শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
সঙ্কট আর সভ্যতা পাশাপাশি হাঁটছে। চলছে এগিয়ে চলা, পিছিয়ে পড়া। এই এগিয়ে চলা পিছিয়ে পড়ার অন্যতম সাক্ষী চিঠি বা পত্র। কখোন কেনো সভ্যতার সব চেয়ে বিচক্ষণ জীব মানুষ চিঠি লিখতে শুরু করেন তা আজ গবেষণার একটি দারুণ বিষয় হতে পারে। আমরা কি চিঠিকে এভাবে সাংজ্ঞায়িত করতে পারি:“চিঠি বা পত্র হলো এক জনের পক্ষ থেকে অন্য জনের জন্য লিখিত তথ্যধারক বার্তা।” কিম্বা “যে কোন ধারণা বা চিন্তা,যা কোন ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে ,এবং কোন যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রেরণের উপযোগী রূপে প্রকাশিত হয়েছে।” বা “তথ্যের যে কোন সমাহার যার শুরু ও শেষটুকু সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত।” চিঠি ভাব বিনিময়ের ও যোগাযোগের একক। চিঠি দুজন বা দুপক্ষের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রাখে; বন্ধু ও আত্মীয়দের আরো ঘনিষ্ট করে, পেশাদারি সম্পর্কের নিবিড় উন্নয়নে ভূমিকা রাখে এবং আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দেয়। স্বাক্ষরতা টিকিয়ে রাখতেও এক সময় চিঠির অবদান ছিলো।
চিঠি লেখার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায় প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ চিঠির আদান প্রদান করেছে, “ইলিয়াডে” তার উল্লেখ ছিলো। “হিরোডোটাস” এবং “থুসিডাইডিসের” রচনাবলীতেও তা উল্লেখ করা হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে, চিঠির প্রচলন ছিলো প্রাচীন ভারত, প্রাচীন মিশর, সুমের, প্রাচীন রোম এবং চীনে। চিঠির আদান প্রদান চলছে এখোনও। সতের ও আঠারো শতকে চিঠি লেখা হতো স্ব-শিক্ষার জন্য। চিঠি ছিলো পাঠ চর্চা ,অভিজ্ঞতা বর্বণা করা, বিতর্কমূলক লেখা বা সমমনা অন্যদের সাথে আইডিয়া বিনিময়ের পদ্ধতি। কিছু লোক চিঠিকে মনে করতো কেবলই লেখালেখি আবার অন্যরা মনে করতো যোগাযোগের মাধ্যম। পরবর্তীকালে কূটনৈতিক বা বাণিজ্যিক সব রকম চিঠিই ঐতিহাসিকগণ প্রাথমিক উৎস হিসাবে ব্যবহার করেন। কখোনও বা চিঠি এতো শৈল্পিক রূপ পেয়েছে যে, এটি হয়ে উঠেছে সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এমন কি সাহিত্যের সব চেয়ে জনপ্রিয় শাখা কথাসাহিত্য বা উপন্যাস লেখা হয়েছে চিঠির মাধ্যমে। আমরা যেটাকে “পত্র উপন্যাস” হিসাবে পাঠ করে সাহিত্যের রস আস্বাদন করি।
যেভাবেই চিঠিকে বর্ণনা করা হোকনা কেনো ,প্রয়োজনের তাগিদেই মানুষ এই মাধ্যটি ব্যবহারে বাধ্য হয়েছে। তবে জীবনে কাজের যেমন বৈচিত্র্য থাবে তেমনি চিঠিরও বৈচিত্র্য থাকতে হয়। চিঠি লেখার উপলক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে আঙ্গিক ও কাঠামো শৈলী গড়ে উঠেছে। চিঠির ধরণ অনুসারে রয়েছে আলাদা আলাদা রচনাশৈলী ও প্রকাশভঙ্গি। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে পত্র রচনার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব ব্যাপকভাবে অনুভূত হচ্ছে। চিঠির ধরণ, পদ্ধতি বা নিয়মকানুনের বিভিন্নতা অনুসারে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা ক. ব্যক্তিগত পত্র। যেমন: আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা পারিবারিক কোন সদস্যের কাছে লেখা চিঠি। খ. সামাজিক চিঠি। যেমন: আমন্ত্রণ বা নিমন্ত্রণ পত্র, মান পত্র, স্মারক পত্র। গ. ব্যবহারিক বা বৈষয়িক চিঠি। যেমন: আবেদন পত্র, ব্যবসায় পত্র চাকরীর দরখাস্ত।
পৃখিবীর সবচেয়ে সুন্দর সুন্দর চিঠিগুলো কবিতায় কিম্বা কাব্যিকভাবে লেখা হয়েছে। এগুলো পাঠের সৌভাগ্য পৃথিবীর খুব কম লোকেরই হয়েছে। কারণ এগুলো প্রেমিক-প্রেমিকার চোখ ছুঁয়ে চলে গেছে বাড়িতে রক্ষিত পুরাতন বাংলা ব্যাকরণ বইয়ের মধ্যে। তারপর একদিন বাড়ির কর্তী, ফেরিওয়ালার ডাকে সাড়া দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর রান্নার লবণ আর পাথর কুচি মেশানো জিরা’র বিনিময়ে বইগুলো তুলে দিয়েছেন তাদের হাতে। সেখান থেকে ঠোঙ্গা কর্মীদের স্বেদবিন্দু ছুঁয়ে দোকানীর মালামালের কিম্বা ভাজা-মুড়ির প্যাক হয়ে পরিশেষে মাটির সাথে মিশে গেছে। এই চিঠিগুলো নবপ্রেমিক-প্রেমিকা কর্তৃক সুলিখিত। যেমন:
প্রিয় শিশির,
এখোন গভীর রাত, মেদিনীর তাবৎ মানবকুল নিদ্রাদেবীর আহবানে সাড়া দিয়ে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। কেবল দূরে দু’একটি নিশিক্লান্ত সারমেয়রের কান্নামিশ্রিত আকুতি। দুরে আরো দূরে কোন সাথীহারা রাতজাগা ডাহুকের স্বকরুণ আর্তনাত। ঝিরিঝিরি বাতাসে ভেসে আসছে রজনীগন্ধ্যার মনপাগল করা মৃদুসুবাস। এমনি একক্ষণে আমার হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে তোমাকে জানাই প্রীতিপূর্ণ শুভেচ্ছা। আশা করি তুমি কুশলে থেকে আমার পত্রের অপেক্ষায় চাতক পাখীর মত পথচেয়ে বসে আছো।
পরালাপ, মনে পড়ে কৃষ্ণপক্ষের উদীয়মান চাঁদের আলোয় বাঁধানো পুকুরের তৃতীয় সিঁড়িতে ... ... ... এখোন সেই সিঁড়ি গভীর জলমগ্ন মাছেদের চারণভূমি, হয়তো তারাও মত্ত আছে গভীর ভালোবাসাপূর্ণ জলকেলিতে।... ... ...।
কিম্বা,
প্রিয় কণা,
আবেগ নয়, অনধিকার চর্চাও নয়
নয় কোন মিথ্যা আশ্বাস, সুপরিকল্পিত অভিনয়;
সময়ের হাত ধ’রে স্বপ্নীল অনুভূতির সমুদ্রে একান্ত ভেসে যাওয়াও নয়।
ভালোবাসা নিবেদনকে-
যদি বলো আত্মপোলব্ধির ত্রুটি
তবে সেটাও হবে নিতান্ত ভুল,
কারণ; ভালোবাসা জীবন ও যৌবনের একান্ত অধিকার
আর তোমাকে ভালোবাসি সেজন্যে
শুধু সে অধিকারেই।
তোমারাই,
জোজো।
(চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।