পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিএনপির আবেগ, ভালোবাসা আর হৃদয় হয়ে প্রানের গহীনে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। আক্ষরিক অর্থে সর্ববৃত্তে বিএনপির ভ্যানগার্ড হয়ে আছে ছাত্রদলের অবয়ব। আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অপরিমেয় স্বপ্নে বিমূর্ত হয়ে আছে তারুণ্যের প্রতিভ‚ ছাত্রদল। তিনি চেয়েছিলেন, তরুণ মেধাবী ছাত্ররা নিজেদের মেধা, মনন ও যোগ্যতা দিয়ে রাজনীতিকে ঋদ্ধ করবে। হয়ে উঠবে জাতির যোগ্য-সাহসী কান্ডারী। ছাত্র রাজনীতির মধ্যদিয়ে নিজেদেরকে অভিজ্ঞ, উপযুক্ত ও নিখাঁদ করে জাতীয় রাজনীতির বিকাশ ঘটাবে। তিনি বিশ্বাস করতেন, সৎ, সাহসী, শিক্ষিত, নিষ্ঠাবান পরীক্ষিত দেশপ্রেমী ছাত্র নেতাদের হাতে যখন এই বাংলাদেশ থাকবে, থাকবে জাতীয় রাজনীতি তখন বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য দ্রæত উন্নতির দিকে ধাবিত হবে। জাতীয় রাজনীতিতে আসবে কাক্সিক্ষত গুনগত পরিবর্তন। আর এ লক্ষে-বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের পুরধা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ২৮ ফেব্রæয়ারী বুধবার গঠন করেন জাগদলের ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী গনতান্ত্রিক ছাত্রদল (জাগ ছাত্রদল)। আহমেদ মির্জা খবিরকে আহŸায়ক করে ১০১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি করা হয়। যুগ্ন আহŸায়ক ছিলেন- মিয়া শহীদ হোসেন, গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক, আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, রশীদ চৌধুরী প্রমুখ। বিএনপি গঠিত হবার পর জাগ ছাত্রদল বিলুপ্ত করে গঠন করেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারী সোমবার দেশের এক সন্ধিক্ষণে কাজী আসাদকে আহŸায়ক করে গঠন করা হয় জাতীয়তাবাদী ছাত্র দলের প্রথম কমিটি। শুরুতেই এই কমিটি ব্যাক্তি আশির্বাদ দোষে দুষ্ট হয়। বলা হয় কাজী আসাদ তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমানের নিজস্ব লোক ছিলেন। কমিটিতে তাদের নিজেদের পছন্দের বাইরে অন্যান্য জেলার তেমন কাউকে রাখা হয়নি। দ্রæতই ছাত্রদলের মধ্যে উপ কোন্দল শুরু হয়। পরবর্তিতে একই বছর আগস্ট মাসে ছাত্রদলের আহŸায়ক কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে এনামুল করিম শহীদকে সভাপতি এবং গোলাম হোসেনকে সাধারণ স¤পাদক করে একটি ‘মধ্যস্ততার’ কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির মধ্যদিয়ে বিলুপ্ত হয় ভাসানী ন্যাপ পন্থি ছাত্র সংগঠন ‘জাতীয় ছাত্রদলের’। জাতীয় ছাত্রদলের সদস্যদের সাথে একই সময় ছাত্রলীগের একটি অংশ ছাত্রদলে যোগ দেয়। কথা ছিলো মধ্যস্ততার এই কমিটি ডিসেম্বর ১৯৭৯ নাগাদ ছাত্রদলের সম্মেলন করবে। কিন্তু তিন মাস পার হয়ে গেলেও কোন অগ্রগতি না থাকায় কমিটি ভেঙ্গে দেয়া হয়। ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি গোলাম সারোয়ার মিলনকে আহŸায়ক করে ২১ সদস্যের একটি নুতন কমিটি গঠন করা হয়। সম্মেলনের জন্য এই কমিটিকে দেয়া হয় ৬ মাস সময়। কিন্তু ৬ মাস পার হলেও এই কমিটি সম্মেলন করতে ব্যর্থ হয়। যদিও তারা ১৯৮১ সালের মে মাসের শেষ নাগাদ সম্মেলনের একটি আন অফিসিয়াল তারিখ নির্ধারন করেছিলো। অত্যান্ত দুঃখজনকভাবে ৩০ মে ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শাহদাত বরন করেন। রাজনীতির নানা পট পরিবর্তনে থমকে দাড়ায় সম্মেলনের কার্যক্রম। পরবর্তিতে ৬ ডিসেম্বর ১৯৮১ সালে গোলাম সারোয়ার মিলনকে সভাপতি এবং আবুল কাশেম চৌধুরীকে সাধারণ স¤পাদক করে ছাত্রদলের পুর্নাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। শিক্ষা- ঐক্য- প্রগতি -ছাত্রদলের মূল নীতি। শুধু মাত্র এই ¯ে¬াগানেই কি মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে সকলে দলে দলে ছাত্র দলে যোগ দিয়েছিলো? মোটেই তা নয়, শুরুতে ছাত্রদলের পথ ছিলো অনেক কন্টকাকীর্ণ, অমসৃণ, ত্যাগ-তিতিক্ষায় দুর্গম। আজ যে ছাত্রদল, ইতিহাস বলে তার বীজ রোপিত হয়েছিলো ১৯৭৭ সালের নভেম্বর মাসে চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিটিউটের এক সভায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন আরিফ মইনুদ্দিন। পারিবারিক স¤পর্কে কর্নেল অলি আহম্মদ এবং তার ছিলো মামা-ভাগ্নে স¤পর্ক। আরিফ মইনুদ্দিনের মা বেগম তোফাতুন্নেসা ছিলেন চট্টগ্রাম নগর আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি ১৯৫৪ সালে পূর্ব বঙ্গ আইন সভার সদস্য এবং ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এমন এক পরিবারে বেড়ে ওঠা আরিফ মইনুদ্দিনকে জিয়াউর রহমানের কাছে নিয়ে এসেছিলেন কর্নেল অলি। মায়ের অনুমতি নিয়ে আরিফ মইনুদ্দিন জিয়াউর রহমানের নতুন দল গঠন প্রক্রিয়ায় নিজেকে স¤পৃক্ত করেন। তিনিই প্রথম জিয়াউর রহমানকে একটি স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘নো নো, আই ওয়ান্ট দেম স্টাডি, ডোন্ট ডিস্টার্ব দেম। ট্রাই টু অরগানাইজ দ্যা ইয়ুথ অফ ইওর এরিয়া হু ক্যান সার্ভ দ্যা কান্ট্রি।’ সিদ্ধান্ত হয় আরিফ মইনুদ্দিন চট্টগ্রামে একটি ‘ইয়ুথ অর্গানাইজেশন’ গড়ে তুলবেন। ১৯৭৭ সালের নভেম্বর মাসে চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিটিউটে জিয়াউর রহমানের ততকালীন উপদেষ্টা জামালউদ্দিন আহমেদ একটি সভা ডাকেন। সভায় আরিফ মইনুদ্দিন এবং ফজলে করিম চৌধুরী কিছু ছাত্র নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। সভায় সিদ্ধান্ত হয় চট্টগ্রামে একটি র্যালী করার। সুষ্ঠুভাবে র্যালী আয়োজনে সে সময় যারা সহযোগিতা করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন- ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া চৌধুরী) আনোয়ারুল কাদরী, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের ওসমান গনি, জাসদ ছাত্রলীগের সিরাজুল ইসলাম, তারেক আহমেদ চৌধুরী, শাহজাহান চৌধুরী প্রমুখ। পত্রিকার মতে, প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষের বিশাল র্যালী হয়েছিলো। কিন্তু জিয়াউর রহমান সেই র্যালীতে আসেননি। এসেছিলেন, বিচারপতি আব্দুস সাত্তার ও তথ্য উপদেষ্টা শামসুল হুদা চৌধুরী। গ্রামে গঞ্জে দেশের মানুষের মাঝে দেশ প্রেম জাগিয়ে তুলতে, কর্মমুখর করে গড়ে তুলতে, মানুষের দুই হাতকে কাজে লাগাতে, গ্রাম গ্রামান্তরের মেঠো পথে জিয়াউর রহমান দুই হাত প্রসারিত করে হেঁটে চলেছেন। কিন্তু কেন চট্টগ্রামের র্যালীতে তিনি এলেন না তা ছিলো একটি বড় প্রশ্ন। বিভিন্ন জার্নাল ও বইয়ের আলোকে ধারনা পাওয়া যায়, র্যালীতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচুর ছাত্র যোগ দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান তখনও চাননি ছাত্র-ছাত্রীরা লেখাপড়া শেষের আগেই রাজনীতিতে আসুক। পরবর্তিতে মওলানা ভাসানী সহ অন্যান্যের পরামর্শে এবং মওলানা ভাসানী যখন তার দলের প্রতীক ধানের শীষ এবং তার ছাত্র সংগঠন ‘জাতীয় ছাত্রদল’ উপহার স্বরূপ জিয়াউর রহমানের হাতে তুলে দেন তখন জিয়াউর রহমান সিদ্ধান্ত নেন ছাত্রদের জন্য বিএনপির একটি ছাত্র শাখা প্রতিষ্ঠার। ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারী অফিশিয়ালী ছাত্রদল জন্ম নেয়। কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমান হন ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টা। একই বছর ২৬ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভু-তত্ত¡ বিভাগের শিক্ষক ডঃ খন্দকার মোশারফ হোসেনকে বিএনপি ছাত্র বিষয়ক স¤পাদক মনোনীত করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছত্রদলকে শুরুতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তবে ছাত্রদলের যাত্রার আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জাগ ছাত্রদল’ কিছুটা ক্ষেত্র তৈরী করে রেখেছিলো। জাগ ছাত্রদল তাদের প্রথম মিছিল করেছিলো সূর্যসেন হলের গেইট থেকে মধুর ক্যান্টিন পর্যন্ত। শ’ খানেক ছাত্রের সেই মিছিলের ওপর হামলা করেছিলো জাসদ ছাত্রলীগ। মাহমুদুর রহমান মান্না তখন জাসদ ছাত্রলীগের সবচেয়ে জনপ্রিয় ছাত্র নেতা। ইতিহাস বলে, জাগ ছাত্রদলের সেই মিছিলে আর্টস বিল্ডিংয়ের পাশ থেকে গুলি ছুঁড়ে মিছিলরত ছাত্রদের কয়েক জনকে আহত করা হয়। তবে থেমে যায়নি জাগ ছাত্রদল। বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা বেশ কদিন মিছিল করেছিলো। বিভিন্ন হলে প্রবেশের চেষ্টা করেছিলো এমন পরিস্থিতিতে জাগো ছাত্রদল বিলুপ্ত হয়ে, জাতীয় ছাত্রদল, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্রলীগ ছেড়ে আসা কিছু ছাত্র নিয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের যাত্রা শুরু করে। শুধু মাত্র জিয়াউর রহমানের ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দলে দলে ছাত্র-ছাত্রীরা ছাত্রদলে যোগ দিতে থাকে। দ্রæতই গোটা বাংলাদেশের বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের মজবুত অবস্থান তৈরী হয়। মাত্র আড়াই বছরেই দেশের বিভিন্ন কলেজ বিশব্বিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে ছাত্রদল নির্বাচিত হয় নিরঙ্কুশভাবে। ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল একটি আসনও পায়নি তবে ৫টি হলে কিছু আসনে জয় লাভ করে। ১৯৮১ সালে ডাকসুতে ১টি সদস্য পদে জয়ী হয়েছিলো। জগন্নাথ হল এবং ইকবাল হল ( বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাড়া সব কটি হলে কম-বেশী বিভিন্ন পদে বিজয়ী হয়েছিলো ছাত্রদল। ১৯৮২ সালে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল এ জি এস, সমাজসেবা স¤পাদক সহ প্রায় প্রতিটি হল সংসদে মোট ৫৭ টি পদে জয় লাভ করে। পরবর্তিতে বেগম খালেদা জিয়ার আপোষহীন নেতৃত্বের গুণে অল্প সময়ের ব্যাবধানে ছাত্রদল দেশের সব থেকে বড় ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয়। (চলবে)।
লেখকঃ সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক সহকারী প্রেস সচিব, সাবেক ছাত্রদল কর্মী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।