Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, কমিশন বাণিজ্য, ক্যাসিনো ও মাদকবিরোধী অভিযান যেন বন্ধ না হয়

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অভিযোগে ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতা রেজোয়ানুল হক শোভন ও গোলাম রব্বানিকে বহিষ্কারের পর প্রধানমন্ত্রী শেথ হাসিনা যুবলীগ নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, তারা ছাত্রলীগের শোভন-রাব্বানীদের চেয়ে খারাপ। তিনি এও বলেছেন, ছাত্রলীগের পর এবার যুবলীগকে ধরেছি। গত এক দশকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কিছু সাহসী ও চাঞ্চল্যকর পদক্ষেপ নিয়েছেন। এক-এগারো পরবর্তি প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় যাওয়ার পর আরিয়াল বিলে বিমান বন্দর স্থাপনের মত সিদ্ধান্ত স্থানীয় জনগনের প্রতিরোধ আন্দোলনের মুখে বাতিল হয়ে যাওয়া অথবা বিদ্যুৎ বাঁচাতে ডে-লাইট সেভিং টাইম নির্ধারণ করে ঘড়ির কাঁটায় পরিবর্তনের মত সিদ্ধান্ত মানুষের কাছে প্রত্যাক্ষাত হলেও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মান এবং পঞ্চাশ বছর পর রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগের বিশাল চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে শেখ হাসিনা তার নেতৃত্বের দৃঢ়তার স্বাক্ষর রেখেছেন। সুন্দরবনের ভবিষ্যৎকে চরম ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া স্পর্শকাতর অঞ্চলে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া সত্তে¡ও তা বাস্তবায়ন চলছে। দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে বাস্তবায়নাধীন প্রতিটি মেগা প্রকল্পে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি, শেয়ার বাজার কারসাজি, কেন্দ্রিয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি থেকে শুরু করে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে টাকা লুণ্ঠণ করে নানা উপায়ে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাঁচার করে দেশের অর্থনীতি ভেতর থেকে ফোঁকলা দিলেও এসব অপকর্মের হোঁতাদের বিরুদ্ধে গত এক দশকেও তেমন কোনো শক্ত পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় নি। শেয়ার বাজার লুটেরা, ব্যাংকের আমানত লুন্ঠনকারী ও সরকারী ক্রয় খাতের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়া ব্যক্তিদের বেশিরভাগই সরকারী দলের পদ পদবীর লেবেল এঁটে দিব্যি বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের মাত্র ২ কোটি টাকার কথিত দুর্নীতি বা দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগে তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, দেশের অন্যতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা ৭৩ বছরের বৃদ্ধা, অসুখ-বিসুখে কাবু হয়ে পড়া বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে জেল বন্দি রেখে সরকার আইনের শাসনের পরাকাষ্ঠা দেখালেও মাদক গডফাদার ও হাজার হাজার কোটি টাকা লুটেরাদের সদম্ভ বিচরণের চিত্র থেকে জনগণের স্বার্থ ও আইনের শাসনের হিসাব মিলছে না। উপরন্তু গত এক দশকে গুম-খুনের অভয়ারণ্যে পরিনত হয়েছে বাংলাদেশ। জননিরাপত্তা ও মানবাধিকারের ধারবাহিক অবনমন এখন বাংলাদেশ সম্পর্কে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনসহ বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহযোগিরা ক‚টনৈতিক চাপ অব্যাহত রেখেছে। এ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের ৪২তম অধিবেশনে বাংলাদেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে গত এক দশকে বাংলাদেশে ৫৩৬ জনকে গুম করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এ সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে এবং বিচার বর্হিভুত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর যথেচ্ছ গ্রেফতার ও মামলাবাজির শিকার হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িতদের রাষ্ট্রীয়ভাবে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে বলে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে এশিয়ান লিগ্যাল রির্সোস সেন্টারের (এএলআরসি) দেয়া রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এএলআরসি’র প্রতিনিধি জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের অধিবেশনে এই প্রশ্ন তুলে ধরে বলা হয়েছে, সরকারের দাবী অনুসারে যদি জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই সাধারণ মানুষের বাস্তব জীবনের উন্নয়নের নির্দেশক হতো তাহলে কনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের হাজার হাজার তরুণ যুবক দেশ ত্যাগ করে নৌকায় চড়ে বিপদসঙ্কুল ভ’মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের পথে পা বাড়ায়?

গত কয়েক বছরে ভ‚মধ্যসাগরে অবৈধ অভিবাসি বহনকারি যতগুলো নৌকা বিপদসঙ্কুল অবস্থায় ধরা পড়েছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশি নাগরিকদের নাম উঠে এসেছে। থাইল্যান্ডের জেলে পল্লিতে এবং গভীর জঙ্গলে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি হয়ে যাওয়া এবং অনাহারে ও পাশবিক নির্যাতনে গণকবরে ঠাঁই পাওয়া হতভাগ্য বাংলাদেশিদের কথাও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এরপরও ভ‚-মধ্যসাগরে, আরব সাগরে, ইতালির উপক‚লে, লিবিয়ার উপক‚লে যেখানেই অভিবাসন প্রত্যাশিদের নৌকা মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে বা কোস্টগার্ডের হাতে আটক হয়েছে, সেখানেই বাংলাদেশি যুবকদের দেখা গেছে। দেশ যদি অর্থনৈতিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, মানুষের আয়-রোজগারের পথ সুপ্রশস্ত হচ্ছে, তাহলে এমন অসংখ্য যুবক জীবন বাজি রেখে দেশ ছাড়তে চাইবে কেন? এই মুহুর্তে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কত হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক জেলখানা বা ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান মনে হয় বাংলাদেশের কোনো সংস্থার হাতেই নেই। চলতি বছরের প্রথমদিকে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারাগারে আটক বাংলাদেশির সংখ্যা ১৫ হাজারের বেশি। বিদেশ গমনের হার না বাড়লেও গত ৮ বছরে বিদেশের কারাগারে আটক বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে তিনগুনের বেশি। ৪২টির বেশি দেশে বিভিন্ন সংখ্যক বাংলাদেশি কারাভোগ করছেন। এসব দেশে অবৈধ বাংলাদেশির সংখ্যা ১০ লাখের বেশি বলে জানা যায়। বৈধ অবৈধ পথে বিদেশে যাওয়া শ্রমিকদের পাঠানো টাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ, রেমিটেন্স প্রবাহ এবং দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। এরা আমাদের রেমিটেন্স যোদ্ধা। দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থান না থাকায় ভিটামাটি বিক্রি করে, লাখ লাখ টাকা ধারদেনা করে বিদেশে গিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজের পরিবার ও দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা এই যোদ্ধারা যখন আইনগত কারণে বিদেশে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন, তাদের পক্ষে কেউই দাড়ায় না। হাজার হাজার প্রবাসীর জীবনে এ এক মর্মন্তুদ ইতিহাস। বছরের পর বছর ধরে হাজার হাজার বাংলাদেশি বিদেশের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে শৃঙ্খলিত অমানবিক জীবন পার করলেও রাষ্ট্রের পক্ষে দায়িত্বশীল সরকার, দূতাবাস তাদের জন্য তেমন কিছুই করছেনা। এমন অসহায়ত্ব নিয়েই লাখ লাখ (১০ লক্ষাধিক) কথিত অবৈধ বাংলাদেশি শ্রমিক বিদেশের মাটিতে আতঙ্কিত, পলাতক জীবন যাপন করছে। অত্যন্ত মানসিক চাপে এদের অনেকেই কর্মস্থলে হার্ট অ্যাটাকে মারা যাচ্ছে। ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গোতে প্রতিদিনই প্রবাসি শ্রমিকদের ১০-২০টি লাশ আসছে। সে সব লাশ আনতে গিয়েও স্বজন হারা মানুষদের অশেষ ভোগান্তির শিকার হতে হয়। জমিজিরাত. গরুবাছুর, ঘর-গাছ বিক্রি করে ৫-১০ বছর প্রবাসে শ্রম দিয়ে দেশে ফেরার সময় শ্রমিকদের অনেকে বিমানবন্দরের এক শ্রেণীর কর্মচারী-কর্মকর্তা এবং বাইরে ওত পেতে থাকা প্রতারক-ছিনতাইকারীদের কাছে সবকিছু খুইয়ে প্রায় নি:স্ব হয়ে বাড়ি ফেরার ঘটনাও ঘটছে। এক শ্রেণীর মানুষ ক্ষমতার জোরে অথবা প্রতারণার কৌশলে রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছে। এসব দেখে দেখে এ দেশের যুবক - তরুণদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা এবং স্বদেশ সম্পর্কে এক প্রকার বিরূপ মনোভাব তৈরী হওয়ার পাশাপাশি উন্নত ও নিরাপদ জীবনের আশায় তারা যেন তেন প্রকার দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করে অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমায়। আরেক শ্রেণীর মেধাবি তরুন দেশের সরকারী বেসরকারী কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে পরিবারের হাল ধরতে, মা বাবার স্বপ্ন পুরণের জন্য একটা ভাল চাকুরীর জন্য হণ্যে হয়ে ঘুরছে বছরের পর বছর ধরে। এদের মধ্যে স্বল্প সংখ্যক তরুণের ভাগ্যে সরকারী-বেসরকারী প্রত্যাশিত চাকুরী জুটছে গোপণ পথে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি থেকে শুরু করে সরকারী চাকরি পেতে মেধাবী তরুণরা যাদের হাতে লাখ লাখ টাকা তুলে দিচ্ছে তাদের অনেকেই ক্ষমতার চোরাই পথে অবৈধভাবে ভর্তি হওয়া মেধাহীন সন্ত্রাসী। ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় অবৈধভাবে ভর্তি হওয়া তরুনদের অনেকেই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিভিন্ন পদসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসুর নেতৃত্ব পেয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে।

গত কয়েকদিন ধরে রাজধানীসহ সারাদেশে র‌্যাবের ক্যাসিনো অভিযানের মধ্য দিয়ে অবৈধ জুয়া, মদ ও অস্ত্র ব্যবসায়ী, টেন্ডারবাজ কমিশন বাণিজ্যের হোঁতাদের গুটি কয়েকজনের নাকানি চোবানি অবস্থা দেখা যাচ্ছে। সেই সাথে বেরিয়ে আসছে তাদের অন্ধকার জগতের চোখ ধাঁধানো সব রঙ্গমহল এবং শত শত কোটি টাকার ভান্ডার। কিছুদিন আগে একজন কারা পরিদর্শকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করতে দুদকের একটি টীম ঢাকায় তার বাসায় তল্লাশি চালাতে গেলে সেই সাবেক ডিআইজি প্রিজন টাকার বস্তা জানালা দিয়ে ফেলে দিতে গিয়েও ধরা খেয়েছিল। অবশেষে তার কাছ থেকে নগদ ৮০ লাখ টাকা উদ্ধার করে দুদকের টীম। ইতিপূর্বে চট্টগ্রামের কারা উপ মহাপরিদর্শকের লাখ লাখ টাকা এবং কোটি কোটি টাকার এফডিআর ডক্যুমেন্ট জব্দ করেছিল গোয়েন্দা পুলিশ। সে সময় এ নিয়ে বেশ হইচই উঠেছিল। এখন চাঁদাবাজ ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাসিনো মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, এদের তুলনায় সে সব পুলিশ কর্মকর্তাদের সম্পদ নস্যি। তবে কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের খবরও ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনের প্রভাবশালী নেতাদের বাড়ি অফিস তল্লাশি চালিয়ে কোটি কোটি টাকা জব্দ এবং গ্রেফতার রিমান্ডের সম্মুখীন হলেও প্রশাসনের রাঘব বোয়াল, রুই-কাতলাদের তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে এবারের অভিযানের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নগদ ১০ কোটি টাকা ঘুষের অফার অগ্রাহ্য করেই জিকে শামীমের বাড়ি ও অফিসে তল্লাশি চালিয়েছে র‌্যাব। র‌্যাবের অভিযানে কয়েকজন যুবলীগ নেতাকে ধরার পর যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী প্রশ্ন রেখেছেন, বছরের পর বছর ধরে এসব ক্যাসিনো চললেও এতদিন তাদের ধরা হয়নি কেন? এখানে যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশ থাকে তাহলে তাদেরকেও বিচারের আওতায় আনা হোক। ওমর ফারুক চৌধুরী যে ক্ষেদ থেকেই এসব কথা বলুন না কেন, তার এই দাবীকে অগ্রাহ্য করা যায় না। তবে কেন কিভাবে এসব ক্যাসিনো, মাদক ব্যবসায়, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও কমিশন ব্যবসায় চলছিল তার একটা স্বচ্ছ খন্ডচিত্র ইতিমধ্যেই বেরিয়ে এসেছে। সরকারী কাজের টেন্ডার বাগিয়ে নিতে জি কে শামীম মাসে প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয় করতেন বলে জানা যায়। প্রশাসনের নি¤œ পর্যায়ের স্থানীয় কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন আমলা এবং মন্ত্রী পর্যন্ত এ টাকার ভাগ পেতেন। সরকারী বেতন স্কেল অনুসারে যে লোকটির মাসিক বেতন ৪০-৫০ হাজার টাকা সে যদি কারো কাছ থেকে মাসে ৫-১০ লাখ টাকা পায় এবং অর্থদাতা যদি সরকারের মন্ত্রী আমলাদের আস্থাভাজন হন, তাহলে সে তো তার কথায়ই চলবে! এভাবেই জিকে শামীম হয়ে উঠেছেন সরকারী কাজের ঠিকাদারি ও কমিশন বাণিজ্যের অন্যতম স্তম্ভ। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাদক ও জুয়ার ব্যবসায় থেকে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া ব্যক্তিরা মূলত সরকারী দলের ও অঙ্গদলের নেতা, উপনেতা, পাতিনেতা। এরা ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটি থেকে শুরু করে রাজধানী শহরের কেন্দ্রীয় কমিটি পর্যন্ত বিস্তৃত। ঢাকায় ক্যাসিনো অভিযানের ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের ক্লাব পাড়ায় হানা দিতে শুরু করেছে র‌্যাব। এরই মধ্যে অবশিষ্ট সকলে সচেতন হয়ে গেছে, কেউ কেউ হয়তো আত্মগোপণে চলে গেছে। তবে যে সব তথ্য এরই মধ্যে উঠে এসেছে, তা সরকারী দলের বেশকিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সংগঠনের জন্য রীতিমত শাসরুদ্ধকর। চট্টগ্রামের একজন পুলিশ কর্মকর্তা নিজের চাকুরী জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়া এক পোস্টে লিখেছেন, চট্টগ্রাম আবাহনী ক্লাবের মহাসচিব, আওয়ামীলীগের সংসদ সদস্য এবং জাতীয় সংসদের হুইপ শামসুল হক চৌধুরী শুধুমাত্র জুয়ার আসর থেকে গত ৫ বছরে কমপক্ষে ১৮০ কোটি টাকা আয় করেছেন। যদি ক্লাবের জুয়ার আসর থেকেই বছরে প্রায় ৪০ কোটি টাকা আয় হয়, টেন্ডারবাজি, কমিশন বাণিজ্য থেকে তার আয় কত তা সহজেই অনুমেয়। পুলিশ পরিদর্শক সাইফ আমিনের লেখায় একটি থানা ও সংনদীয় এলাকায় ওসি ও সংসদ সদস্যের দৈনিক, মাসিক ও বার্ষিক আয়ের খাতগুলোর প্রাঞ্জল বর্ণনা উঠে এসেছে। যদিও সব স্থানের অবস্থা সমান নয়, মাদক, দেহব্যবসায়, জুয়া চাঁদাবাজি-তোলাবাজি এবং অপরাধ জগত থেকে একেকজন সংসদ সদস্য ও মাঠ পর্যায়ে থানার ওসির আয় মাসে কোটি কোটি টাকা। তবে সংসদ সদস্য ও এসপি ওসিদের বাইরে সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতাসীন দল ও অংগ সংগঠনের পদ পদবী যেন আলাদিনের চেরাগে পরিনত হয়েছে।

গত ১০ বছরে দেশ থেকে অন্তত ৬ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ চীন কিংবা ভারতকে টপকাতে না পারলেও এবং রফতানী বাণিজ্যে প্রায় লক্ষকোটি টাকার ঘাটতি সত্বেও অতি ধনী লোকের সংখ্যা বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ বিশ্বের এক নম্বর স্থান দখল করেছে। এসব নিয়ে দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় অনেক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। শেয়ার বাজার, ব্যাংক জালিয়াতি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুইফ্ট কোড হ্যাক, পণ্যমূল্য বৃদ্ধির সিন্ডিকেট, মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুন্ঠনের সাথে জড়িত রুই-কাতলাদের পদাঙ্ক অনুসরণে করছে প্রায় সব স্তরের দলীয় নেতা-কর্মীরা। ছাত্রলীগ-যুবলীগের থানা পর্যায়ের নেতৃত্ব থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি পর্যন্ত পদ পাওয়া একশ্রেনীর নেতাকর্মীর অর্থনৈতিক উত্থানের চিত্র কল্প-কাহিনীকেও হার মানায়। এরা সবাই এক সময় জি কে শামীম বা ইসমাঈল স¤্রাট বা কাজী আনিসুর রহমানের মত শত শত বা হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এ কারণেই সরকারী দলের আভ্যন্তরীণ কোন্দল অনেক বেশি মারমুখী, বেপরোয়া, রক্তক্ষয়ী ও প্রাণঘাতী বেসরকারী মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের(আসক) প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৭ সালের জানুয়ারী থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আওয়ামীলীগের আভ্যন্তরীণ ১৫০টি সংঘর্ষের ঘটনায় প্রায় আড়াই হাজার(২৪৬৬জন) নেতাকর্মী আহত হয়েছেন, নিহত হয়েছেন ২৯ জন। আসকের রিপোর্ট অনুনারে, এর আগের বছর দেশে রাজনৈতিক সংঘাতে ১৭৭ জন নিহত হয় এর মধ্যে আওয়ামীলীগের ৮৩জন। এদের মধ্যে বড় অংশই আওয়ামীলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হয়েছেন। নেতাকর্মীদের হাতে যত বেশি নগদ অর্থসমাগম ও প্রতিপত্তি বেড়েছে, দলীয় পদের জন্য মরিয়া প্রতিযোগীতা এবং আধিপত্যের লড়াইও তত জোরালো হয়েছে। অবৈধ অর্থের সাথে সাথে যুক্ত হয়েছে ক্যাডার বাহিনী, অবৈধ অস্ত্রের ভান্ডার, মাদক ও জুয়ার আসর। এসব প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ঠাঁট ধরে রাখতে উপর মহলের নিরব সমর্থনে প্রশাসনের কর্মকর্তা, এসপি, ওসি ও র‌্যাব কর্মকর্তারাও সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে। এটি শুধু এই সরকারের আমলেই ঘটেনি, সাবেক সব সরকারের আমলেই এই চক্র সক্রিয় ছিল। ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে দলীয় পরিচয় ও পৃষ্ঠপোষকদের নামের পরিবর্তন ঘটেছে মাত্র। তবে অতীতে আর কখনো মাদক, জুয়া, নারী ধর্ষণ, গুম-খুন, টেন্ডারবাজি, কমিশন বানিজ্য, চাঁদাবাজি এমন সর্বব্যাপী আতঙ্কে পরিনত হয়নি। রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আর কখনো এতটা দলীয় বাহিনীতে পরিনত হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আর কখনো এমন গুম-খুন ও ভাড়াটে বাহিনীর ভুমিকার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হয়নি। জনগণের রাজস্বে পরিচালিত উন্নয়ন বাজেট থেকে, সরকারী ক্রয়খাত থেকে এবং টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, কমিশন বাণিজ্য, ব্যাংক লুটের টাকা এতটা ক্যাসিনো ও মদের আসরে সয়লাব হতে দেখা যায়নি।কমিশন ও ঘুষের বিনিময়ে নিয়ন্ত্রিত টেন্ডারবাজি এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল অবকাঠামো নির্মিত হচ্ছে বাংলাদেশে। এভাবেই জনগণের সম্পদ গুটি কতেক লুটেরার হাতে লুণ্ঠিত হচ্ছে। জি কে শামীম, খালেদ মাহমুদ, নুরুন্নবী শাওন, ইসমাইল স¤্রাট, আনিসুর রহমানরা দেশে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠেছে। রাজধানীতে দু’চারজনকে ধরলেই অবস্থার স্থায়ী পরিবর্তন আসবে না। রাজনৈতিক আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে এবং প্রশাসনিক দলীয়করণের মধ্য দিয়ে সারাদেশে অসংখ্য তুফান সরকারম বদরুল, নয়ন বন্ডরা বেড়ে উঠেছে। এসব বেপরোয়া হন্তারকদের ধরতে হবে। স্বাধীনতার পর থেকেই গড়ে ওঠা এই লুটেরা চক্র ভেঙ্গে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে নির্দেশ দিয়েছেন, পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা দেশের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করেছে। কিন্তু ফুটপাথ ও নদী দখল ও ভেজাল বিরোধী অভিযানের মত ক্যাসিনো, মাদক ও টেন্ডারবাজ বিরোধি অভিযান যেন শেষ পর্যন্ত লোক দেখানো ইঁদুর-বিড়াল খেলা হয়ে না দাঁড়ায় সে বিষয়ে সরকারের সর্বোচ্চ মহলকে দৃঢ় ও সচেতন থাকতে হবে। যদিও আইনের শাসন এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুন:প্রতিষ্ঠা ছাড়া সত্যিকার অর্থে ইতিবাচক সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তন সম্ভব নয়।

[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন