Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অবরুদ্ধ কাশ্মীরে আধার আইডি কার্ডও নির্যাতনের হাতিয়ার

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

গভীর রাতে ৭৩ বছর বয়স্কা সারভা বেগম, তার স্বামী ও তার ভাই খুব সতর্কভাবে আপেল আর আখরোট বাগানের জন্য বিখ্যাত তাদের শহর সপরে থেকে একটি ট্যাক্সিতে চড়লেন। পুলিশের প্রতিবন্ধকতাসহ নানা বাধাবিপত্তি এড়িয়ে পরিবার নিয়ে ভোর ৭টায় সারভা বেগম শ্রীনগরের উপকণ্ঠে পৌঁছালেন। তিনি স্থানীয়দের কাছে সাহায্য চাইলেন শ্রীনগরের কেন্দ্রীয় কারাগারের রাস্তাটি ট্যাক্সি চালককে দেখিয়ে দেয়ার জন্য। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার অনুচ্ছেদ বাতিলের তিন দিন পর ৮ আগস্ট নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কর্মরত তার ছেলেকে সপর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তার পরিবারের ভাষ্য হলো, আরিব তখন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ দেখছিলেন। তখনই পুলিশের একটি গাড়ি এসে তাকে নিয়ে যায়। তাকে তিন দিন স্থানীয় থানায় রাখা হয়েছিল। তারপর তাকে শ্রীনগরের কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।

একমাত্র ছেলেকে দেখতে বেপরোয়া সারভা তার স্বামী ও ছোট ভাইকে অনুরোধ করেন তার সঙ্গী হতে। পরিবারটি ভোর রাত ৪টায় ক্যাবে চড়ে। কেন্দ্রীয় কারাগারে যাওয়ার পথে তারা সেনাবাহিনীর বাংকার, বেরিকেড, পোড়া টায়ার, কাঠের বøক পাড়ি দেন। গন্তব্যের কাছাকাছি হতে শ্রীনগরের পুরনো এলাকায় অজ্ঞাত পরিচয় কিছু লোক তাদের দিকে পাথর নিক্ষেপ করে। ক্যাবটিকে বাধা দেয়া হয়, সারভা ও তার স্বামীকে বিদ্রæপ করা হয় নির্জন রাস্তা দিয়ে ‘নির্লজ্জভাবে’ চলাচলের জন্য। পরিবারটি এক ক্ষুব্ধ তরুণকে জানান, তারা কেন্দ্রীয় কারাগারে যাচ্ছেন পাথর নিক্ষেপের অভিযোগে ১২ দিন ধরে আটক তাদের ছেলেকে দেখার জন্য।

ছয় ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও পরিবারটিকে তাদের ছেলের সাথে সাক্ষাত করতে দেয়া হয়নি। পরে অবশ্য তার স্বামী ও ছোট ভাইকে ভেতরে প্রবেশ করার সুযোগ দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সারভাকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি তার কাছে পরিচয়পত্র তথা আধার কার্ড না থাকায়।
তিনি জানতে চাইলেন, এর মানে আমি তার সাথে দেখা করতে পারব না? কে জানে তাকে কাশ্মীরের বাইরে অন্য কোনো কারাগারে পাঠানো হবে না? এই গোলযোগের সময় আমি কীভাবে আধার কার্ড পাব?

তিনি দেখতে পেলেন, আরো কয়েকজন মাকেও আধার কার্ডের জন্য তাদের সন্তানদের সাথে দেখা করতে দেয়া হয়নি।
আরেক মা সারভাকে সান্ত¡না দিয়ে বললেন, আপনি কি জানেন, একটি পুরো পরিবারকে কারাগারে তাদের সন্তানের সাথে দেখা করতে দেয়া হয়নি তাদের সাথে আধার কার্ড না থাকায়?
ভাগ্য ভালো ছিল জুনি বেগমের। দক্ষিণ কাশ্মীরের কুলগাম থেকে আসার সময় তিনি আধার কার্ডও সাথে এনেছিলেন। তিনি ছেলের সাক্ষাত পেয়েছিলেন। কিন্তু তবুও তিনি সান্ত¡না পাচ্ছিলেন না।

জুনি বেগম বলেন, তার ছেলে তাকে দেখেই কাঁদতে শুরু করে দিলেন। সে মাকে কয়েকবার জড়িয়ে ধরে। তার ভয়, তাকে অন্য কোনো কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হবে, তার বিরুদ্ধে কঠোর কোনো অভিযোগ আনা হবে।
আমিনা বানু নামের আরেক মা কারাগারে প্রবেশ করার সুযোগ দিতে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে অনুনয় করে যাচ্ছিলেন। তার দুই ছেলেই কারাগারে। তার বড় ছেলে ইমরান নবি ওয়ানিকে গ্রেফতার করা হয় ২০১৭ সালের জুনে। এক পুলিশ অফিসারকে পেটানোর অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। আইয়ুব পÐিত নামের ওই অফিসার ক্রুদ্ধ জনতার হাতে পিটুনি খেয়েছিলেন শবে কদরের রাতে কাশ্মীরের প্রধান মসজিদের বাইরে দায়িত্ব পালনের সময়। পরদিন ইমরানকে তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার মামলাটি শ্রীনগরের নিম্ন আদালতে চলছে।

আমিনা বানুর ছোট ছেলে জুনাইদ নবি দার একটি মুদি দোকানে সেলসম্যানের কাজ করতেন। মাসে তার আয় হতো ৪০০০ রুপির কম। ঈদের আগের দিন ১১ আগস্ট বাড়ির বাইরে একটি বন্ধ দোকানের সামনে সে বসে বন্ধুদের সাথে গল্প করছিল। ওই সময় পুলিশ এসে তাকে নিয়ে যায়।
জুনাইদ সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে থাকে। বানু তার সাহায্যে ছুটে আসেন। কিন্তু কাজ হয়নি। তিনি সারা দিন কারাগারের বাইরে বসেছিলেন।
বানু বলেন, আমি বাড়ি গিয়ে কী করব? বাড়িতে কে আছে? সূর্য ডোবার পরই অজানা ভয় আমাকে জেঁকে ধরে। আমি ভয় পেয়ে যাই। আমার দুই ছেলেই জেলে। তাদের জীবন নিয়ে শঙ্কায় থাকি। কাশ্মীরের স্থানীয় পত্রিকা গ্রেটার কাশ্মীর সিনিয়র এক পুলিশ অফিসারের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কাশ্মীরের কিছু তরুণকে প্রতিরোধমূলক কারাগারে রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, এসব আটক সাময়িক ব্যাপার। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে। তবে যাদের বিরুদ্ধে পাথর নিক্ষেপ বা সমস্যা সৃষ্টির অভিযোগ পাওয়া যাবে, তাদের আটকে রাখা হবে। তাদের মামলাগুলোও পরের ধাপে পর্যালোচনা করা হবে। তিনি বলেন, আমরা আটক তরুণদের মা-বাবার কাছ থেকে সহায়তা চাই।

বিভিন্ন মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, কাশ্মীরের বিভিন্ন কারাগারে ৪ হাজারের বেশি তরুণ আটক রয়ছে। তবে ২৮ আগস্ট পুলিশ প্রধান দিলবাগ সিং সংবাদ সম্মেলনে প্রকৃত সংখ্যাটি জানাননি। তিনি অবশ্য বলেন যে, আটক তরুণদের বোঝানো হবে যে তারা যেন সহিংসতায় জড়িত না হন।
৫ আগস্ট ভারত সরকার কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার পর থেকে কাশ্মীর উপত্যকা সহিংসতায় জর্জরিত হয়ে আছে। ল্যান্ড ফোন, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট পরিষেবা এখনো বন্ধ রয়েছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে ৩০ দিন ধরে। সূত্র : এসএএম।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কাশ্মীর


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ