পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
শেখ মুজিবকে আমি প্রথম দেখি ১৯৪৮ সালে। আমি তখন ফরিদপুর ময়েজুদ্দিন হাই মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। থাকি ইউসুফ আলী চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত দরিদ্র-মেধাবী ছাত্রদের ফ্রি খাওয়া-দাওয়ার সংস্থা স্টুডেন্ট হোমে। শেখ সাহেব তখন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র এবং পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম ছাত্রনেতা। তার নিজের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থ থেকে জানতে পাই তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন অখন্ড ভারতে মুসলমানদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে এই আশঙ্কা থেকে।
বঙ্গীয়-প্রাদেশিক মুসলিম লীগ পাকিস্তান আন্দোলনকালে দু’টি উপদল ছিল। একটি আকরব খাঁ খাজা নাজিমুদ্দিন নেতৃত্বাধীন। আরেকটি সোহরাওয়ার্দী আবুল হাশিমের নেতৃত্বাধীন। শেখ মুজিব দ্বিতীয় উপদলের সমর্থক ছিলেন। পাকিস্তান আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৪৬ সালে বাংলাদেশে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নেতৃত্বাধীন উপদলের অবিভক্ত বঙ্গের শেষ প্রাদেশিক চিফ মিনিস্টার নির্বাচিত হন। সে হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তাঁরই পূর্ববঙ্গের সোহরাওয়ার্দীর প্রথম চিফ মিনিস্টার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সিলেট পাকিস্তানে যোগদানের পর সিলেটের নেতাদের প্রভাবিত করে ফেলার কারণে খাজা নাজিমুদ্দিনই হন পূর্ববঙ্গের প্রথম চিফ মিনিস্টার।
ফলে মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী আবুল হাশিম উপদলটি স্বাধীন পাকিস্তান বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। যে সম্মেলনে পাকিস্তান আন্দোলনের এই প্রথম বিরোধী দলের জন্ম হয় সে সম্মেলনে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয় আমার একজন সাংবাদিক (ভাষা আন্দোলনের স্থপতি সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক-এর সহকারী সম্পাদক) হিসেবে। ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন’ নামের সে সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাবেক বাঙালী সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।
সে সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দী হাশিম উপদলের অন্যতম উদীয়মান নেতা টাঙ্গাইলের শামসুল হক অভ্যর্থনা সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রস্তাবিত সংগঠনের আদর্শ ও নীতি সম্পর্কে ‘মূল দাবি’ শীর্ষক একখানি মুদ্রিত পৃস্তিকা পাঠ করছিলেন। এতে সম্মেলনে উপস্তিত অন্যতম ডেলিগেট ফজলুল কাদের চৌধুরী অব পয়েন্ট অব অর্ডার বলে দাঁড়িয়ে এর প্রতিবাদ করে বলেন, আমরা এখানে এসেছি দেশের জন্য একটি বিরোধী দল গঠন করতে। এখানে আদর্শের এত কচকচানি কেন? এতে সম্মেলনের সভাপতি মওলানা ভাসানী ‘খামোশ’ বলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, মুসলিম লীগ আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে, আম জনগণ দিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পকেট লীগে পরিণত হওয়ায় আমরা আদর্শকে ভিত্তি করে আম জনগণকে সাথে নিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করতে যাচ্ছি। কারো যদি আদর্শ বদহজমি হয় তেমন লোকের আমাদের দরকার নেই। এ কথায় রাগে গটগট করতে করতে সম্মেলন থেকে ওয়াক আউট করে চলে যান চৌধুরী। সম্মেলনে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি, এডভোকেট আতাউর রহমান খানকে সহ-সভাপতি, শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক, সভায় অনুপস্থিত শেখ মুজিবকে যুগ্ম সম্পাদক, ইয়ার মুহাম্মদ খানকে কোষধ্যক্ষ করে দেশের প্রথম বিরোধী দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়।
পরবর্তী ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের অপরাধে মওলানা ভাসানী, শামসুল হকসহ বিভিন্ন নেতা গ্রেফতার হলেও শামসুল হক যখন মুক্তি পান তখন যে ষড়যন্ত্রের কারণে মস্তিষ্ক বিকৃত অবস্থায় তাক দেখা যায়, সে রহস্য অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি।
এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ সভাপতি পদে মওলানা ভাসানী থাকলেও সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান।
পরে একপর্যায়ে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির বিরোধিতা করায় সভাপতি পদ থেকে মওলানা ভাসানীকেও বাদ দেয়া হয়, যার ফলে সংগঠনে শেখ মুজিবের নেতৃত্ব আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
পরবর্তীকালে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন আরও জোরদার হয়ে উঠলে শেখ মুজিবকে আগরতলা যড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামি হিসেবে গ্রেফতার দেখানো হয়। এতে শেখ সাহেবের জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পায়। এই পর্যায়ে ছাত্রনেতাদের উদ্যোগে আয়োজিত এক প্রতিবাদ সমাবেশে ছাত্র-নেতা তোফায়েল আহমদের প্রস্তাবক্রমে এক সমাবেশে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ আখ্যায় আখ্যায়িত করা হয়। এভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
বঙ্গবন্ধুর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে পাকিস্তান আন্দোলনের মূল ভিত্তি ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের মর্মানুসারে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা অপ্রতিবোধ্য হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে ১৯৭০ সালে সমগ্র পাকিস্তান জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিরের নেতৃত্বাদীন আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানের মধ্যে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে বিজয় লাভ করে। দেশে গণতন্ত্র বজায় রাখতে বিজয়ী দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করাটা যেখানে কাম্য, সেখানে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে নেমে আসে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অবাঙালী নেতৃত্বে পরিচালিত বিভীষিকাময় ভূমিকা।
তারা পশুবলে জনগণের স্বাধিকার-চেতনা ধ্বংস করে, পূর্ব পাকিস্তান জনগণের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করে বসে। এর ফল দিতে হয় বিপরীত। জনগণ পাক বাহিনীর এ অন্যায় হামলা মোকাবেলা করায় শেখ মুজিবের আন্তরিক নির্দেশ অনুযায়ী যার যা আছে, তাই নিয়ে এ অন্যায় মোকাবেলা করতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবনমরণ পণ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাত্র নয় মাসের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে ফেলতে সক্ষম হয়।
২৬ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী আগ্রাসী অভিযানের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যারাই তার কাছে পরামর্শ চাইতে চায়, তাদের সকলকে তিনি পালিয়ে ভারতে চলে যেতে বলেন; কিন্তু নিজে কোথাও না গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা দেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি পাকিস্তানের জেলে আটক থাকেন।
ইতোমধ্যে তাঁর প্রত্যাশা অনুযায়ী ভারত তার সেনাবাহিনী পাঠিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সহায়তা দিতে এগিয়ে আসে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলেও ভারত তার সেনা বাহিনীর একাংশ বাংলাদেশে রেখে দেয়। ভারতীয় বাহিনী কতদিনের জন্য বাংলাদেশে থাকবে তা স্পষ্ট করে না বলায় বাংলাদেশের জনগণের মধ্যেও আশঙ্কা সৃষ্টি হয়।
এ দিকে মুক্তিযুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধু প্রথম লন্ডন যান। সেখানে গিয়েই তিনি প্রথম জানতে চান যে, মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য দেয়ার নামে ভারত তার সেনা বাহিনীর একটি অংশ বাংলাদেশে রেখে দিয়েছে এবং তা কবে ফেরত নেয়া হবে, তা কিছু স্পষ্ট করে বলেনি। এ বিষয় জানতে পেরে বঙ্গবন্ধু সাথে সাথে এ ব্যাপারে তাঁর ইতিকর্তব্য ঠিক করে ফেলেন।
লন্ডন থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনকালে দিল্লিতে তিনি স্বল্প বিরতিকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সরাসরি প্রশ্ন করে বসেন, ম্যাডাম, আপনি বাংলাদেশ থেকে আপনার বাহিনী কখন ফেরত আনবেন? জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, আপনি যখন বলবেন, তখনই। বঙ্গবন্ধুর তখন বিশ্বব্যাপী যে জনপ্রিয়তা, তাতে ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে অন্য কোনো জবাব দেয়া সম্ভব ছিল না।
এভাবেই বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য অপসারণ সহজ হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যেদিন বাংলাদেশ প্রত্যাবর্তন করেন, সেদিন বাংলাদেশের মাটিতে পা দেয়ার পর তার প্রথম ঘোষণা ছিল, বাংলাদেশ হবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। এ কথা তিনি মুখের ঘোষণায় সীমাবদ্ধ রাখেননি। বাস্তবেও এর পরিচয় দেন তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের কিছু দিন পর ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে লাহোরে এক বিশ্বমুসলিম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বাংলাদেশও আমন্ত্রিত হয়। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় একাত্তরের মিত্রশক্তি ভারত। ভারত এ সম্মেলনে বাংলাদেশের যোগদানের প্রবল বিরোধিতা করে।
এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু মওলানা ভাসানীর পরামর্শ কামনা করেন। মওলানা বলেন, তুমি যদি স্বাধীন দেশের নেতা হয়ে থাকো, তাহলে তোমার মনে যা চায়, তাই করো। আর যদি তুমি ভারতের আশ্রিত নেতা হয়ে থাকো, তবে ভারত যা বলে তাই করো।
ফলে বঙ্গবন্ধু তাঁর করণীয় বুঝতে পেরে লাহোর ইসলামিক সম্মেলনে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যেদিন তিনি লাহোর যান, সেদিন নয়াদিল্লিতে তার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। অথচ তখনও ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যম বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা কীতিতে মুখর ছিল।
বঙ্গবন্ধু বলতেন, আমরা ভারতসহ বিশ্বের সকল দেশের বন্ধুত্ব চাই, কারো সঙ্গে শত্রæতা চাই না। আমরা যেমন কোনো দেশের শত্রæতা চাই না, তেমনি কোনো দেশ আমাদের দিকে আধিপত্যবাদী দৃষ্টিতে তাকাবে, তাও দেখতে চাই না।
আজ বাস্তবতার দৃষ্টিতে তাকালে আমরা দেখব বাংলাদেশকে ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্র ভেবে অনেক দেশই বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রসত্তাকে দুর্বল করে ফেলতে চাইছে। আমরা যদি স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী হয়ে থাকি এবং বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত অনুসারী হয়ে থাকি, আমাদের সকলের উচিত হবে স্বাধীনচেতা জনগণকে সাথে নিয়ে সে অন্যায় অপচেষ্টাকে মোকাবেলা করা এবং এ জন্য দল-ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল পার্থক্য ভুলে গিয়ে এ লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ ভ‚মিকা পালনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় ভ‚মিকা পালন করা।
আমরা কি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলতে আমাদের সে কাক্সিক্ষত ভ‚মিকা পালনে সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুত রয়েছি?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।