পশ্চিম তীরে সহিংসতা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ
জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকে তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনের
গত ৫ আগস্ট ভারতের রাষ্ট্রপতি দেশটির সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫-ক ধারা অকার্যকর করে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ও সুবিধা রহিত করে দিয়েছেন। এর আগে ভারতের রাজ্যসভা ও লোকসভায় এসংক্রান্ত বিল পাস হয়। ক্ষমতাসীন বিজেপির পক্ষ থেকে বিলটি পেশ করা হয়। তেমন কোনো আলোচনা বিরোধিতা ছাড়াই বিলটি অনুমোদিত হয়। সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫-ক ধারার বিরুদ্ধে শুরু থেকেই কঠোর অবস্থানে ছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ ও তার অনুসারী দল সংগঠনগুলো। কিন্তু এতদিন তাদের পক্ষে সংবিধান থেকে ধারা দুটি রদ করা সম্ভব হয়নি। বিগত নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের রাজনৈতিক শাখা বিজেপি বিপুলসংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হলে এই সুযোগটি তাদের এসে যায়। যা কাজে লাগাতে তারা এতটুকু বিলম্ব করেনি।
৩৭০ ধারাটি সংবিধানভুক্ত হয় ১৯৪৯ সালে। তবে তা আগে ছিল ৩০৬ ধারার আকারে। ১৯৫২ সাল থেকে এটি ৩৭০ ধারা হিসাবে পরিগণিত। এই ধারা মোতাবেক, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ও পররাষ্ট্র এবং মুদ্রাসংক্রান্ত বিষয় ব্যতীত রাষ্ট্র পরিচালনার বাকী বিষয়গুলোকে কাশ্মীর সরকারের সর্বৈব কর্র্তৃত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়। ভারত সরকার এসব বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে কাশ্মীরের বিধান সভার সম্মতির ভিত্তিতে নেয়ার বিধান রাখা হয়। আইনবিদদের মতে, এই ধারা তুলে কাশ্মীরকে ভারতীয় সংবিধান মান্য করার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত করে দেয়া হয়। এছাড়া কাশ্মীরের ওপর ভারতের ক্ষমতা ও কর্র্তৃত্ব সীমিত এবং কাশ্মীরের সরকার ও বিধান সভাকে শক্তিশালী করা হয়। কাশ্মীরকে এই ধারা বলে রাজ্য হিসাবে বিশেষ মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী হিসাবে স্বীকার করে নেয়া হয়। শুধু তাই নয়, কাশ্মীরের একটি আলাদা সংবিধান, নিজস্ব পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীতের অধিকার মান্য করে নেয়া হয়। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় কাশ্মীরের এই বিশেষ মর্যাদা ও সুবিধার স্বীকার করে নেয়ার পেছনে কাশ্মীরের ডোগরা মহারাজা হরিসিং ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর মধ্যে স্বাক্ষরিত অ্যাকসেশন চুক্তি নিয়ামক ভূমিকা রাখে। ওই চুক্তিতে বর্ণিত চারটি বিষয় ছাড়া অন্যসব বিষয়ে কাশ্মীর সরকার ‘স্বাধীন’ থাকবে এই অঙ্গীকার ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। স্মরণ করা যেতে পারে, কাশ্মীর এই মর্যাদা ও সুবিধা ব্রিটিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানী ও ব্রিটিশ সরকারের কাছে থেকেও ভোগ করতো। পূর্ব নজির অনুযায়ী, এ মর্যাদা ও সুবিধা কাশ্মীরের পাওনা ছিল। ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারার ভিত্তিভূমি ইতিহাসের এই পারম্পর্যের ওপরই প্রতিষ্ঠিত। হরিসিং-নেহেরু অ্যাকসেশন চুক্তির বিষয়াবলী বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, কথিত চারটি বিষয়ই কেবল কাশ্মীর ভারতের হাতে ন্যস্ত করা হয়। এমতক্ষেত্রে স্পষ্ট বুঝা যায়, কাশ্মীর ভারতের অংশ নয় বা তার সংবিধান মেনে চলতেও বাধ্য নয়।
ভারতের সংবিধানে ৩৫-ক ধারাটি সংযোজিত হয় ১৯৫৪ সালে। ধারাটি ৩৭০ ধারার সঙ্গে অত্যন্ত সঙ্গতিপূর্ণ। এ ধারায় কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দা হিসাবে কারা স্বীকৃত হবে তা নির্ধারণের একক কর্তৃত্ব দেয়া হয় রাজ্য বিধান সভাকে। এ ধারা বলে রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দারা সম্পত্তির মালিকানা, সরকারী চাকরি এবং ভোটাধিকার ভোগ করার অধিকার লাভ করে। এছাড়া কাশ্মীরবহির্ভূত লোকদের প্রবেশ ঠেকাতে এ বিধান বিশেষভাবে কার্যকর বলে পরিগণিত হয়। এমন কি রাজ্যের কোনো নারী রাজ্যবহির্ভূত কোনো পুরুষের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে সম্পত্তির ওপর তার কোনো অধিকার থাকবে না বলে বিধান করা হয়।
ভারতীয় সংবিধানে প্রদত্ত মর্যাদা, স্বাতন্ত্র্য ও সুবিধা কাশ্মীরি জনগণ ও রাজ্য এযাবৎ কতটা ভোগ করতে পেরেছে তা নিয়ে এক হাজার একটা প্রশ্ন উঠতে পারে। করোই সন্দেহ নেই, এক্ষেত্রে কাজীর গরু কেতাবে থাকলেও গোয়ালে নেই। অ্যাকসেশন চুক্তি কিংবা সংবিধান বর্ণিত অধিকার কোনোটাই কার্যকর হয়নি। বলা বাহুল্য কাশ্মীর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সামরিক উপস্থিতির এলাকা হিসাবে পরিচিত। অনেক দিন ধরেই এ অবস্থা বিরাজ করছে। বিপুল সংখ্যক সেনার পাশাপাশি আধা সামরিক বাহিনীর হাজার হাজার সদস্য ও পুলিশ সেখানে সর্বক্ষণ মোতায়েন রয়েছে। প্রতি ৫-৬ জন কাশ্মীরি নাগরিকের বিপরীতে ১জন সশস্ত্র নিরাপত্তা রক্ষী সেখানে রয়েছে। বিশ্বের আর কোথাও এ ধরনের বাস্তবতা বিদ্যমান নেই। বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের এরূপ উপস্থিতি কাশ্মীরিদের নিরাপত্তা সুরক্ষার জন্য নয়। তাদের দমন-দলন, জুলুম-নির্যাতন, হত্যা-গুপ্তহত্যা ইত্যাদির জন্যই বস্তুত তাদের নিয়োজিত রাখা হয়েছে। কাশ্মীরি জনগণ ভারতীয় সামরিক আগ্রাসনের মুখে অনিরাপদ জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে তাদের জান-মালের, সম্ভ্রম ও মর্যাদার কোনো নিরাপত্তা নেই। কখন যে কার জান চলে যাবে, মাল লুণ্ঠিত হবে এবং মান-মর্যাদা মাটির সঙ্গে মিশে যাবে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। যুবক ও নারীরা সেখানে সবচেয়ে বেশী অনিরাপত্তার শিকার। এক হিসাবে জানা যায়, গত ৩০ বছরে অন্তত ৯০ হাজার কাশ্মীরি ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছে। অত্যাচার নির্যাতনের পরিমাণ তো লেখাজোখা নেই। অত্যাচার-নির্যাতনের লোম হর্ষক বিবরণ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ভারতীয় সংবিধানে প্রদত্ত মর্যাদা ও অধিকার কাশ্মীরিদের জন্য প্রতারণা ও প্রহসন হিসাবেই কার্যত বিবেচ্য হয়েছে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে কাশ্মীরের তুলনা, করে দেখলেই বুঝা যাবে, কাশ্মীরকে ‘শত্রুভূমি’ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। যে কোনো মূল্যে ওই ভূমি কুক্ষিগত করে রাখাই একমাত্র লক্ষ্য হিসাবে নির্বাচন করা হয়েছে। দেখা যাবে, আর কোনো রাজ্যে এরূপ সামরিক উপস্থিতি নেই, এরূপ দমন-পীড়ন, হত্যা-গুপ্তহত্যা নেই। এত মানুষ কোথাও নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীরের ওপর যত হস্তক্ষেপ করেছে, তা আর কোনো রাজ্যে করেনি। সেখানে যখন তখন সরকার বাতিল করে দেয়া হয়েছে। এভাবে দীর্ঘকাল কেন্দ্রীয় শাসন বলবৎ রাখা হয়েছে। অনেক বলে থাকেন, কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনী মানবাধিকারে লংঘন করে যেভাবে দায়মুক্তি পেয়েছে বিশ্বের ইতিহাসে তার নজির খুব বেশি নেই।
এত কিছু সত্তে¡ও ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫-ক ধারা কাশ্মীরি জনগণের কাছে এক ধরনের আশা ও সাত্ত¡নার উপলক্ষ ছিল, ক্ষীণ হলেও আশা ছিল, হয়তো কখনো সংবিধানে বর্ণিত মর্যাদা ও সুবিধা তারা লাভ করতে পারবে। তখন হয়তো তাদের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য তুল্যমূল্য পাবে, নিরাপদ হবে। গত ৫ আগস্ট সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫-ক ধারা বাতিল করে কাশ্মীরি জনগণের এই আশা ও সান্ত¦নার উপলক্ষটাও ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। তাদের হতাশ করে দেয়া হয়েছে। ভারত শুরু থেকেই কাশ্মীরকে ভারতভুক্ত করার বা ভারতের অংশ করে নেয়ার চেষ্টা করে আসছে। মূল লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্যই বাস্তবতা ও কৌশলগত কারণে ভারতের শাসকরা সংবিধানে ৩৭০ ও ৩৫-ক ধারার মত ধার-সংযোজন করেন। এখন এই দুটি ধারা বাতিল করে তারা তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যে উপনীত হয়েছেন বলে মনে করছেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।