দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হযরত ওমর (রা:) নামাজে এত জোরে জোরে কাঁদতেন যে, তাঁর কান্নার আওয়াজ পেছনের কাতার হতেও শোনা যেত। (সহীহ বুখারী : কিতাবুস সালাত ও কিতাবুল (হিজরত) হযরত তামীমের দারী (রা:) এক রাতে তাহাজ্জুদের নামাজের জন্য দাঁড়ালেন। শুধুমাত্র একটি আয়াত পাঠেই সকাল হয়ে গেল। বার বার একই আয়াতকে পাঠ করছিলেন এবং এর মর্ম অনুভব করছিলেন। (উসদুল গাবাহ) হযরত আনাস (রা:) কিয়াম এবং সেজদার মাঝে এতই দেরী করতেন যে, মানুষ মনে করত যে, তিনি হয়ত কিছু ভুলে গেছেন। (সহীহ বুখারী) হযরত আবদুল্লাহ বিন যুবাইর (রা:) যখন নামাজে দাঁড়াতেন, তখন কয়েকটি সূরা পাঠ করে ফেলতেন এবং এমনভাবে দাঁড়াতেন যে মনে হতে যেন একটি স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে। আর যখন সেজদায় গমন করতেন, তখন এত দেরী করতেন যে, হেরেম শরীফের কবুতরগুলো তাঁকে সমতল স্তম্ভ মনে করে তাঁর পিঠের উপর বসে পড়ত। (ইসায়া ও উসদুল গাবাহ)
কোন এক রাতে যুদ্ধের ময়দানে একটি পাহাড়ী ঘাটিতে দু’জন সাহাবী পাহারার কাজে নিয়োজিত হলেন, তাদের একজন শুয়ে পড়তেন এবং দ্বিতীয়জন নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। দুশমনেরা তাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ করতো। তীর তাদের দেহ বিদ্ধ হয়ে কাপড় পর্যন্ত রক্তে সিক্ত হয়ে যেত, কিন্তুু নামাজের একাগ্রতার মাঝে কোন ব্যতিক্রম দেখা দিত না। এমতাবস্থায় নামাজ শেষ করে নিজের সঙ্গীকে জাগ্রত করতেন এবং ঘটনার কথা বিবৃত করতেন। সাথী বলতেন, তুমি কেন আমাকে জাগ্রত করনি? উত্তর দেয়া হত, আমি একিট প্রিয় সূরা পাঠ করছিলাম, তা শেষ না করা পর্যন্ত তা ছেড়ে দিতে আমার মন চাইছিল না। (আবু দাউদ : কিতাবুত তাহারাত) এর চেয়েও প্রাণস্পর্শী চিত্র হচ্ছে এই যে, দুশমনদের সেনাবাহিনী সামনেই দাঁড়িয়েছিল। মুষলধারে তীর বর্ষিত হচ্ছে, তীর ও তরবারীর ঝলক চারদিক বিদ্যুৎ বর্ষণ করছে। মুন্ড, দেহ, হাত কর্তিত অবস্থায় ধূলায় গড়িয়ে পড়ছে, ঠিক তখনই নামাজের সময় হয়ে গেছে, তৎক্ষণাৎ যুদ্ধের ব্যূহ নামাজের কাতারে পরিণত হয়ে যেত এবং আল্লাহু আকবার ধ্বনির সাথে সাথে জীবন-মৃত্যু হতে বেপরোয়া হয়ে অনুগত গর্দানসমূহ উঠা-নামা করতে শুরু করত।
নূরের টুকরা, ইসলামী বৃত্তের কেন্দ্র ফারুকে আজম নামাজের ইমাম, পেছনে রয়েছেন সাহাবীদের সারি। এমনি সময় এক অভিশপ্ত হাত খঞ্জর নিয়ে সামনে অগ্রসর হলো। অকস্মাৎ খলীফার উপর হামলা করে পেটে বার বার আঘাত করলো। খলীফা বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন। রক্তের ফোয়ারা বয়ে চললো। কিন্তু এত সব ঘটনা ঘটে গেল। নামাজের কাতারসমূহ ঠিকই রইলো। এমন সময় হযরত আবদুর রহমান বিন আউফ (রা:) সামনে গিয়ে নামাজ পড়ালেন। এভাবেই ফজরের দু’রাকায়াত নামাজ আদায় করা হলো। তারপর আহত খলীফার পরিচর্যার কাজ শুরু হলো। [সহীহ বুখারী : শাহাদতে ওমর (রা:)] হযরত ওমর (রা:) যে প্রভাতের নামাজে জখমী হয়েছিলেন, পরবর্তী প্রভাতে লোকজন হাকে নামাজের জন্য জাগ্রত করলে তিনি বললেন, হাঁ, যে ব্যক্তি নামাজ ছেড়ে দেয়, ইসলামে তার কোন অংশই নেই। সুতরাং জখম হতে তখনো রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল। সেভাবেই তিনি নামাজ আদায় করলেন। (মোয়াত্তা ইমাম মালেক)
হযরত আলী মুরতাজা (রা:) ফজরের নামাজের সময় মসজিদে প্রবেশ করেছেন, অথবা ফজরের নামাজে নিরত রয়েছেন। ইবনে মুলজামের তরবারীর আঘাতে তিনি ঘায়েল হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। ইমামে মাজলুম হযরত হুসাইন বিন আলী (রা:) কারবালা ময়দানে উপনীত হয়েছেন। চোখের সামনে পড়ে রয়েছে, প্রিয়জন ও বন্ধু-স্বজনদের লাশ। কয়েক হাজার আিভশপ্ত ব্যক্তি তাঁকে পরিবেষ্টন করে আছে। এমন সময় জোহরের নামাজের সময় হয়ে গেল। তিনি দুশমনদের কাছে অনুমতি চাইলেন, যেন এতটুকু অবকাশ তাঁকে দেয়া হয়, যাতে জোহরের নামাজ আদায় করতে পারেন। (তারীখ-ই তাবারী কবীর, ৭ খ: ৩৪৭ পৃ:)
নামাজের জন্য যে বিনয়-ন¤্রতা ও আন্তরিকতার প্রয়োজন, সাহাবায়ে কেরাম এর উত্তম নমুনা পেশ করেছেন। সবচেয়ে প্রিয়তম বস্তুর ও যদি তাদের এই রূহানী আশা-আকাঙ্খার অন্তরায় হয়ে দাঁড়াত, তবে এগুলোকেও তারা ঘৃণা ভরে পরিত্যাগ করতেন এবং পরিহার করতেন। হযরত আবু তালহা আনসারী (রা:) নিজের বাগানে নামাজ পড়ছিলেন। এমন সময় একটি সুন্দর পাখি তার সামনে এসে চিৎকার করতে শুরু করলো। হযরত আবু তালহা দীর্ঘক্ষণ যাবত এদিক- সেদিক তাকাতেও লাগলেন। তারপর যখন নামাজের খেয়াল হলো, তখন রাকায়াতের কথা স্মরণ করতে পারলেন না। মনে মনে বললেন, এই বাগানটিই ফেতনা ছড়িয়ে দিয়েছে। একথা বলেই রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর খেদমতে উপস্থিত হলেন এবং ঘটনাটি বিবৃত করলেন এবং আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা:)! এই বাগানটি আমি আল্লাহর পথে উৎসর্গ করলাম।
অনুরূপভাবে অপর একজন সাহাবী কোন একদিন নিজের বাগানে নামাজে মশগুল ছিলেন। বাগানটি তখন খুবই সবুজ-শ্যামল, তরতাজা ও ফুলে-ফলে সুশোভিত ছিল। ফসলের সমারোহের দিকে নজর পড়তেই নামাজের কথা বিস্মৃত হয়ে গেলেন। তখন তাঁর খেয়াল ফিরে আসলো, তখন মনে মনে খুবই লজ্জিত হলেন। হায়! দুনিয়ার মাল ও দৌলত নিজের দিকে আমাকে আকৃষ্ট করে ফেলেছে। সময়টি ছিল হযরত ওসমান গনী (রা:)-এর শাসনামলে। তখনই তাঁর খেদমতে হাজির হলেন এবং আরজ করলেন, এই বাগান যেটি আমাকে ফেতনায় নিপতিত করেছে তা আমি আল্লাহর পথে দান করে ছিলাম। পরবর্তীতে হযরত ওসমান গনী (রা:) এই বাগানটি বাইতুল মালের পক্ষ হতে বিক্রয় করলেন। এর মূল্য ছিল পাঁচ হাজার দেরহাম। (এই উভয় ঘটনা মোয়াত্তা ইমাম মালেক : কিতাবুস সালাত অধ্যায়ে বর্ণিত আছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।