মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
এ সপ্তাহে নেত্রবতী নদী থেকে ভারতের কফি চেইন টাইকুন ভি জি সিদ্ধার্থর মরদেহ উদ্ধারের আগে থেকেই যে অর্থনৈতিক সঙ্কটের শিকার হয়ে তিনি নিজের জীবন হননের পথ বেছে নেন, তা দৃশ্যমান হতে শুরু করেছিল।
কফি ডে এন্টারপ্রাইজেস লিমিটেডের সিনিয়র ব্যবস্থাপনার কাছে সিদ্ধার্থের লেখা ও স্বাক্ষর করা একটি চিঠি। পাঠানো সেই চিঠিতে তিনি কঠিন ভাষায় মারাত্মক তারল্য সঙ্কটের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা বলেন। এর ফলে ঋণদাতাদের এবং এক অনামীয় বেসরকারী ইক্যুইটি বিনিয়োগকারীর নিকট থেকে মারাত্মক চাপের সম্মুখীন হওয়ার কথা বলেছেন।
সিদ্ধার্থ লিখেছেন, আমি বলতে চাই যে আমার সবই দিয়েছি। যারা আমার উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন তাদের আশাহত করায় আমি দুঃখিত। আমি দীর্ঘদিন লড়াই করেছি। কিন্তু আজ হাল ছেড়ে দিচ্ছি।
তিনি গত ২৭ জুলাই বোর্ডের কাছে এ চিঠি পাঠান। এর দু’দিন পর তিনি কর্নাটকের নেত্রবতী সেতুতে যান। গাড়ি থেকে নেমে চালককে বলেন তিনি হাঁটতে যাচ্ছেন। ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বলে এগিয়ে যান ও নিখোঁজ হন।
সিদ্ধার্থের মৃত্যু ভারতের একজন প্রশংসিত বিজনেস এলিট এবং দেশের উচ্চ মার্গের রাজনীতিকদের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে সম্পর্কিত এক নির্বাহীর করুণ পরিণতির কথা প্রকাশ করেছে। গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সিদ্ধার্থ এক জাভা সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন যার রয়েছে এক হাজার ৭০০ বেশি স্টোর যার সংখ্যা স্টারবাক কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়ার আউটলেটের চেয়ে দশগুণ বেশি। তাদের রয়েছে ৫৪ হাজার ভেন্ডিং মেশিন। তিনি এক হাতে চা-প্রিয় ভারতকে কফি শপে রূপান্তরিত এবং তার ক্যাফে কফি ডে চেইনকে গৃহস্থালি নামে পরিণত করেন।
ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ
যা সবারই খুব কম জানা ছিল তা হচ্ছে যে সিদ্ধার্থ তার কোম্পানির স্কেল ও সর্বব্যাপিতার জন্য ক্রমবর্ধমান ভাবে দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়ছিলেন। সিদ্ধার্থের ব্যক্তিগত ঋণের বিষয়টি প্রকাশ্য হয়ে পড়ার পর তা পর্যালোচনায় দেখা যায় মৃত্যুর আগে দুই বছরের মধ্যে বেশির ভাগ সময় তিনি স্বল্পকালীন সময়ের জন্য ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের জন্য তার কফি ডে শেয়ারের বেশির ভাগই ব্যবহার করেছেন।
শুধু কফি ডে’র জন্যই চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত তিনি স্বল্প মেয়াদে দ্বিগুণেরও বেশি পরিমাণ ঋণ নেন। এ ব্যাপরের সাথে সম্পৃক্ত এমন এক ব্যক্তি জানান যে সিদ্ধার্থ তার গত দুই সপ্তাহের বেশির ভাগ সময়ই এ ঋণ পরিশোধের তহবিল সংগ্রহের চেষ্টায় মুম্বাইতে কাটান। ওই ব্যক্তি বলেন, জুলাই ও আগস্টে তার ঋণ পরিশোধের কথা ছিল। কফি ডে’র বোর্ড গত ৩০ জুলাই এক জরুরি সভায় বলে যে তারা আস্থাশীল যে অতীতের মতই সকল ব্যবসা অব্যাহত থাকবে।
ভারতীয় বিনিয়োগকারীর এ আত্মহত্যার ঘটনা ভারতের কর্পোরেট এলিটদের স্নায়ু স্পর্শ করেছে। যেখানে ব্যবসায়ী নেতারা অর্থনীতি ভিত্তিক নগদ সঙ্কট ও মন্থর প্রবৃদ্ধির কারণে ক্রমাগত চাপের সম্মুখীন হন। সিদ্ধার্থের চিঠিতে যে দুশ্চিন্তা এবং ঋণদাতা ও অংশীদারদের নিকট থেকে চাপের যে বহুমুখী রূপের বিষয় উল্লেখিত হয়েছে তা মোদি সরকারের জন্য এক অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। মোদি তার ক্ষমতার দ্বিতীয় মেয়াদে এসে ভারতকে একটি অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউসে পরিণত করার অঙ্গীকার করেছেন। যদিও তার বাণিজ্যিক ইঞ্জিন ধুঁকছে বলে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
ভারতের ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি কেয়ার রেটিংস-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ মদন সাবনাভিস বলেন, শুধু ক্যাফে কফি ডে’ই নয়, আরো প্রায় ১০০ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লোকজন চরম দুরবস্থায় রয়েছে বা বন্ধ হতে বসেছে। কারণ সেগুলোর পুনঃতফসিলিকরণ হচ্ছে না। এটা এক সঙ্কট। তিনি বলেন, এটা এমন নয় যে টিকে যাবে, কারণ আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে আছি যে সবাই জানি অর্থনীতিতে অচলাবস্থা চলছে।
এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম ভারতের অর্থনীতি গতিবেগ হারিয়েছে। বছরের শুরু থেকে মার্চ পর্যন্ত অর্থনীতির চতুর্থ ত্রৈমাসিকেও প্রবৃদ্ধি মন্থর। গত বছর নন-ব্যাংক ঋণদাতা অবকাঠামো লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস লিমিটেড কু-ঋণ সমস্যার কারণে ভেঙে পড়ার ঘটনায় ঋণদাতারা শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন। এর জবাবে রেভিনিউ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) হচ্ছে বিশ্বের প্রথম বড় কেন্দ্রীয় ব্যাংক যারা এ বছর সুদের হার হ্রাস করেছে।
কৃষকের ভাগ্য
ভারতের সংবাদ মাধ্যম কৃষকদের নানা ঘটনার কথা ব্যাপক ভাবে প্রকাশ করে থাকে। ফসলের নগদ মূল্য লাভে সমস্যার সাথে রয়েছে তাদের পুনঃঋণদানে সমস্যা। কিন্তু ভারতের একটি সুপরিচিত কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতার এ পরিণতি প্রদর্শন করেছে যে এ সমস্যা শুধু শ্রমিকদেরই নয়, এমনকি তা নির্বাহী পর্যায়েও বিস্তৃত। সিদ্ধার্থ তার চিঠিতে বলেছেন, তিনি শেয়ার পুনঃক্রয় সম্পন্ন করার জন্য তার এক বন্ধুর কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা ধার নিয়েছিলেন। একজন বেসরকারি ইক্যুইটি বিনিয়োগকারী তাকে তা বাস্তবায়নের জন্য চাপ দিয়েছিলেন।
মূলত একজন বিনিয়োগ ব্যাংকার সিদ্ধান্ত ভারতের কফি উৎপাদনের প্রাণকেন্দ্র চিকমাগালুরে এক কফি চাষী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। স্টারবাকের ভারতে প্রবেশের এক দশকেরও বেশি সময় আগে ভারতের আইটি হাব বেঙ্গালুরুর প্রোগ্রামারদের কফি-আসক্ত রাখার লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে তিনি কফি ডে চেইন প্রতিষ্ঠা করেন। দুই সন্তানের পিতা এ ধনী ব্যবসায়ী তার সুদূর বিস্তৃত ক্যাফেগুলোর কোনো একটিতে বারিস্তা বা ওয়েটার হিসেবে কাজ করতেন যাতে তিনি খদ্দেরদের প্রকৃত প্রয়োজনীয়তা ও তার কর্মচারীদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারেন।
গত ২৯ জুলাই দক্ষিণাঞ্চলীয় মাঙ্গালুরু শহরে তিনি নিখোঁজ হন। ব্যাপক অনুসন্ধানের পর কর্তৃপক্ষ গত বুধবার সকালে নেত্রবতী নদীতে তার লাশ খুঁজে পায়। পুলিশ এখনো মৃত্যুর কারণ খুঁজছে।
তিক্ত ঋণ
সিদ্ধার্থকে ঘিরে ট্রাজেডির সৃষ্টি হয় তখন যখন অর্থনীতির ঋণের অন্যতম প্রধান উৎস নন-ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল কর্পোরেশন ঋণ প্রদানের বদলে চলমান থাকার জন্য ফায়ার সেলসের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। ভারতের ব্যাংকগুলো নিজেরা এখনো বিশ্বের তিক্ত ঋণের বৃহত্তম স্তূপের নীচে চাপা পড়ে আছে। নীতি নির্ধারকরা রোগ সংক্রমণ পরিহার করতে হামাগুড়ি দিয়ে এগোনো ত্যাগ করেছেন। অন্যদিকে পারিবারিক ব্যবসা থেকে বড় বড় কর্পোরেশন পর্যন্ত ঋণ নিশ্চিত করার জন্য লড়াই করছেন।
সিদ্ধার্থের ব্যক্তিগত অর্থায়নের পুরো চিত্র যদিও এখনো প্রকাশিত হয়নি। এখন পর্যন্ত যে সব বিষয় প্রকাশ্যে এসেছে তাতে দেখা যায় যে তিনি ব্যাপক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছিলেন। বোর্ডের কাছে লেখা চিঠিতে সিদ্ধার্থ তার বিভিন্ন ব্যবসার মূল্য বর্ণনা করেছিলেন। বলেছিলেন যে এ সব সম্পদের মূল্যের পরিমাণ দেনার চেয়ে বেশি।
ভারত সরকারের কাছে ৪টি কোম্পানির প্রদত্ত বিবরণে, যেগুলোতে সিদ্ধার্থ ও তার পরিবারের কফি ডে’র শেয়ার রয়েছে, দেখা যায় যে গত বছর ঋণদাতারা কিভাবে এসব শেয়ারকে কলাটেরাল হিসেবে দাবি করা শুরু করেন। যেখানে আগে তাদের কোনো প্রয়োজন ছিল না এবং নতুন ঋণের হার ছিল ১৪ শতাংশের মত উচ্চ। এমনকি এই কলাটেরাল প্রদান করা সত্তে¡ও।
বিনিয়োগকারীদের চাপ
কঠোর আর্থিক শর্তের মধ্যে এই বছরের জুনের মধ্যে কোম্পানিতে সিদ্ধার্থ ও তার পরিবারের সমগ্র শেয়ারের ৭৬ শতাংশ ঋণের জন্য কলাটেরাল হিসেবে রাখা হয় যা এক বছর আগে ছিল ৬০ শতাংশ।
সিদ্ধার্থের চিঠিতে বলা হয়েছে যে পরিস্থিতির কিভাবে আরো অবনতি ঘটে। কফি ডে’র প্রাইভেট ইক্যুইটি বিনিয়োগকারীদের একজন তাকে কোম্পানির শেয়ার ফেরত কিনতে বাধ্য করেন। তিনি আয়কর কর্তৃপক্ষের হয়রানির কথা জানিয়েছেন যা তার মালিকানাধীন এক টেক কোম্পানিতে শেয়ার বিক্রি থেকে প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ বিলম্বিত করে, সৃষ্টি করে তারল্য সঙ্কট।
এই চিঠির জবাবে কর্ণাটক ও গোয়ার আয়কর দফতর এক বিবৃতিতে বলেছে যে সিদ্ধার্থ ৩৬০ কোটি রুপির অব্যাখ্যাত আয়ের কথা স্বীকার করেন এবং তারা অপরিশোধিত করের জন্য কলাটেরাল হিসেবে কফি ডে শেয়ার দাখিল না করা পর্যন্ত তার টেক কোম্পানির শেয়ার বিক্রি বন্ধ করে দেয়। পরে তিনি অপরিশোধিত কর দেন।
গত বুধবার এক বিৃতিতে কফি বোর্ড বলেছে, তারা ঋণ হ্রাসের পথ বের করতে একটি কমিটির সাথে আলোচনা করছে। সে সাথে চিঠিতে বিবৃত লেনদেন বিষয়ে তদন্ত করবে।
মুম্বাই ভিত্তিক প্রাইভেট ইক্যুইটি ফার্ম ক্রিসক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির এক অংশীদার বলেন, তারল্য সঙ্কট বাস্তব। আমরা সবাই ভারতে কৃষকদের আত্মহত্যার কথা বলি। কিন্তু আমরা ক’জন ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যর্থতায় আত্মহত্যার বিষয়টিতে গুরুত্ব প্রদান করি? বিনিয়োগকারীরা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ, এবং প্রায়শই শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা একা হয়ে যান।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।