Inqilab Logo

রোববার, ১৬ জুন ২০২৪, ০২ আষাঢ় ১৪৩১, ০৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

এতদিনেও ধরা পড়েনি খুনিরা

চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ড সাগর-রুনি-তনু-মিতু

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২৮ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

গত এক দশকে বেশ কয়েকটি আলোচিত হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটলেও এতদিনেও ধরা পরেনি খুনিরা। বছরের পর বছর ধরে তদন্ত চললেও জড়িতদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। এসব হত্যাকান্ডের মধ্যে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি, কুমিল্লার কলেজ ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু, চট্টগ্রামের সাবেক এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলার তদন্ত ফাইলবন্দি হয়ে রয়েছে। মাত্র ৬ মাসে ফেনীর নুসরাত হত্যা মামলার তদন্ত শেষে রায় হওয়ায় আশার আলো দেখছেন চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের শিকার পরিবারের সদস্যরা। তবে মামলা তদন্ত ও তদারককারী কর্মকর্তারা বলছেন, মামলায় আসামিদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা বিলম্বিত হচ্ছে। যে কারণে মামলার তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশিটও দেয়া যাচ্ছে না।

সাগর-রুনি হত্যা মামলা
রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুন হন ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। এই নৃশংস জোড়া খুনের পর প্রথমে থানা পুলিশ ও পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্তভার গ্রহণ করে। হত্যাকান্ডের প্রায় দু’মাস পর একই বছরের ১৮ এপ্রিল ডিবির তৎকালীন ডিসি মনিরুল ইসলাম উচ্চ আদালতে উপস্থিত হয়ে তদন্তের অগ্রগতি জানান। তখন উচ্চ আদালত সুদক্ষ, অভিজ্ঞ এবং এএসপি পদমর্যাদার নিচে নয় এমন একজন কর্মকর্তাকে দিয়ে এই মামলার তদন্ত করাতে র‌্যাবের ডিজিকে নির্দেশ দেন। এরপর থেকে এই মামলার তদন্ত করছে র‌্যাব। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পর ২০১২ সালের ২৬ এপ্রিল সাগর-রুনির লাশ কবর থেকে তুলে দ্বিতীয় দফায় ময়নাতদন্ত করা হয়। প্রতিবেদন দাখিলের জন্য অন্তত ৫৪ বার সময় নিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। এরপর গত সাত বছরে র‌্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছেন একাধিকবার।

সম্প্রতি সাংবাদিক দম্পতি হত্যা মামলার তদন্ত ৮ বছরেও শেষ না করায় তদন্ত কর্মকর্তাকে (আইও) তলব করেছেন হাইকোর্ট। ৬ নভেম্বর মামলার সব নথিপত্রসহ তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাবের এএসপি মহিউদ্দিনকে হাইকোর্টে সশরীরে উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। হত্যাকান্ডের সময় সাগর মাছরাঙা টিভিতে আর রুনী এটিএন বাংলায় কর্মরত ছিলেন। হত্যাকান্ডের সময় বাসায় ছিল তাদের সাড়ে চার বছরের ছেলে মাহির সরওয়ার মেঘ। হত্যাকান্ডের ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম রোমান শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। সব মিলিয়ে এ মামলায় মোট ৮ জন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তারা হলেন- রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মো. সাইদ, মিন্টু, কামরুল হাসান ওরফে অরুণ, সাগর-রুনির ভাড়া বাসার নিরাপত্তা প্রহরী এনামুল, পলাশ রুদ্র পাল এবং নিহত দম্পতির বন্ধু তানভীর রহমান। এদের মধ্যে কেউ কেউ জামিনে রয়েছেন।

সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন র‌্যাব সদর দফতরের ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড ফরেনসিক উইংয়ের সহকারী পরিচালক এএসপি মো. সহিদার রহমান। তিনি বলেন, আমরা তো আন্তরিকভাবেই তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা চেষ্টা করছি শেষ করার জন্য। কিন্তু কিছু বিষয় আছে যেগুলোর কাজ এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি। যে কারণে আদালতে চার্জশিট দিতে বিলম্ব হচ্ছে।

তনু হত্যা মামলা
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যার তদন্তও শেষ হয়নি গত তিন বছরে। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে একটি বাসায় টিউশনি করতে গিয়ে নিখোঁজ হন তিনি। কয়েকঘণ্টা পর ওই রাতেই তার স্বজনরা বাসার অদূরের একটি জঙ্গলে তনুর লাশ দেখতে পান। খবর পেয়ে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে। পরদিন তনুর বাবা বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। তনুর বাবা ইয়ার হোসেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহায়ক। তাদের বাসাও সেনানিবাসের মধ্যেই।

প্রথমে থানা পুলিশ ও পরে গোয়েন্দা পুলিশের পর ২০১৬ সালের ১ এপ্রিল থেকে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কুমিল্লা শাখাকে। বর্তমানে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন কুমিল্লা সিআইডির এএসপি জালাল উদ্দিন আহমেদ।

নুসরাত হত্যা মামলার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তনুর বাবা ইয়ার হোসেন গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, নুসরাত হত্যা মামলার রায়ে আমি খুশি। আমিও চাই আমার মেয়ে হত্যা মামলার রায় এমনই হোক। দেড় বছর ধরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোনো খোঁজ রাখেন না। আমরা অসহায় মানুষ। আমাদের কথা কে শুনবে?

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জালাল আহমেদ জানান, উদ্ধার করা আলামতের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য যেগুলো দেয়া হয়েছিল, সেগুলোর কার্যক্রম এখনও শেষ হয়নি। ডিএনএ ম্যাচিংয়ের রিপোর্টটা এখনও হাতে পাইনি। সেটা না পেলে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছি না। রিপোর্ট পেলেই সিদ্ধান্তে আসা যাবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

মাহমুদা খানম মিতু হত্যা
চট্টগ্রাম মহানগরীর জিইসি মোড় এলাকায় ২০১৬ সালের ৫ জুন দর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন চট্টগ্রামের তখনকার এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। সেদিন সকালে ছেলে মাহিরকে স্কুলে পৌঁছে দেয়ার সময় তাকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় বাবুল আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা তিনজনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। প্রথমে থানা পুলিশ তদন্ত করলেও পরে গোয়েন্দা পুলিশকে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়। তখন এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ডিবির ইন্সপেক্টর রকিব উদ্দিন। ওই বছরের ১১ জুন তদন্ত কর্মকর্তাকে বদল করে গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার ও বর্তমানে অ্যাডিশনাল এসপি মো. কামরুজ্জামানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপর থেকে গত সাড়ে তিন বছর এই মামলার তদন্ত করছেন তিনি।

দেশজুড়ে আলোড়ন তোলা এ হত্যাকান্ডের তদন্ত এখনো শেষ না হওয়ায় হতাশ মাহমুদার বাবা মোশাররফ হোসেন বলেন, ফেনীর মাদরাসা ছাত্রী নুসরাতের মা-বাবা অন্তত এতটুকু সান্ত¦না পাবে- তাদের মেয়েকে খুনের ঘটনায় আদালত রায় ঘোষণা করেছেন। আর আমাদের মেয়ে মাহমুদাকে খুনের ঘটনায় বিচার দূরে থাক, তদন্তই এখনো শেষ হয়নি। এ অবস্থায় মাহমুদা হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তার পরিবর্তন চান তিনি। সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন বলেন, মৃত্যুর আগে মেয়ে হত্যার বিচার দেখে যেতে চান।

মাহমুদা হত্যাকান্ডের পর বাবুল আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় তিনজনকে আসামি করে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন। বাবুল তখন চট্টগ্রাম থেকে বদলি হয়ে ঢাকায় পুলিশ সদর দপ্তরে এসপি (পুলিশ সুপার) পদে সংযুক্ত ছিলেন। মাহমুদা হত্যাকান্ডের মোড় ঘুরতে শুরু করে ২০১৬ সালের ২৪ জুন ডিবি কার্যালয়ে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের পর। এ সময় হত্যাকান্ডে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, বাবুলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে চাকরিচ্যুত করা হলো।

মাহমুদা হত্যাকান্ডের তিন সপ্তাহ পর মো. ওয়াসিম ও মো. আনোয়ার নামের দুই আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তারা বলেন, কামরুল শিকদার ওরফে মুছার নেতৃত্বে হত্যাকান্ডে তারা সাত-আটজন অংশ নেন। গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে বাবুল চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালনের সময় মুছা তার ঘনিষ্ঠ সোর্স হিসেবে কাজ করতেন।

মামলা তদারকি করছেন চট্টগ্রাম নগর পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, তদন্ত চলছে, তবে শেষ করতে সময় লাগবে।



 

Show all comments
  • Tanjil Ahosan Juwel ২৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১:২৩ এএম says : 0
    অসহায় জাতি
    Total Reply(0) Reply
  • Rafi Khan ২৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১:২৩ এএম says : 0
    আমরা তো সব ভুলে গেলাম
    Total Reply(0) Reply
  • Mohasin Kabir Juyel ২৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১:২৩ এএম says : 0
    এদেশে কোন আইনের শাসন নেই
    Total Reply(0) Reply
  • রেজা নিটোল ২৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১:২৩ এএম says : 0
    ওদের বিচার হতো। এটা যদি বাংলদেশ না হয়ে অন্য কোন দেশ হতো।।
    Total Reply(0) Reply
  • Soharab Mintu ২৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১:২৪ এএম says : 0
    বিরোধী দল জড়িত থাকলে বিচার ঠিকই পেতাম
    Total Reply(0) Reply
  • Md Shahin Miya ২৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১:২৪ এএম says : 0
    কোথাও খুঁজে সঠিক বিচার পাইনা
    Total Reply(0) Reply
  • মোহাম্মদ কাজী নুর আলম ২৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১:২৫ এএম says : 0
    সবই সরকারের ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপার। আমরা সাধারণ মানুষ অসহায়।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হত্যা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ