Inqilab Logo

রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

প্রিয়া সাহার মিথ্যাচার বনাম রাষ্ট্রদ্রোহিতা!

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক | প্রকাশের সময় : ৩১ জুলাই, ২০১৯, ১২:০১ এএম

বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক (সম্প্রতি বহিষ্কৃত) প্রিয়া সাহা ও আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যকার কথোপকথন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। প্রিয়া সাহার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেনি। ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশের বিপক্ষে নালিশ চক্রান্ত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। গত ১৬ জুলাই ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার ২৭ ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেখানে ১৬টি দেশের প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করে। সেখানে প্রিয়া সাহাও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান। তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান নিখোঁজ রয়েছেন। দয়া করে আমাদের লোকজনকে সহায়তা করুন। আমরা আমাদের দেশে থাকতে চাই। এরপর তিনি বলেন, এখন সেখানে ১ কোটি ৮০ লাখ সংখ্যালঘু রয়েছে। আমরা আমাদের বাড়িঘর খুইয়েছি। তারা আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, তারা আমাদের ভূমি দখল করে নিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো বিচার পাইনি। ভিডিওতে দেখা গেছে, এক পর্যায়ে ট্রাম্প নিজেই সহানুভূতিশীলতার স্বরূপ এই নারীর সঙ্গে হাত মেলান। কারা এমন নিপীড়ন চালাচ্ছে? ট্রাম্পের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রিয়া সাহা বলেন, ‘দেশটির মৌলবাদীরা এসব করছে। তারা সবসময় রাজনৈতিক আশ্রয় পাচ্ছে।’

মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বলা প্রিয়া সাহার দেয়া বক্তব্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অনেকে ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে বলছেন, প্রিয়া সাহার দেয়া সমস্ত বক্তব্য মিথ্যা ও বানোয়াট। বিষয়টি অসা¤প্রায়িকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত উপস্থাপনকারী বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করেছে বলে মত দিয়েছেন অনেকেই। এ প্রসঙ্গে বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশের ধর্মীয় স¤প্রীতির বহু উদাহরণ তুলে ধরছেন বিজ্ঞজনেরা। ৭১ এর চেতনায় গঠিত যে দেশে সব ধর্মের নাগরিক সমান অধিকারে সহাবস্থান করে বিশ্বে অসা¤প্রদায়িকতার মডেল হিসেবে পরিণত হয়েছে সেই দেশ নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে প্রিয়া সাহার এমন বক্তব্য কখনই মেনে নেয়ার মতো নয় বলেও অভিমত দিচ্ছেন সচেতনরা।

এবার আসল কথায় আসি। দেশপ্রেম কারে কয়? ‘দেশপ্রেম’ ধারণাটি প্রাচীন হলেও এর ব্যবহার প্রাত্যহিক। ‘দেশপ্রেমিক’ শব্দটি সম্ভবতঃ ইংরেজি ‘প্যাট্রিয়ট’ শব্দের বঙ্গানুবাদ। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আধুনিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সমস্ত ধারণাই বঙ্গজনেরা পেয়েছেন ইংরেজি শেখার পর। সুতরাং ‘দেশপ্রেমিক’-এর আগমন ‘প্যাট্রিয়ট’ থেকেই হয়ে থাকবে। দেখা যাক, অক্সফৌর্ড ডিকশনারীতে ‘প্যাট্রিয়ট’ বলতে কী বুঝানো হয়ছে। অক্সফৌর্ড ডিকশনারী নির্দেশ করে নিশ্চিত করছিঃ তিনিই দেশপ্রেমিক, যিনি দেশকে প্রবলভাবে সমর্থন করেন এবং দেশকে রক্ষা করতে শত্রু বা অনিষ্টকারীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে প্রস্তুত রয়েছেন। এ সংজ্ঞায় রয়েছে ‘দেশ’কে ‘সাপোর্ট করা ও ‘ডিফেন্ড’ করার ধারণা।

এখন জানা যাক দেশ বলতে কী বুঝায়? দেশ বলতে বুঝায় একটি সরকারের পরিচালনায় একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অধীন, একটি জনগোষ্ঠী সমেত একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ড। এই সত্ত্বাগুলোকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেশপ্রেম হয় না। শুধু মাটির প্রতি ভালোবাসাই দেশপ্রেম নয়। আজ যে-ভূখন্ডকে নিয়ে বাঙালী দেশপ্রেমে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইছে, সেই মাটিতে তারা এক সময় গেয়েছে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। এখন পূর্ববর্তী কোনোটিই আর দেশপ্রেমের গান নয়।

বাঙালী পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জনজাতি। এ জাতিকে ধ্বংসের জন্য যুগে যুগে নানা ষড়যন্ত্র চলেছে, এখনও প্রিয়া সাহারা অব্যহত রেখেছে। জন্মভূমিকে ভালবাসেনা এমন মানুষ কমই আছে। মাতৃভূমির কাছে মানুষের ঋণ অশেষ। তাই মানুষ যে দেশে জন্মগ্রহণ করে সে দেশের কল্যাণ ও তার মানুষের উপকার সাধন তার একান্ত কর্তব্য। যিনি তা করেন না প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি মানুষ নামের অযোগ্য।

এবার প্রিয়া সাহার রাষ্ট্রদ্রোহিতা নিয়ে আইনে কি আছে তা দেখা যাক। যদি কোন ব্যক্তি উচ্চারিত বা লিখিত কথা বা উক্তি দ্বারা, কিংবা চিহ্নাদি দ্বারা কিংবা দৃশ্যমান প্রতীকের সাহায্যে কিংবা অন্য কোনভাবে বাংলাদেশে আইনানুসারে প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা করার চেষ্টা করে, তাহলে সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কিংবা যে কোন কম মেয়াদের কারাদন্ডে যার সহিত জরিমানা যুক্ত করা যাবে কিংবা তিন বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের কারাদন্ডে দন্ডিত হবে এবং তৎসহ তাতে জরিমানাও দÐিত করা যাবে, কিংবা তাকে জরিমানায় দন্ডিত করা যাবে।

রাষ্ট্রদ্রোহিতার উপরোক্ত সংজ্ঞা থেকে আমরা পেলাম যে, কথা, কাজ এবং লেখার মাধ্যমে যা প্রকাশ পায় তা যদি হিংসাত্মক কার্যকলাপে উৎসাহ প্রদান করে বা বিশৃংখলা সৃষ্টিতে উসকানি যোগায় বা ঐ ধরনের কোন কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে তবে তা রাষ্ট্রদ্রোহিতা আওতায় পড়বে এবং তা ১২৪ক ধারা অনুযায়ী দন্ডনীয় হবে। দন্ডবিধির ১২৪-ক ধারায় যে ব্যাখ্যা সংযোজিত হয়েছে তা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, কঠিন ভাষায় সরকারকে সমালোচনা করলেই তা অপরাধ হয় না। যখন লিখিত বা উচ্চারিত কথা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে তখনই শুধু আইন তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় ((PLD 1976 (SC) 78)। আসামী যা বলেছেন তার সত্যতা যাচাই কারও কর্তব্য নয়। তার কথায় যদি জনগনের মনে আইনানুগত্য সৃষ্টি হয় তবে এই ধারায় অপরাধ হবে। মানুষের মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে শত্রুতার ভাব জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করা এই ধারায় অপরাধ(PLD 1965 (Dhaka) 478)|

১৯৬২ সালের কেদার নাথ সিং বনাম বিহার রাজ্যের এক মামলায় সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ রায়ে এই ১২৪-এ নম্বর ধারার প্রয়োগ সীমিত করে দিয়েছিলেন কিন্তু বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বা সহিংসতা উসকে দেওয়ার মতো কাজের ক্ষেত্রে এই ধারা প্রয়োগ করা যাবে বলে মত দিয়েছেন। মহাত্মা গান্ধী ১৯২২ সালে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায় স্বীকার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এই আদালতের কাছে আমার এটা লুকানোর কিছু নেই যে বিদ্যমান সরকারব্যবস্থার প্রতি আমার বিরাগ প্রকাশ করাটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।’ তেমনি প্রিয়া সাহা’দের মতো মানুষদের। বিদ্যমান সরকারব্যবস্থার প্রতি তাদের বিরাগ প্রকাশ করাটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মিথ্যাচার ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে প্রিয়া সাহাদের বিচার হোক, জনমনে শান্তি ফিরে আসুক।

লেখক: আইন গ্রন্থ প্রণেতা



 

Show all comments
  • Jakir Ahmed Razu ৩১ জুলাই, ২০১৯, ৭:৫০ এএম says : 1
    মিথ্যাচার ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে প্রিয়া সাহাদের বিচার হোক, জনমনে শান্তি ফিরে আসুক। সহমত পোষণ করছি।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রিয়া সাহা


আরও
আরও পড়ুন