Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাদ পড়েছেন ১৯ লাখ

আসামের চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:১১ এএম, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

আসামে চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা (এনআরসি) থেকে বাদ পড়েছেন রাজ্যের প্রায় ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জন মানুষ। গতকাল শনিবার স্থানীয় সময় সকাল দশটায় অনলাইনে ও এনআরসি সেবাকেন্দ্রে এই তালিকা প্রকাশ করা হয়। এক বিবৃতিতে এনআরসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, চূড়ান্ত তালিকায় মোট আবেদনকারী ৩ কোটি ৩০ লাখ ১৭ হাজার ৬৬১ জনের মধ্যে নাগরিক হিসেবে স্থান পেয়েছেন ৩ কোটি ১১ লাখ ২১ হাজার ৪ জন। ১৯৫১ সালের পর পরিচালিত প্রথম আদম শুমারির মধ্য দিয়ে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রথম ধাপে ১ কোটি ৯০ লাখ অধিবাসীকে নাগরিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। দ্বিতীয় দফায় ২০১৮ সালের জুনে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা ৩ কোটি ২৯ লাখ অধিবাসীর মধ্যে ২ কোটি ৮৯ লাখকে সংশোধিত নাগরিকত্ব তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রয়টার্স নিবন্ধন-সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে সে সময় জানিয়েছিল, রাজ্যের ৪০ লাখ ৭ হাজার ৭০৭ মানুষ তালিকায় স্থান পায়নি। এদের অধিকাংশই বাংলা ভাষাভাষী কিংবা মুসলমান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এ বছর জুনে তালিকায় আরেক দফা সংশোধনী আনা হয়। ২০১৮ সালে সংশোধিত তালিকায় স্থান পাওয়াদের মধ্যে থেকে ১ লাখেরও বেশি মানুষকে বহিষ্কার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সবমিলে বাদ পড়া ৪০ লাখেরও বেশি মানুষ চ‚ড়ান্ত তালিকা প্রকাশের দিনটিকে ঘিরে উদ্বিগ্ন ছিলেন। বাদ পড়াদের মধ্যে ৩৬ লাখ মানুষ নাগরিক তালিকায় স্থান পাওয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। আর খসড়া তালিকায় স্থান পাওয়া ২ কোটি ৮৯ লাখ মানুষের মধ্যে ২ লাখের স্থান পাওয়া নিয়ে আপত্তি উঠেছিল।
এনআরসি থেকে বিপুল সংখ্যক বাঙালি হিন্দুর বাদ পড়ায় কয়েকজন বিজেপি নেতা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। গত সপ্তাহে আসামের মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর জানিয়েছিলেন, কেন্দ্র সরকার নতুন আইনের কথা বিবেচনা করছে। যার ফলে তালিকায় স্থান পাওয়া বিদেশিদের বাদ দেয়া যায় এবং বাদ পড়া সত্যিকার নাগরিকদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। শুক্রবার আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সানোয়াল জানিয়েছেন, এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়া বাসিন্দারা ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আপিল করতে পারবেন। তিনি বলেন, আসাম সরকার বাদ পড়াদের দেখভাল করবে এবং যাতে করে অপ্রয়োজনীয় হয়রানির শিকার হতে না হয় তা নিশ্চিত করবে।
মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, যতক্ষণ আপিল চলবে ততক্ষণ কাউকে বিদেশি বলা যাবে না। কারণ কাউকে বিদেশি বলার এখতিয়ার শুধু ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের রয়েছে। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চূড়ান্ত এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়াদের বিদেশি ঘোষণা করা যাবে না সব আইনী প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত। বাদ পড়া ব্যক্তি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে পারবেন এবং আবেদনের সময়সীমা ৬০ দিন থেকে বাড়িয়ে ১২০ দিন করা হয়েছে। চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ ঘিরে রাজ্য জুড়ে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন। গুয়াহাটিসহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে ১৪৪ ধারা জারির পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের পাঠানো আধাসামরিক বাহিনীর অতিরিক্ত ৫১ কোম্পানি সেনা মোতায়েন করেছে আসাম সরকার। মোতায়েন করা হয়েছে ৬০ হাজার পুলিশ সদস্য এবং কেন্দ্র থেকে আসামে পাঠানো হয়েছে আরও ২০ হাজার আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য।
শুক্রবার আসাম পুলিশের মহাপরিদর্শক কুলাধান শৈকিয়া জানিয়েছেন চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ সামনে রেখে রাজ্যে সেন্ট্রাল আর্মড পুলিশ ফোর্সের (সিএপিএফ) অতিরিক্ত ৫১ কোম্পানি সেনা পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। তিনি জানান, অতিরিক্ত এসব সেনা বর্তমানে রাজ্যে নিয়োজিত ১৬৭ কোম্পানি সিএপিএফ সদস্যদের সঙ্গে কাজ করবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নজরদারি চালানো হচ্ছে বলেও জানান এই নিরাপত্তা কর্মকর্তা।
বাদ পড়লেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সানাউল্লাহ
ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জুনিয়র কমিশনড অফিসার (জেসিও) আসামের চূড়ান্ত নাগরিক তালিকায় স্থান পাননি। এই বছরের শুরুতে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল তাকে বিদেশি ঘোষণার পর ভারতের সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিলেন তিনি। গতকাল প্রকাশিত চূড়ান্ত নাগরিক তালিকাতেও স্থান হয়নি তার। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস জানিয়েছে, এই সেনা কর্মকর্তার তিন সন্তান, দুই মেয়ে ও এক ছেলের নাম তালিকায় নেই। কিন্তু চূড়ান্ত তালিকায় স্ত্রীর নাম রয়েছে।
কারগিল যুদ্ধে অংশ নেয়া এবং প্রেসিডেন্ট পদক পাওয়া মোহাম্মদ সানাউল্লাহকে কামরুপের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল বিদেশি হিসেবে ঘোষণা করে। ২০০৮ সালে সন্দেহজনক ভোটার হিসেবে তার নাম তালিকাভুক্তির পর ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে তার নামে মামলা হয়। এরপর মে মাসে তাকে বন্দিশিবিরে পাঠানো হয়। পরে গুয়াহাটি হাইকোর্ট থেকে তিনি জামিন পান। তবে হাইকোর্ট ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের রায় খারিজ করে দেয়নি। আদালত জানায়, তার আবেদনের শুনানি চলবে। সানাউল্লাহ ও তার সন্তানদের বিরুদ্ধে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের রায় গুয়াহাটি হাইকোর্টে বিচারাধীন থাকায় চূড়ান্ত নাগরিক তালিকায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্তির কোনও সুযোগ ছিল না। এনআরসির ধারা অনুসারে, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত কোনও বিদেশি ও তার সন্তানরা চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পাবেন না। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার চাকরিতে যোগ দেন ১৯৮৭ সালে। আসাম সরকারের কর্মকর্তা চন্দ্রমাল দাস সানাউল্লাহকে বিদেশি আখ্যায়িত করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০০৮ সালে তাকে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য নোটিশ দেয়া হয়। ২০১৮ সালে তিনি ট্রাইব্যুনালে হাজির হন এবং ২৩ মে তাকে বিদেশি ঘোষণা করে গোয়ালপাড়ার একটি বন্দিশিবিরে পাঠানো হয়।
বিরোধী দলের বিধায়কের নাম নেই
আসামের জাতীয় নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়াদের তালিকায় রয়েছেন আসামের দ্বিতীয় শক্তিশালী বিরোধী দলের এক বিধান সভার সদস্যের। ওয়েবসাইটে নিজের নাম দেখতে পাননি অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের (এআইইউডিএ) অনন্ত কুমার মালো।
বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া
ইমরান খান : জাতিগতভাবে মুসলিমদের নিধনের উদ্দেশ্যেই ভারত সরকার অসমে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির প্রকাশ করেছে বলে মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। গতকাল টুইটারে এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এই মন্তব্য করেছেন।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী টুইটারে লিখেছেন, ‘মুসলিম নিধনের উদ্দেশ্যেই ভারত সরকার অসমের এই নাগরিকপঞ্জি প্রকাশ করেছে। মোদি সরকার যেভাবে মুসলিমদের জাতিগতভাবে নির্ম‚ল করতে চাইছে এবং এর খবর ভারতসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম যেভাবে আসছে, তা গোটা বিশ্বের জন্য অশনিসংকেত। এই একই উদ্দেশে মুসলিমদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে তারা কাশ্মীরকে অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছে।
আসাদুদ্দীন ওয়াইসি : অনুপ্রবেশকারীর ধোয়া তুলে যে রাজনীতি বিজেপি করতে চেয়েছিল তা আসল চেহারা বেরিয়ে পড়েছে। তারা যে এ বিষয়ে গুজব ছড়াচ্ছিল তা এবার ফাঁস হয়ে গেছে। এনআরসি-র চ‚ড়ান্ত তালিকা নিয়ে বিজেপির সমালোচনা করে একথা বলেছেন অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলেমিন প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি। একইসঙ্গে আসাম থেকে ক্ষমতাসীন দল বিজেপিকে শিক্ষা নিতেও বললেন তিনি।
জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ : এ প্রসঙ্গে গতকাল অসম রাজ্য জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের অতিরিক্ত সাধারণ সম্পাদক ও ইউডিএফের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি মাওলানা আব্দুল কাদির কাশেমি বলেন, এনআরসির যে তালিকা প্রকাশিত হয়ে তা আমরা খতিয়ে দেখব। যদি কোনও পক্ষপাতিত্ব করা হয় তখন তা বলা যাবে। এই মুহ‚র্তে এ নিয়ে কোনও তথ্য না থাকায় অনুমান করে পক্ষপাতিত্বের কথা বলা উচিত নয়। যেসব ভারতীয়র নাম ভুলবশত বাদ পড়েছে তারা নিশ্চয় সুবিচার পাবে এবং পরবর্তী পর্যায়ে এনআরসিতে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হবে।’
এদিকে, অসমে বাঙালিদের অন্যতম মুখ ও অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলর তপোধীর ভট্টাচার্য জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালিদেরই টার্গেট করা হচ্ছে বলে মনে করছেন। তিনি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘একটা বিশেষ ভাষাগোষ্ঠীর ১৯ লাখ মানুষই যদি বাদ পড়ে যায় তাহলে আর থাকল কারা? যে জাতিবিদ্বেষ সংবিধানিক রীতির উপরে চলে যায়, গণতান্ত্রিক রীতির উপরে চলে যায়, এটা তো তারই জয় হল! এটা তো অন্ধকারের জয়!’ আমরা লড়াই করে যাচ্ছি। লড়াইটা কয়েক দশক ধরেই চলবে বলেও তপোধীর বাবু মন্তব্য করেন। সূত্র : রয়টার্স, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ