শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
মা, বাবা কি এখনো অফিস থেকে ফিরেনি?
না, তোর বাপ আজ বাসায় ফিরবে না, গ্রামের বাড়ি গেছে।
কেন?
চুলার আগুন কমিয়ে পাতিলটা তুলে ভাতের মাড় ফেলতে ফেলতে তেজস্বী স্বরে ফারজিয়া বলে, মরতে গেছে তোর বাপ, তর বাপ নাকি কাশফুলের গন্ধ পেতে গেছে।
ফারজিয়াকে রেগে উঠতে দেখে, অল্পক্ষণ চুপ করে মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় মেয়েটি, মা, ও মা; আমাদের নিয়ে গেল না কেন? আমিও কাশফুল দেখব মা!
শরত এলেই তোর বাপ এমনটা করে থাকে; কাশফুলের গন্ধ নিতে যায়, যত্ত সব...
আমাকে নিয়ে যাও মা, আমার কাশফুল দেখতে ইচ্ছে করে!
চুপ কর, সন্ধ্যা হয়ে গেছে; এখনই টিচার আসবে, বই নিয়ে বসো গিয়ে।
শরত এলেই মাজিদের মন-মেজাজ ঠিক থাকে না; যদিও বসন্তে পাগল ক্ষেপে, কিন্তু মাজিদের বেলায় ভিন্ন, শরত এলে ওর মন পাগলা ঘোড়ার মতো ক্ষেপে ওঠে, ছুটে যায় গ্রামে, জয়পুরে; গন্ধহীন বিভাময়ী কাশফুলের শুভ্রতায় আপন মনে খুঁজে বেড়ায় কোনো এক কাশকুমারীকে...!
সেটা নতুন নয়, শৈশব থেকেই। ওর পাগলামিটা শুরু হয়েছিল মাধ্যমিক স্কুলে পড়াকালীন থেকে।
মাছিমপুর হাই স্কুলে পড়তো মাজিদ। গ্রাম থেকে মাইল দুএক দূরে ওই স্কুল; ওই স্কুলটি প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে দূরদর্শী চিন্তাধারা। রাজবিহারী পোদ্দার ছিলেন ব্রিটিশদের তোষামুদকারী একজন জমিদার। ওই সময়ে মাছিমপুর এলাকায় ছিল চোরের খুবই উৎপাত । প্রতিরাতেই কারো না কারো বাড়িতে চুরি হতো। গ্রামের লোকজন চোরের হাত থেকে বাঁচতে রাজবিহারী বাবুর কাছে গেলেন।
চোরের উপদ্রব কমাতে তিনি মাছিমপুর বাজারে একটি ফাঁড়ি থানার ব্যবস্থা করলেন। বাজারে পুলিশ ফাঁড়ি হওয়ায় অল্পদিন চুরির ঘটনা কিছুটা কম হলেও সময়ে সঙ্গে সঙ্গে চোরের উৎপাত এতটাই বেড়েছে যে, রাজবিহারীর বাড়িতেই চুরির ঘটনা ঘটতে শুরু করে। রাতে পুলিশ টহল দিয়েও চুরির ঘটনা কমাতে পারছে না। পুলিশ পাহারা দিবে কি, বরং পুলিশকেই চোরেরা পাহারা দিয়ে রাখে। সন্দেহ করে দুএকজনকে ধরে ফাঁড়ি থানায় নিয়ে এলেও, ওই চোরদের বউ-বাচ্চার কান্নাকাটিতে রাজবিহারী বাবুকেই গিয়ে ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে।
সারারাত জেগে পুলিশ নিয়ে গ্রামের লোকজন পাহারা দিতে থাকে; উচ্চস্বরে সমগীত কণ্ঠে লোকজন চোরকে সাবধান করে বিভিন্ন ছন্দময় বাক্যের সাহায্যেÑ এলাকাবাসী জাগো রে..., খবরদার...
রাতজাগা পাহারা দিয়েও চুরি ঠেকাতে ব্যর্থ হয়। প্রতিদিন সকালেই কেউ না কেউ পোদ্দার বাড়িতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েÑ আমার সর্বনাশ হইয়া গেছে, এটা নিয়ে গেছে, ওটা নিয়ে গেছে; আমাকে পথে বসিয়ে দিয়েছে ইত্যাদি...
নিরুপায় হয়ে রাজবিহারী পোদ্দার ব্রিটিশদের শরণাপন্ন হলেন। ওরা পরামর্শ দিলেনÑ বিহারী বাবু, চোরের উপদ্রব আপনি একদিনে কমাতে পারবেন না, কিছুটা সময় লাগবে। আপনি এক কাজ করুনÑ আপনার তো ভূ-সম্পত্তির অভাব নেই, একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করুন; দেখবেন, একসময় আপনার এলাকায় আর চোর থাকবে না; লোকজন শিক্ষিত হয়ে উঠলে, চুরি-চামারিও বন্ধ হয়ে যাবে। এরপরই রাজবিহারী বাবু দেশ বিভাগের প্রায় একযুগ আগে মাছিমপুর স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন।
গ্রামের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে স্কুলে যেতো মাজিদ। মনতলা কবরস্থানের আশপাশে কয়েক মাইল কোনো লোকবসতি ছিল না, কবরস্থানের পাশ দিয়ে যাবার সময় সকলেরই বুক ধুকপুক করে ওঠতো! নানান ভুত-প্রেতের কল্পকাহিনি লোকমুখে শোনা যেতো মনতলা কবরস্থানকে ঘিরে। কিন্তু মাজিদ ছোটবেলা থেকেই ছিল অত্যন্ত সাহসী ও ডানপিটে; ওসব ভুত-প্রেতের কল্পকাহিনি শুনলে সে আরো কৌতূহলি হয়ে পড়তোÑ ভুত-প্রেত দেখার জন্য।
একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে একই গ্রামের পশ্চিম পাড়ার আমির ভূঁইয়ার ভাতিজি জলিকে বই-খাতা হাতে নিয়ে রাস্তার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখে মাজিদ গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ায়, কি রে জলি, এইখানে খাঁড়াইয়া কান্দস্ ক্যান, কী হইছে তর?
মাজিদকে দেখে জলি যেন আরো ফুঁপিয়ে ওঠে, কবরস্থানের কাছ দিয়া একলা যাইতে আমার ডর করে!
মুচকি হেসে ওঠে মাজিদ, অ্যাই, তর আবার ডর কিসের, আয় আমার লগে; তর ডর আইজ ভাইঙ্গা দেমু।
শরত এলেই গ্রামের পথ-ঘাটে কাশফুলগুলো বিভাময় শুভ্রতায় ফুটে ওঠে! বাতাসে নৃত্যরত ফুলগুলো হামেশাই পথিকের শরীর স্পর্শ করে পরশ বুলিয়ে দেয়।
জলিকে সঙ্গে নিয়ে কবরস্থানের পাশ দিয়ে যাবার সময় কাশফুল দেখে মোহিত হয়ে ওঠে মাজিদ, বলে, দেখ জলি, কী অপূর্ব কাশফুল ফুটছে! চল না ওই কাশবনের
আড়ালে গিয়ে কিছুক্ষণ বসি।
আৎকে ওঠে জলি, না, কী কও ইতান; তাড়াতাড়ি বাড়ি চলো; এখানেই তো মির্জানগরের হোসেনের লাশ পইড়া ছিল; তোমার কি জানা নাই কীভাবে প্রেতাত্মারা হোসেনের কলিজা বাইর কইরা খাইছিল?
মির্জানগরের হোসেন মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো। কিন্তু ওর যে মৃগ রোগ ছিল, তা পরিবারের লোকজন ছাড়া অন্য কেউ জানতো না। একরাতে মাছ ধরতে গিয়ে আর বাড়ি ফিরেনি হোসেন। পরদিন সকালে ওর লাশ দেখতে পায় ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায়, মনতলার ডোবায়।
মনতলা গোরস্থানে কবরে লাশ রেখে আসার পরই শেয়ালদের মচ্ছব শুরু হয়। হামেশাই গোরস্থানের আশপাশে মৃত মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়!
একটি কাশফুল নিয়ে জলির হাতে তুলে দেয় মাজিদ, এই ধর, গন্ধহীন ফুলের শুভ্রতায় বিভাময় হোক তর জীবন...
লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে জলি ফুলটি হাতে নিয়ে দ্রæত বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
এরপর থেকেই জলিকে দেখলেই মাজিদ কাশকুমারী বলে ডাকতো। ওই কাশফুলও সুবাস ছড়াতে শুরু করে! মাঝেসাঝে ওদের বাড়ি যেতো মাজিদ, গোপনে এখানেওখানে দাঁড়িয়ে গল্প করতো; চোখে চোখে অনুরাগের ভাব বিনিময় করতো!
মাধ্যমিক পাস করার পরই জলির বিয়ের কথাবার্তা চলতে দেখে বিচলিত হয়ে মাকে ডেকে ও বলে, আম্মা, আমি অহন বিয়া করমু না, লেহাপড়া করমু।
চোখ রাঙিয়ে ওঠে মা, ইতান কইস না বেটি, বিয়ার কথা ঠিকঠাক; খালি দিন-তারিখের বাকি।
রেগে ফোঁসফোঁস করে ঘর থেকে বেরুয় জলি, আমি অহন বিয়া করমুই না...
জলির বাপ একথা শোনে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে, মাইয়া দেহি লায়েক হইয়া গেছে!
মাইয়ার কথা তুমি হুইনো না, এই বয়সে মাইয়ারা কত কথাই কয়; অন্দর থেকে জলির মা বলল।
একদিন বিকেলে মাছিমপুর বাজারে গিয়ে বসে থাকে জলি; কলেজ থেকে ফেরার পথে মাজিদের পিছু নেয় ও। গোরস্থানের পাশে আসার আগেই পেছন থেকে কার ডাকে পিছু ফিরে তাকায় মাজিদ। দ্রæত হেঁটে মাজিদের কাছাকাছি আসার পর বিস্ময়ে তাকায় মাজিদ, জলি..?
চলো কোথাও গিয়ে বসি, জরুরি কথা আছে।
শেষ বর্ষার ফসলের মাঠ অগ্রহায়ণের অপেক্ষায়, পোয়াতি রোপা আমনের ধানের শীষগুলোর চোখ মেলতে শুরু করেছে। গোরস্থানের পশ্চিমে ধানক্ষেতের পাশে গিয়ে বসে মাজিদের হাত চেপে ধরে জলি, বিয়ার কথাবর্তা ঠিক হইয়া যাইতেছে, এখন কী করবা?
বিস্ময়ে কপালে চোখ ওঠে মাজিদের, কও কী..!
হ, যা করার জলদি করো; শীঘ্র বাপের কাছে ঘটক পাঠাও।
ঠিক আছে, চিন্তা কইরা দেখি কী করন যায়!
দেরি কইরো না; তোমার দেওয়া কাশফুলটা অহনো আমার পড়ার টেবিলে সামনে ঝুইলা আছে।
পড়াশোনা শেষ করে চাকুরি করবে, এরপর বিয়ের স্বপ্ন মাজিদের। এমন সাত-পাঁচ ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই সিদ্ধান্ত ঠিক হয়ে গেল।
হঠাৎ একরাতে কোনো এক কুমারী কন্যার গলাফাটা বিলাপের করুণ আর্দ্রতায় কেঁপে ওঠে স্তব্দ রাত! তারাগুলোও কাঁদছে ওর সাথে!। ঘুমের অপেক্ষায় শায়িত মাজিদের কানে ওই কান্নার দীর্ঘশ্বাস করুণ ঢেউ তোলে! দ্রæত শোয়া থেকে ওঠে ঘর ছেড়ে বেরোয় মাজিদ...
কাছাকাছি যাবার আগেই কান্নারত ওই কুমারীকে চিনতে আর কোনো অসুবিধা হলো না মাজিদের, সে তো ওরই কাশকুমারী। দ্রæত হেঁটে ওর কাছে যাবার আগেই প্রাইভেট কার স্টার্ট হওয়ার শব্দে কিছুটা চির ধরিয়ে দেয় জলির ওই করুণ কান্নার আকুতিতে! গাড়ির গতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কাশকুমারীর কান্নার করুণ ধ্বনিও ধীরে ধীরে মিইয়ে যেতে থাকে রাতের নীরবতায়...
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।