Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কাশ্মীর : একশ’ মিটার দূরেই শত্রু, দীর্ঘ অভিজ্ঞতা

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২০ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০২ এএম

কাশ্মীরের বিতর্কিত দুই অংশে ভারত-পাকিস্তান প্রায় ১০ লাখ সেনা মোতায়েন করে রেখেছে। এক এলাকায় এত বেশি সেনা বিশ্বের আর কোনো জায়গায় মোতায়েন করে রাখা নেই। কাশ্মীরের সীমান্ত রেখার কোনো কোনো স্থানে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত দু’দেশের সেনাদের অবস্থান একেবারেই কাছাকাছি। কোথাও এই ব্যবধান একশ মিটার। বিপজ্জনক এক সীমান্তে চিরশত্রুর চোখে চোখ রেখে জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির কাছে বলেছেন দুই দেশের দু’জন সাবেক সেনা কর্মকর্তা।
কাশ্মীর নিয়ন্ত্রণ রেখায় কী ঘটে, সে সম্পর্কে ভারতের একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা বলেন, সংঘাতের শুরু হয় হালকা মেশিনগানের গুলি দিয়ে। তারপর এক সময় ভারি মেশিনগান। তারপর শুরু হয় মর্টারের গোলা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই পক্ষের মধ্যে বেশ ভারি অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। পরিস্থিতি খুব খারাপ হলে, অবস্থা সামাল দিতে আমাদের সিনিয়র কমান্ডাররা সীমান্তের ওপারে পাকিস্তানের কমান্ডারদের সাথে যোগাযোগ করেন।
পারমাণবিক শক্তিধর ভারত ও পাকিস্তানের প্রায় ১০ লাখ সেনা বর্তমানে কাশ্মীরে মুখোমুখি অবস্থান করছে। কোথাও কোথাও তাদের মধ্যে দূরত্ব খুবই কম। শত্রুর নজর এবং অস্ত্রের আওতার মধ্যে কাজ, খাওয়া দাওয়া, ঘুমানোর অভিজ্ঞতা কেমন, সে সম্পর্কেও তারা কথা বলেছেন।
পাকিস্তানের অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল বলেন, সবাই শান্তি ভালোবাসে, কিন্তু শান্তি আসলে একটি অলীক ধারণা। কখনো কখনো শান্তির জন্যই আপনাকে লড়াই করতে হয়। আর ভারতীয় কর্মকর্তা বলেন, আপনাকে হয় মারতে হবে, না হয় মরতে হবে। ভাবার কোনো সময় নেই।
কর্নেল মুরুগানানথাম, অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার বলেন, সীমান্তে পরিস্থিতি কখনই একরকম থাকে না। সবসময়ই বিপজ্জনক এবং ক্রমাগত বদলায়। আমরা তাদের সীমান্ত চৌকির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করি, তারাও আমাদের চৌকি দখলের চেষ্টা করে। তিনি আরো বলেন, এই ইঁদুর-বেড়াল খেলার শেষ নেই। তবে যারাই সীমান্তে উঁচু জায়গার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে, তারাই প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে। সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসেবে তরুণ বয়সেই মুরুগানানাথামকে কাশ্মীর নিয়ন্ত্রণ রেখা পাহারার দায়িত্বে পাঠানো হয়েছিল। তিনি বলেন, ১৯৯৩ সাল। সে সময় পাকিস্তান ভারতের ভেতর জঙ্গি ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। আমাদের কাজ ছিল সেটা ঠেকানো। যখনই সীমান্তের ওপর থেকে গুলি শুরু হতো, আমরা জানতাম জঙ্গিদের কাভার দেওয়ার জন্য তা করা হচ্ছে। সুতরাং আমাদেরকে তখন বিশেষভাবে তৎপর হতে হতো।
কড়া নজর
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, আমাকে যখন কাশ্মীরে পাঠানো হয়, তখন যুদ্ধবিরতি চলছিল। কিন্তু আমাদের সবসময় খুব সাবধানে থাকতে হতো।
সাবেক এই কর্নেল নাম না প্রকাশ করার শর্তে কাশ্মীরের পুঞ্চ সীমান্তে ২০০৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত একটি ইউনিটের কমান্ডারের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা বলতে রাজি হন। ভারতের সাবেক কর্নেলও ওই এলাকায় ছিলেন।
পাকিস্তানি কর্মকর্তা বলেন, কোনো কোনো সেনা চৌকিকে ভীষণ আড়াল করে রাখা হতো। অধিকাংশ সময় সেগুলো নজরে পড়তো না। একটি জায়গায় ভারত ও পাকিস্তানের চৌকিগুলোর মধ্যে দ‚রত্ব ছির মাত্র ২৫ মিটারের মতো।
শত্রুর মুখোমুখি
শত্রুর এত কাছাকাছি থাকা, নজরের মধ্যে থাকা খুব স্বস্তির বিষয় নয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে এরকম খুব কাছাকাছি চৌকিগুলোতে তরুণ অফিসারদের এক বা দুই মাসের জন্য মোতায়েন করা হয়।
কর্নেল মুরুগানানথাম বলেন, আমার একটি এলাকায় দুই নিরাপত্তা চৌকির মধ্যে দ‚রত্ব ছিল মাত্র ১৫০ মিটার। আমি দেখতে পেতাম পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের অস্ত্র পরিষ্কার করছে। আরেক জায়গায়, আমার চৌকিটি ছিল একটি নিচু জায়গায়। আমি তাদের চোখে না দেখলেও বুঝতে পারতাম তারা আমাদের সবসময় দেখছে। তিনি আরো বলেন, যদিও ভয় খুবই স্বাভাবিক একটি প্রতিক্রিয়া, তবুও প্রশিক্ষণের কারণে আমি নিজেকে শান্ত রাখতে শিখেছিলাম। বিশেষ করে আমার জওয়ানদের সামনে আমি কোনোভাবেই দেখাতে পারি না যে আমি ভয়ে রয়েছি। আমি তাদেরকে বলতাম, যাই ঘটুক, এই চৌকি আমরা ছাড়ব না।
পাকিস্তানের সাবেক কর্নেল বলেন, তিনি একবার একটি চৌকিতে রাত কাটিয়েছিলেন যেটির খুবই কাছে ছিল ভারতীয় একটি সেনা চৌকি। তবে এসব পরিবেশে আপনি একসময় অভ্যস্ত হয়ে যান। সাহসী হয়ে যান। তবে দুই প্রশিক্ষিত এবং সুসজ্জিত সেনাবাহিনী যখন পরস্পরের প্রতি এত ঘৃণা পোষণ করে, তখন পরিস্থিতি যে কোনো সময় আয়ত্তের বাইরে চলে যেতেই পারে।
কর্নেল মুরুগানানাথাম বলেন, একদিন আমার একজন জওয়ান পাকিস্তানিদের মেশিনগানের গুলিতে মারা গেল। পুরো ব্যাটালিয়ন শোকার্ত হয়ে পড়েছিল। বদলা নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল বাকি জওয়ানরা। আমরা কর্মকর্তারা তাদেরকে শান্ত করেছিলাম, তাদেরকে বলেছিলাম আমরা সময় মতো এর জবাব দেব। তিনি আরো বলেন, আমি কাছে আরেকটি চৌকি থেকে পাল্টা হামলার পরিকল্পনা করেছিলাম, পাকিস্তানিরা হতাহত হয়েছিল। এভাবেই কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা মাঝেমধ্যেই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
পাকিস্তানি কর্নেল বলেন, তিনি যখন সীমান্ত চৌকিতে ছিলেন তখন কোনো লড়াই হয়নি, তবে তার সেনারা মাঝে মধ্যেই আবেগ-তাড়িত হয়ে পড়তো, উত্তেজিত হয়ে পড়তো। তিনি বলেন, আমরা যখনই ভারত শাসিত কাশ্মীরের ভেতর থেকে নির্যাতনের খবর পেতাম, সেনারা অস্থির হয়ে পড়তো। তাদের আবেগ ঠান্ডা করতে কয়েকদিন লেগে যেত।
বৈরি আবহাওয়া
বিপদ যে সবসময় শত্রু সৈন্যদের কাছ থেকে আসে, তা নয়। বরফে আচ্ছাদিত সুন্দর হিমালয়ও সৈন্যদের জন্য চরম বিপদ বয়ে আনে। পাকিস্তানি একজন কর্মকর্তা বলেন, নিউমোনিয়া এবং ঠান্ডা থেকে বুকের নানা অসুখ বড় চ্যালেঞ্জ। জীবন বাঁচানো অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। একজন অসুস্থ সেনাকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্য বাকি চারজন জওয়ানের জীবন হুমকিতে পড়ে। ভারতীয় কর্মকর্তাও এ ব্যাপারে একমত। তার মতে, উঁচু পাহাড়ে এক ধরনের অস্বাভাবিক অনুভ‚তি হয়। অত উঁচুতে গিয়ে থাকার জন্য জন্য ছয়দিন ধরে প্রশিক্ষণ নেওয়া লাগে। যত সৈন্য খোয়া যায়, তার অর্ধেকের জন্যই দায়ী আবহাওয়া, ঠান্ডা, ফ্রস্টবাইট।
বজ্রপাত
পাহাড়ে, প্রকৃতি অনেক সময় অসম্ভব বে-খেয়ালি আচরণ করে। ১৯৯৭ সালে কর্নেল মুরুগানানথামের পোস্টিং ছিল শামসাবাড়ি রেঞ্জে। ওপারে পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের লিপা উপত্যকা। তিনি বলেন, আমার মনে আছে দিওয়ালির দিনে হঠাৎ শুরু হলো প্রচন্ড ঝড় এবং সেই সাথে বজ্রপাত। আমাদের চৌকিটি ছিল ৩৬০০ মিটার ওপর। অত উচ্চতায় মেঘ ডাকার শব্দ খুবই ভয়ঙ্কর এক অভিজ্ঞতা। তিনি আরো বলেন, বজ্রপাতে পাহাড়ের চূড়ায় আগুন ধরে গিয়েছিল। আমরা সাথে সাথে সমস্ত জেনারেটর বন্ধ করে দিই। রেডিও যোগাযোগের যন্ত্র বন্ধ করে দিয়ে বাঙ্কারে গিয়ে আশ্রয় নিই। আমরা দেখলাম পাকিস্তানিরাও তাই করছে।
সাহায্য
দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অনেক নিরাপত্তা চৌকির সাথে যোগাযোগের জন্য কোনো রাস্তা নেই। হয় হেলিকপ্টার না হয় গাধার পিঠে মালপত্র নেয়া হয়। পাকিস্তানি কর্মকর্তা বলেন, কাশ্মীরের পথঘাট খুবই সরু এবং বিপজ্জনক। গাড়ি খাদে পড়ে অনেক সৈন্য মারা যায়। আমি যখন ছিলাম, গাড়ি দুর্ঘটনায় আমার দুজন সৈন্য মারা গিয়েছিল। সীমান্তে মোতায়েন করা হয় যাদের, সেসব সৈন্যদের জীবন খুবই কঠিন। মাসের পর মাস তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়, পরিবারের অনেক অনুষ্ঠানে তাদের অংশগ্রহণ সম্ভব হয় না।
কর্নেল মুরুগানানাথাম বলেন, শত্রুর কাছ থেকে গুলি খাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, এমন সীমান্ত চৌকিতে কাউকেই একমাসের বেশি রাখা হয় না। এছাড়া, ৩৫০০ মিটারের উঁচুতে যেসব সীমান্ত চৌকি, সেখানে মোতায়েনের মেয়াদ বড়জোর তিন মাস।
বাঙ্কার
সীমান্তের একদম সম্মুখভাগের কিছু কিছু চৌকি অনেক শক্ত করে তৈরি করা হয়। কংক্রিট এবং ইস্পাত ব্যবহার করা হয়। হাল্কা গুলি ঠেকানোর ক্ষমতা থাকে এসব পোস্টের।স্থায়ী সীমান্ত চৌকিগুলোতে অধিকাংশগুলোতেই বাঙ্কার থাকে।
তবে অস্থায়ী চৌকিগুলোতে বাড়তি নিরাপত্তার জন্য পাথর এবং বালির বস্তা ব্যবহার করা হয়। এসব বাঙ্কারে বড় জোর দুই বা তিনজন মেশিনগান নিয়ে বসতে পারে। যখন দুই বাহিনীর অবস্থান খুব কাছাকাছি হয়, ছোটোখাটো ঘটনায় বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
পাকিস্তানি কর্মকর্তা বলেন, আমাদের সৈন্যরা একবার দেখতে পায় ভারতীয় চৌকির ওপর একটি চাকতি বসানো। আমরা ভাবলাম আমাদের ওপর নজরদারির জন্য হয়তো রেডার বসানো হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমরা একটি বৈঠক ডেকে ভারতীয়দের জিজ্ঞেস করলাম ওটা কী। তারা বললো ওটা একটা স্যাটেলাইট ডিশ। আমি বুঝতে পারছিলাম না আমরা কী করা উচিৎ। তারপর আরো বড় আকারের একটি স্যাটেলাইট ডিশ আনিয়ে বসালাম। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রেখা খুবই বিপজ্জনক। গত ৩০ বছরে নিয়ন্ত্রণ রেখায় দুপক্ষেরই শত শত সৈন্য মারা গেছে।
পাকিস্তানি কর্মকর্তা বলেন, সীমান্তে যে কোনো সময় মৃত্যু হতে পারে। দেশপ্রেম, রেজিমেন্ট নিয়ে গর্ব, কাশ্মীরের প্রতি আবেগ-অনুগত্য আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। বাহিনীর অন্যদের প্রতি আনুগত্য, দায়িত্ববোধ আমাদের সাহসী করে। ভারতীয় কর্নেলেরও কথা ছিল প্রায় একইরকম, এক এবং অভিন্ন ভারতের ধারণা আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়। সূত্র : বিবিসি বাংলা।



 

Show all comments
  • Mohammed Kowaj Ali khan ২০ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০৬ এএম says : 0
    দেখেন আমি ইতা আর হিতা বুজি না আমি কাশ্মীর সীমান্তে হইলে ভারতীয় চেনা পিটাইয়া হাড্ডি গুরা করিয়া দিতাম। ইনশাআল্লাহ।
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammed Kowaj Ali khan ২০ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০৭ এএম says : 0
    দেখেন আমি ইতা আর হিতা বুজি না আমি কাশ্মীর সীমান্তে হইলে ভারতীয় চেনা পিটাইয়া হাড্ডি গুরা করিয়া দিতাম। ইনশাআল্লাহ।
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammed Kowaj Ali khan ২০ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০৮ এএম says : 0
    দেখেন আমি ইতা আর হিতা বুজি না আমি কাশ্মীর সীমান্তে হইলে ভারতীয় চেনা পিটাইয়া হাড্ডি গুরা করিয়া দিতাম। ইনশাআল্লাহ।
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammed Kowaj Ali khan ২০ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০৮ এএম says : 0
    দেখেন আমি ইতা আর হিতা বুজি না আমি কাশ্মীর সীমান্তে হইলে ভারতীয় চেনা পিটাইয়া হাড্ডি গুরা করিয়া দিতাম। ইনশাআল্লাহ।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কাশ্মীর


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ