃষিবীজের বাণিজ্যিকীকরণ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই কর্পোরেট বায়ো-কেমিক্যাল বিজনেস ও জাতিসমূহের উপর পূর্ণ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার গোপন এজেন্ডা সক্রিয় ছিল। মূলত সরকারের নীতি নির্ধারকদের সাথে গোপন সমঝোতার ভিত্তিতে খাদ্য ও কৃষি ব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ ও হাজার হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্যিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় কারসাজি চালানো হচ্ছে। তবে ভারতে জিএমও বিটি তুলা, বাংলাদেশে বিটি বেগুণের মতো জিএমও বীজ বাণিজ্যিকভাবে সফল না হলেও তারা হাল ছেড়ে দেয়নি। উচ্চ ফলনের নামে বীজের জন্য কর্পোরেট এগ্রো কোম্পানির উপর আমাদের কৃষকদের নির্ভরতা এক সময় অভাবনীয়-অকল্পনীয় বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কৃষি, খাদ্য ও বায়ো নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্টরা অনেক আগে থেকেই এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে এসেছেন। নাগরিক সমাজের তুমুল প্রতিবাদের মুখে বিদেশি কর্পোরেশনের কলাবরেশনে ভারতে উদ্ভাবিত বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক চাষাবাদ ভারতে অবমুক্ত করা সম্ভব না হলেও মহাজোট সরকার আমলে বাংলাদেশে তার বাণিজ্যিক চাষাবাদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল। হাজার বছরে গড়ে ওঠা আমাদের কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনাকে এভাবেই ক্রমশ নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জিএমও কৃষিবীজের সাথে ফসলের বিশেষ রোগ-বালাই, হার্বিসাইড, পেস্টিসাইড রেসিসটেন্স ও বিশেষ এনজাইম ও প্রতিশেধক ব্যবস্থার প্যাকেজ বাণিজ্যের বিশাল বহুমাত্রিক মুনাফাবাজির দুয়ার খুলে দেওয়া হচ্ছে। সে সব কর্পোরেট সা¤্রাজ্যবাদী এজেন্ডাগুলো প্রকট হওয়ার আগেই আমাদের কৃষি ব্যবস্থা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে একটা মুনাফাবাজ সিন্ডিকেট রক্তচোষা শোষণ যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। কখনো চাল, কখনো পেঁয়াজ, আদা-রসুন, তেল, দুধ-চিনি, লবণ থেকে শুরু করে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ পর্যন্ত তাদের রক্তচোষা মুনাফাবাজির কারসাজি থেকে বাদ যায় না। নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য পণ্যের উৎপাদন, আমদানি, মজুদ ও বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূল অনুষঙ্গ হলেও আমাদের সরকার এখন বাজার তথা চাহিদা ও যোগানের সীমারেখা নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিপালনে পুরোপুরি ব্যর্থ হচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদী কলা-কৌশলের প্রসঙ্গ বাদ দিলেও প্রতি মওসুমে ধান-চাল, আলু, পেঁয়াজের মতো নিত্যপণ্যের উৎপাদন খরচ, কৃষকের বিক্রয়মূল্য আমদানি ও বিক্রয়মূল্য নিয়ে ন্যূনতম নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা করে সারাবছর ভোক্তা সাধারণকে জিম্মিদশায় রেখেই সরকার জননিরাপত্তা ও উন্নয়নের গতানুগতিক সাফল্যের ঢোল বাজিয়ে চলেছে। দরিদ্র মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তার মত ইস্যুগুলোর পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য, ইকোসিস্টেম, বায়ু, পানি, মাটি ও পরিবেশ দূষণের মতো বিপত্তিগুলো পাশ কাটিয়ে টেকসই উন্নয়নের ধারণা এখন অকেজো।
পেঁয়াজের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি এখন সর্বত্র আলোচিত বিষয়। গত সেপ্টেম্বরে হঠাৎ করে প্রথমে ভারতের পেঁয়াজ রফতানির মূল্যবৃদ্ধি, অতঃপর বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রকাশের পর থেকেই লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে পেঁয়াজের দাম। পয়ত্রিশ-চল্লিশ টাকা থেকে এক লাফে ষাট টাকায় উঠে যাওয়ার পর থেকেই আলোচনা শুরু হয়। এরপর প্রতিদিনই গড়ে ৫-১০ টাকা করে দাম বেড়ে চলেছে। কখনো দু’তিনদিন স্থিতিশীল থাকার পর সপ্তাহান্তে একলাফে কেজিপ্রতি ২০-২৫ টাকা বেড়ে বর্তমানে বাংলাদেশে তা বিশ্বের সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে। গত ক’দিনে ভালো মানের পেঁয়াজ দেশের কোথাও কোথাও কেজি ৩০০ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়, যা বিশ্বের যে কোনো পেঁয়াজ আমদানিকারক দেশের সর্বোচ্চ মূল্যের দ্বিগুণ। বাংলাদেশে যখন রেকর্ড মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে, তখন বিশ্বের কোথায় কত দামে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে তার খতিয়ান ভুক্তভোগীরা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরছেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে, জামার্নির বার্লিনে পেঁয়াজের দাম ৯ টাকা থেকে ১৫ টাকা, ভারতে ৩৫ টাকা, পাকিস্তানে ২৫ টাকা, মিশরে ১৮ টাকা, সিঙ্গাপুরে ১২০ টাকার কাছাকাছি। ভারতের রফতানি বন্ধের খবরে মূল্যবৃদ্ধির পাগলা হাওয়ায় পড়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে পেঁয়াজের মূল্য ভারতের মূল্যের চেয়ে সামান্য বেশি ছিল। পেঁয়াজ উৎপাদনে ভারত বিশ্বে শীর্ষ স্থানীয় দেশ হলেও বাংলাদেশও খুব পিছিয়ে নেই। জনসংখ্যা অনুপাতে চীনে (প্রায় আড়াই কোটি টন) এবং ভারতে (প্রায় ২ কোটি টন) যে পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদিত হচ্ছে বাংলাদেশের আনুপাতিক অবস্থান প্রায় সমান। গত মওসুমে বাংলাদেশে প্রায় ২৩ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছিল, যা দেশের বার্ষিক চাহিদার (২৪ লাখ টন) কাছাকাছি। দেশে বাম্পার ধান ও আলু উৎপাদনের পরও সীমান্তপথে ভারত থেকে চাল ও আলু আসার কারণে যেমন দেশের কৃষকরা মার খায়, একইভাবে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন যাই হোক, ভারত থেকে পেঁয়াজ আসা কখনো বন্ধ হয় না। পেঁয়াজের মূল্য না পাওয়ার কারণে ভারতীয় কৃষকদের বিক্ষোভ-হতাশার খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে মূল্য বাড়িয়ে দিয়ে ভারতীয় কৃষকদের ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেয়ার কারসাজি নতুন নয়। আর বিশেষ সময়ে হঠাৎ রফতানি মূল্য বাড়িয়ে অথবা রফতানি বন্ধ রেখে নিজেদের ব্যবসায়ী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অস্বাভাবিক মূল্য বাড়িয়ে ফায়দা হাসিলের তৎপরতার অভিযোগও অনেক পুরনো। উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে সামান্য ঘাটতি এবং পর্যাপ্ত মজুদ নিশ্চিত রাখতে ভারত ছাড়াও চীন মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে থাকে ব্যবসায়ীরা। ভারতের রফতানি বন্ধের পর মিয়ানমার থেকে আমদানি করা পেঁয়াজের মূল্য ছিল ৪০ টাকা। যা পাইকারি বাজারে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা এবং খুচরা ৬০ টাকার বেশি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। খাতুনগঞ্জের আমদানিকারকরা ৪০ টাকায় আমদানি করা পেঁয়াজ পাইকারি একশ’ টাকা বিক্রি করার পর মজুদদার ও খুচরা বিক্রেতারা তা ২০০-২৫০ টাকায় বিক্রির মধ্য দিয়ে ˜িগুণের বেশি মুনাফা করে নিয়েছে। এহেন মূল্য সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জনগণের কঠোর প্রতিক্রিয়া এবং বাজার মনিটরিং ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ও তাগিদ স্পষ্ট। ভারতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে হঠাৎ করে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধে আক্ষেপ করে পেঁয়াজ ছাড়া রান্না করার কথা বলেছিলেন। আন্তর্জাতিক বাজারে পেঁয়াজের ঘাটতি নেই। সীমান্তবর্তী দেশ মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার টন এলসি খোলার পরও দুই মাস ধরে অব্যাহত গতিতে পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে কোনো সঙ্গত কারণ ছিল না। মজুদদার ও মূল্য সন্ত্রাসীদের এই লুণ্ঠন প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের শৈথিল্য জনগণ মেনে নিতে পারছে না।
উৎপাদনে ও বাজারে কোনো ঘাটতি না থাকলেও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মূল্য বাড়ানোর তৎপরতা সারা বছরই চলে। কখনো চাল, কখনো চিনি, কখনো পেঁয়াজ, কখনো আদা-রসুনের উপর শ্যেনদৃষ্টি পড়ে মূল্য সস্ত্রাসী চক্রের। এর পেছনে দেশি-বিদেশি রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রচ্ছন্ন ভূমিকা থাকে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পণ্যের অস্বাভাবিক দাম বাড়িয়ে বাজারকে অস্থিতিশীল করে তোলার অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। প্রায় একযুগ আগে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে ভারত হঠাৎ করে বাংলাদেশে চাল রফতানি বন্ধের ঘোষণা দিলে দেশে খাদ্য সংকট না থাকা সত্ত্বেও চালের মূল্য বাড়িয়ে দেশে একটা নিরব দুর্ভীক্ষ সৃষ্টি করা হয়েছিল। দেশের সব মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। চালের মূল্য হঠাৎ অস্বাভাবিক বাড়লে দশের কয়েক লাখ পরিবার অর্থনৈতিক সামর্থ্যরে দিক থেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায়। কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের কষ্টার্জিত আয়ের একটা বড় অংশ চলে যায় মজুদদার ও মূল্য সন্ত্রাসীদের পকেটে। প্রথমে তারা কারসাজি করে ধান-চালের মূল্য কমিয়ে কৃষকদেরকে উৎপাদন খরচের চেয়ে কমদামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য করে, অতঃপর আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের অজুহাত খাড়া করে সিন্ডেকেট করে চালের মূল্য বাড়িয়ে মুনাফাবাজি করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। ভারত থেকে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ হওয়া ছিল একটি অজুহাত মাত্র। সারা বছর প্রয়োজনীয় পেঁয়াজের ৯০ শতাংশের বেশি দেশে উৎপাদিত হয়। আর মাত্র এক মাস পরেই দেশি পেঁয়াজ বাজারে উঠতে শুরু করবে। এখনো বাজারে দেশি পেঁয়াজই বেশি বিক্রি হচ্ছে। এ থেকেই বুঝা যায়, দেশে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। জনগণের খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে উৎপাদন লক্ষমাত্রা, মজুদ, আমদানি ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও বাজার মনিটরিংয়ে সরকারের ব্যর্থতার সুযোগে ভোক্তাদের রক্ত শুষে নিচ্ছে মুনাফাবাজ সিন্ডিকেট। একেক সময় একেকটা পণ্যকে টার্গেট করে সিন্ডিকেটেড মুনাফাবাজি করতে দেখা যায়। পেঁয়াজ নিয়ে তুলকালাম মুনাফাবাজি করে জনগণের পকেট থেকে বাড়তি শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পর এবার চাল নিয়ে চালবাজি শুরু করেছে তারা। এক সপ্তাহে কেজি প্রতি চালের মূল্য বাড়ানো হয়েছে ৬ থেকে ৮ টাকা। অথচ দেশে চালের কোনো সঙ্কট নেই। গত বছর লক্ষ্যমাত্রার বেশি উৎপাদন হয়েছে। চলতি মওসুমের নতুন ধানও উঠতে শুরু করেছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারেও চালের চাহিদা নেই। গত মাসের শেষ দিকে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, আমদানিকারকদের চাহিদা কম থাকায় ভারত, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের চাল রফতানি কমে গেছে। তবে বাংলাদেশে পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে প্রায়শ উল্টো¯্রােত বইতে দেখা যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন জ্বালানি তেলের মূল্য কমতে কমতে অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছিল তখনো বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানি, গ্যাস- বিদ্যুৎ ও পরিবহন ব্যয় বাড়লে তার প্রভাব পণ্যমূল্যের উপর পড়ে। তবে চল্লিশ টাকার পেঁয়াজকে ২০০ টাকায় বিক্রি করার কারসাজি শুধুমাত্র বাংলাদেশেই সম্ভব। এবার চালের মূল্য বাড়ছে, চিনি ও ভোজ্য তেলের সিন্ডিকেট সক্রিয় হওয়ার আগে এখনই ব্যবস্থা না নিলে এই নিবন্ধ লেখার সময় শোনা গেল, বাজারে গুজব তুলে দেশের বিভিন্ন স্থানে লবণের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে একটি স্বার্থান্বেষী চক্র। গুজবে কান দিয়ে সাধারণ ভোক্তারা বেশি বেশি লবণ কিনতে দোকানে যাচ্ছেন। বেশি চাহিদা দেখে দোকানদারও মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছেন। লবণের মিল মালিকরা বাড়তি চাহিদার এই সুযোগকে কাজে লাগাতে এবং ভোক্তাদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়িয়ে তুলতে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়ে বাজারকে অস্থিতিশীল করে বাড়তি শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার তৎপরতা কখনো থামছে না। সরকারের প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশেই জনগণের পকেট থেকে এভাবে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ধারাবাহিক অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে আমদানিকারক, মিলার ও মজুদদার সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি নিত্যপণ্যের উৎপাদন, মজুদ ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের প্রধান দায়িত্ব।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।