শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
বর্ষার ঝরঝর বাদল যখন বিরহকাতর প্রেমিক হৃদয়ের আকাশে কান্না হয়ে ঝরে,তখনি সজীব প্রকৃতি এই বিরহ- ব্যাথায় প্রশান্তির প্রলেপ দিতে নিয়ে আসে শরতের শুভ্রতার পবিত্র ছোঁয়া। এই পবিত্র ছোঁয়ার স্নানে শুদ্ধ হয় প্রতিটি হৃদয় মন। এর সাথে অনাবিল আনন্দের ঝর্ণা হয়ে আসে সুনীল আকাশের স্বচ্ছতায় শিমুল তুলার মতো শাদা শাদা মেঘ। প্রকৃতিও নানান বাহারী ফুলের সজ্জায় সাজিয়ে তুলে তার অঙ্গ সৌষ্ঠব। শিউলি, বেলী, কাশফুল, মাধবী, মলিকায় বিমোহিত তৃষ্ণার্ত আঁখি। শরতকে বলা হয় ঋতু রাণী। ঋতুরাজ বসন্তের দীর্ঘ অনুপস্থিতে সবার হৃদয়-মন যখন আনচান করে, তখনি ঋতুরাজের অনুপস্থিতে অগোছালো প্রকৃতির সাম্রাজ্যককে সাজাতে রাজ সিংহাসনে আসীন হয় ঋতুরাণী শরৎ।নীল আকাশে শাদা মেঘের ভেলায় চরে সমস্ত সাম্রাজ্য ঘুরে বেড়ায় শরত।
শরৎ প্রকৃতিকে যে মোহনীয় রূপ-রসে সাজায় তাতে প্রতিটি হৃদয়কে উতলা করে তোলে।নীল আকাশের শাদা মেঘ নিয়ে আসে কোমল আনন্দের বার্তা।রপময়,নির্মল শরত প্রকৃতির সাথে সাথে মানুষের মনকেও করে তোলে কাব্যিক।রাতের অপূর্ব স্বচ্ছ জোছনায় ভিজে উঠে কবি-মন।সৃষ্টি হয় অসাধারণ সব কবিতা,গান আর সুরের।চর্যাপদের কবি থেকে শুরূ করে আধুনিক কবিরাও শরতের নান্দনিকতায় সৃষ্টি করেছেন সাহিত্যের অমিয় সুধা।
বৈষ্ণব সাহিত্যে শরতের সৌন্দর্য, বিরহের রূপ প্রতিটি মানুষের মনকে উদ্বেল করে তোলে।বৈষ্ণব পদাবলীর অন্যতম কবি বিদ্যাপতি রাধা বিরহের যে চিত্র অংকন করেছেন তা শুনে প্রতিটি বিরহ কাতর হৃদয়ই হাহাকার করে উঠে।
‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।’
সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি কালিদাস।তার অমর সৃষ্টি ‘মেঘদূত’ কাব্যগ্রন্থ।বাংলা সাহিত্যে প্রচুর সংস্কৃত শব্দের উপস্থিতি।বাংলা ভাষাও নানান ভাবে সংস্কৃতের কাছে ঋণি।আর কালিদাসের ‹মেঘদূত› বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে আসছে বহু পূর্ব থেকেই। ‘মেঘদূতে’ স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে পতিত প্রেমিক যক্ষ তার প্রিয়ার বিরহে কাতর।বর্ষার আকাশের মেঘকে তাই সে দূত করে প্রিয়ার কাছে পাঠায়।বিরহী বর্ষা শেষে শরতের আগমনে তার মনোকাশেও প্রিয়া মিলনের আশায় চঞ্চল হয়ে উঠে।তিনি বলেন-
্রপ্রিয়তম আমার,ঐ চেয়ে দেখ,নববধুর ন্যায় সুসজ্জিত শরতকাল সমাগত।গ্ধ
কবি কালিদাস ‹ঋতুসংহার› কাব্যে শরতকে নারী দেহের সাথে তুলনা করে যে বর্ণনা দিয়েছেন তা অসাধারণ।এই বর্ণনা শুনে সবার মনই নারী কামনায় কাতর হয়ে উঠে।কবি লিখেছেন--
‘কাশফুলের মতো যার পরিধান, প্রফুল পদ্মের মতো যার মুখ, উন্মত্ত হাঁসের ডাকের মতো রমনীয় যার নুপুরের শব্দ, পাকা শালি ধানের মতো সুন্দর যার ক্ষীণ দেহলতা, অপরূপ যার আকৃতি সেই নববধুর মতো শরৎকাল আসে।’
বাংলা সাহিত্যের অমর বটবৃক্ষ বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঋতু বন্দনার কবিতা, গান রচনা করেছেন প্রকৃতির সাথে মিশে। বিভিন্ন ঋতু ভিত্তিক তার গান,কবিতা আছে। আর ঋতুর রাণী শরতকে নিয়ে তার সৃষ্টি যেন ব্যাঙময় হয়ে উঠেছে সৃষ্টিশীল কলমে।শরতের বর্ণনাময় কবিতা-গানে আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ ও সুবাসিত করেছেন কবিগুরূ।যেমন তিনি শরত নিয়ে লিখেছেন--
্র শরৎ তোমার অরূণ আলোর অঞ্জলি
ছড়িয়ে গেল ছাড়িয়ে মোহন অঙ্গুলি।
শরৎ তোমার শিশির ধোওয়া কুন্তলে
বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।’
শরতের পরিষ্কার সুনীল আকাশ,ধানক্ষেতে বাতাসের খেলা,আকাশে শাদা মেঘের ভেসে বেড়ানো দেখে যে ভালোলাগার খেলা মনে খেলে যায় তাই বলে দিয়েছেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরির খেলা
নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা।’
বাংলা সাহিত্যাকাশে উজ্জ্বল ধুমকেতু কবি কাজী নজরূল ইসলাম। অন্যায়, অত্যাচার, পরাধীনতা তাকে বিদ্রোহী করে তুললেও; প্রেম, বিরহের চির কাঙ্গাল কবি শরতেরও জয়গান গেয়েছেন তার কবিতা আর গানে। চির সবুজ এসব কবিতা, গানে স্নাত হয় পাঠক মন। বিদ্রোহী কবির গহীন হৃদয়ে ঝর্ণার মতো জমানো এত প্রেম, সত্যিই বিস্মিত করে তোলে।›রাখি বন্ধন› কবিতায় কবি শরতের রূপ তুলে ধরেছেন এভাবে--
‘সই পাতালো কি শরতে আজিকে স্নিগ্ধ আকাশ ধরণী?
নীলিমা বাহিয়া সওগাত নিয়া নামিছে মেঘের তরনী!
অলাকার পানে বলাকা ছুটেছে মেঘদূত মন মোহিয়া
চঞ্চু রাঙা কলমীর কুড়ি মরতের ভেট বহিয়া।
সখির গাঁয়ের সেঁউতি বোটার ফিরোজায় ঢঙ পেশোয়াজ
আসমানী আর মৃন্ময়ী সখি মিশিয়াছে,মেঠোপথ মাঝ।’
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ তার কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে বাংলার প্রকৃতিকে এঁকেছেন। বাংলার হিজল, তমাল, ধানসিঁড়ি নদীর মতো শরত ও কবির কবিতায় এসেছে সার্থক রূপে।কবি শরতকে দেখেছেন একাকীত্বের দু:সহ বেদনায় রঙ এঁকে দিতে। তিনি বলেন--
‘এখানে আকাশ নীল/নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল/ফুটে থাকে হিম সাদা রঙ আশ্বিনের আলোর মতোন;আকন্দ ফুলের কালো ভীমরূল/এইখানে করে গুন্জরণ।’
মাটি ও মানুষের কবি, পল্লীকবি জসীমউদ্দীন। গ্রামীন পটভুমিকায় তিনি মানুষ ও প্রকৃতিকে কবিতায় জীবন্ত করেছেন। তার মতো এত দরদ দিয়ে মানুষের জীবন আর কেউ আঁকতে পারেননি। শরতের বিরহী রূপটি ধরা পড়েছে কবির কবিতায়--
‘গুনিতে গুনিতে শ্রাবন কাটিল, আসিল ভাদ্র মাস,
বিরহী নারীর নয়নের জলে ভিজিল বুকের বাস।
আজকে আসিবে কালকে আসিবে, হায় নিদারূন আশা,
ভোরের পাখির মতোন শুধুই ভোরে ছেঁয়ে যায় বাসা।’
সা¤প্রতিক বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম কবি, লোকজ কবি আল মাহমুদ তার কবিতায় আমাদের সমাজের, গ্রামের অন্ত্যজ শ্রেনীর মানুষের কথা কবিতায় আধুনিক ঢঙে উপস্থাপন করেছেন।কবি তার জীবন সায়াহ্নে এসেও বাংলার শরতের ঘ্রাণ পান,ভুলতে পারেন না কাশফুলের শুভ্রতাকে। ‘একটি শরৎ সন্ধা›কবিতায় কবির হাহাকার--
‘ঋতুর অতীত আমি। কে জিজ্ঞাসে এটা কোন মাস?
বাতাসে গড়িয়ে পড়ে বিদায়ের বিষন্ন নির্যাস।
শ্রবনের ও শক্তি নেই। কিন্তু ভাবি কোলাহল আছে
প্রতিটা বাড়ির রন্ধ্রে, ইটে ইটে আনাচে- কানাচে!
এটা কি শরৎ সন্ধা? বাংলাদেশ?
কাঁশফুল ছেয়ে গেছে চর?
শরতের নান্দনিক সৌন্দর্য, স্বচ্ছ সকালের কোমল রোদ, পূর্ণিমা রাতের অসাধারণ সুন্দর জোছনা সবার মন-মন্দিরে এক স্বর্গীয় অনুভূতির দোলা দেয়।নীল আকাশে শুভ্র মেঘের আনাগোনা, নদী তীরের শাদা কাশফুল কাব্যিক এই উপমাই শরতের কবিতার সুর।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।