পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার আরো দুইজনের ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। তারা হলেন- বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচের ছাত্র অমিত সাহা এবং একই বিভাগের ১৭তম ব্যাচের ছাত্র হত্যা মামলার এজহারভুক্ত আসামি হোসেন মো. তোহা। গতকাল শুক্রবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারাফুজ্জামান আনছারী রিমান্ডের এই আদেশ দেন। ইফতিকে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আবরারকে নির্যাতনের গা শিউরে ওঠার মতো ভয়ঙ্কর বর্ণানা দিয়েছেন।
এদিকে, হত্যাকান্ডের ঘটনায় মামলার এজহারভুক্ত আরো দুই আসামিকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ। গ্রেফতাররা হলেন-বুয়েটের এমএমই বিভাগের ১৭তম ব্যাচের ছাত্র মো. মাজেদুল ইসলাম (২১) ও মেরিন ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের ১৭তম ব্যাচের ছাত্র মো. শামীম বিল্লাহ (২০)। গতকাল ভোর ৪টায় সিলেটের শাহ কিরন এলাকা থেকে মাজেদুলকে এবং বিকেল ৪টার দিকে সাতক্ষীরা জেলার ভোমরা স্থলবন্দর এলাকা শামীমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের দু’জনসহ হত্যাকান্ডের ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৮ জনকে গ্রেফতার করা হলো।
আদালত সূত্র জানায়, গতকাল শুক্রবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির লালবাগ জোনের পরিদর্শক মো. ওয়াহিদুজ্জামান আসামি অমিত ও তোহাকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হেমায়েত উদ্দিন খান শুনানিতে অংশ নেন। এছাড়া আসামি পক্ষের আইনজীবী রিমান্ড বাতিলের আবেদন করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারাফুজ্জামান আনছারী দুই আসামির ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় রাজধানীর সবুজবাগ থেকে অমিত ও গাজীপুরের মাওনা থেকে তোহাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
পুলিশ জানায়, গতকাল ভোর ৪টার দিকে সিলেটের শাহ কিরন এলাকা থেকে মাজেদুলকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি আবরার হত্যা মামলায় তিনি ৮ নম্বর আসামি। তার বাসা নগরীর শাহী ঈদগাহ এলাকায়। এছাড়া গ্রেফতার শামীম সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ইফতি মোশাররফের পর জিয়নের স্বীকারোক্তি
পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, হত্যা মামলায় বুয়েট ছাত্রলীগের উপ-সমাজকল্যাণ সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকালের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির পর বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। গতকাল তাকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে জবানবন্দি রেকর্ড করার আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন ঢাকা মহানগর হাকিম সরাফুজ্জামান আনছারী। জবানবন্দি রেকর্ড শেষে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। এর আগে গত মঙ্গলবার জিয়নের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকা মহানগর হাকিম সাদবীর ইয়াসির আহসান চৌধুরী।
পুুলিশ জানায়, হত্যাকান্ডের ঘটনায় এর আগে দুই দফায় ১৩ জনকে ৫ দিন করে রিমান্ডে পাঠান আদালত। এর মধ্যে রিমান্ডে থাকা অবস্থায় বৃহস্পতিবার ইফতি মোশাররফ সকাল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
হত্যার ঘটনার ভয়ঙ্কর বর্ণনা
বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদকে হত্যার ঘটনার ভয়ঙ্কর বর্ণনা উঠেছে ইফতির জবানবন্দিতে। আবরারকে ধরে নেওয়ার পর ক্রিকেটের স্টাম্প আর প্লাস্টিকের মোটা দড়ি (স্কিপিং রোপ) দিয়ে বেধড়ক পিটিয়েছিলেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েন তিনি। তাকে মাটি থেকে তুলে আবারও পেটাতে থাকেন তারা। ঘণ্টা কয়েক পর বমি করতে শুরু করেন আবরার। তিনবার বমি করার পর নিস্তেজ হয়ে যান।
জিজ্ঞাসাবাদে ইফতি বলেছেন, ৪ অক্টোবর বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রবিন শেরেবাংলা হল ছাত্রলীগের একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে একটি নির্দেশনা দেন। এতে বলা হয়, আবরার শিবির করে, তাকে ধরতে হবে। এরপর মেসেঞ্জার গ্রুপে সাড়া দেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা। আবরার তখন বাড়িতে থাকায় তিনি ইফতিকে বলেন, ওকে বাড়ি থেকে ফিরতে দেন।
ইফতি আদালতে বলেন, ৬ অক্টোবর রাত ৮টার কিছু পর আবরারকে ২০১১ নম্বর কক্ষে নিয়ে আসা হয়। আবরারের দুটি মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপও সঙ্গে আনা হয়। তার রুমমেট বুয়েট ছাত্রলীগের উপদপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ একটি মোবাইল ফোন এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম ওরফে তানভীর আরেকটি মোবাইল ফোন চেক করেন। একই বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মুনতাসির আল জেমি আবরারের কাছ থেকে তার ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড নিয়ে খুলে চেক করেন।
জবানবন্দিতে ইফতি জানিয়েছেন, আবরারের ডিভাইসগুলো তারা যখন চেক করছিলেন, তখন মেহেদী হাসান এবং বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক মো. মেফতাহুল ইসলাম ওরফে জিয়ন (নেভাল আর্কিটেকচার মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র) কক্ষে আসেন। মেহেদী তাদের বুয়েটে কারা কারা শিবির করে তা আবরারের কাছ থেকে বের করার জন্য নির্দেশ দেন। এ সময় মেহেদী বেশ কয়েকটি চড় মারেন আবরারকে।
ইফতি আদালতকে বলেন, ওই কক্ষে তখন ক্রিকেটের কোনো স্টাম্প ছিল না। বাইরে থেকে তখন কেউ একজন স্টাম্প নিয়ে আসেন। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সামসুল আরেফিন ওরফে রাফাত স্টাম্প এনে তার হাতে দেন। আবরারের কাছ থেকে কথা বের করার জন্য স্টাম্প দিয়ে চার-পাঁচটি আঘাত করেন ইফতি। এতে স্টাম্পটি ভেঙে যায়। বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক অনিক সরকার (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র) স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু, পা, পায়ের তালু ও বাহুতে মারতে থাকেন। এতে আবরার উল্টাপাল্টা কিছু নাম বলতে শুরু করেন। তখন মেফতাহুল আবরারকে চড় মারেন এবং স্টাম্প দিয়ে হাঁটুতে বাড়ি দেন। এ সময় মেহেদী মুঠোফোনে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাসেলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
ইফতি আদালতকে বলেন, রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিনি ক্যানটিনে খেতে যান। মিনিট বিশেক পর ফিরে এসে দেখেন, আবরার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি মেঝেতে শুয়ে আছেন। তিনি তখন আবরারকে ধমক দিয়ে উঠে দাঁড় করান। কয়েকটি চড় মারেন। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মুজাহিদুর রহমান তখন কক্ষে থাকা স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরারকে মারেন। ইফতি আবার স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু ও পায়ে আঘাত করেন। তাবাখখারুল তখন চড়-থাপ্পড় মারেন।
ইফতি ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার এই পর্যায়ে বলেন, রাত ১১টার দিকে অনিক সরকার আবার কক্ষে আসেন। হঠাৎ অনিক স্টাম্প দিয়ে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে এলোপাতাড়ি শতাধিক আঘাত করেন। অনিক খুবই অনিয়ন্ত্রিতভাবে আবরারকে মারতে থাকেন। তার মারা দেখে সবাই ভয় পেয়ে যান। আনুমানিক রাত ১২টার পর অনিক আবরারকে মারা থামিয়ে কক্ষের বাইরে যান।
ইফতি বলেছেন, তখন আবরার অসুস্থ হয়ে পরে ছিলেন। তিনি জানান, তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তখন আবরারের মাথার নিচে দুটি বালিশ দেন তিনি। এর কিছুক্ষণ পরই আবরার বমি করেন। মুঠোফোনে বিষয়টি অনিককে জানানো হলে তিনি আবরারকে গোসল করিয়ে হাতে-পায়ে মলম লাগিয়ে দিতে বলেন। এ সময় আবরার দ্বিতীয়বার বমি করেন। তখন আবরারের কক্ষ থেকে তাঁর কাপড়চোপড় নিয়ে আসা হয়। তখন মেহেদী আবরারকে দেখে বলেন, ‘ও নাটক করছে’।
ইফতি বলেন, এরপর আবরারকে ২০০৫ নম্বর কক্ষে নিয়ে শুইয়ে দেওয়া হয়। এ সময় অমিত খুদে বার্তা পাঠালে তিনি সবকিছু জানতে চান এবং আবরারকে আরও মেরে আরও তথ্য বের করতে বলেন। আবরারের অবস্থা খুব খারাপ জানালে অমিত তাকে হল থেকে বের করে দিতে বলেন। এর কিছুক্ষণ পর মেহেদী ও অনিক ২০০৫ নম্বর কক্ষে আসেন। আবরারকে দেখে তারা বলেন, ‘ও ঠিক আছে।’ এরপর তারা চলে যান।
ইফতি বলেন, এ সময় আবরার আবার বমি করেন। মেহেদী তখন আবরারকে পুলিশের হাতে দেওয়ার জন্য নিচে নামাতে বলেন। ১৭ ব্যাচের ছেলেরা আবরারকে নিচে নামানোর চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হলে তোশকসহ আবরারকে ধরে দোতলা ও নিচতলার সিঁড়িতে নামিয়ে রাখেন। তখন আবরার বলছিলেন যে তার খুব খারাপ লাগছে। সাধারণ সম্পাদক রাসেল তখন নিচে নেমে হলের প্রধান ফটকে পুলিশের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এ সময় মুনতাসির দৌঁড়ে এসে বলেন, আবরারের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ইফতি তাকে মালিশ করতে বলেন। ইসমাইল ও মনির তখন অ্যাম্বুলেন্সে ফোন দেন। অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেরি হওয়ায় তামিম বাইক নিয়ে বুয়েট মেডিকেলের চিকিৎসক নিয়ে আসেন। চিকিৎসক আসার পরপরই অ্যাম্বুলেন্স আসে। চিকিৎসক সিঁড়িতে আবরারকে দেখে বলেন, ‘ও মারা গেছে।’ পরে ইফতি একটি কক্ষে গিয়ে শুয়ে থাকেন। সেখান থেকে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
সংশ্লিষ্টতা পেলেই গ্রেফতার করা হবে-মনিরুল
গতকাল ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডে কারো সংশ্লিষ্টতা পেলেই গ্রেফতার করা হবে। এক্ষেত্রে এজাহারে নাম আছে কি-না তা দেখা হবে না। সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের মাধ্যমে সুষ্ঠু তদন্ত করে মামলার কাজ শেষ করে আদালতে জমা দেয়া হবে বলে তিনি জানান।
তিনি আরও বলেন, শুক্রবার এজাহারভুক্ত এক আসামিকে সিলেট থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ঘটনার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলেই তাদেরকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। এক আসামির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির কপি এখনো আমরা পাইনি। কপি পেলে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো- কতটুকু শেয়ার করতে পারবো। এছাড়া শুধুমাত্র একজনের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি পেলে আর বাকিদের না পাওয়া গেলে তার মধ্যে কতটুকু প্রকাশ করা যাবে, তা নিয়েও আইনি বিধিনিষেধ রয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ৬ অক্টোবর রাতে ফেসবুকে বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি প্রসঙ্গে পোস্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর রুমে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় আবরার ফাহাদকে। এ ঘটনায় পরদিন আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে ১৯ জনের নাম উল্লেখ করে চকবাজার মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।