পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পানি ছাড়া চলে না; পানি আমাদের প্রয়োজন, অতি প্রয়োজন বা পানির অপর নাম জীবন এটা বললেই কথা শেষ হবে না। ‘পানি যে কোন দেশ বা ব্যক্তির জন্য এক অতিপ্রয়োজনীয় বড় সম্পদ’। এই ‘পানিসম্পদ’ ছাড়া তাবৎ পৃথিবীর সম্ভ্যতা ও মানুষের জীবনধারণ অসম্ভব। পানি না থাকলে শুধু যে তৃষ্ণা মেটানো যাবে না, তা নয়; ক্ষুধা নিবারণও অসম্ভব হয়ে পড়বে। পানি ছাড়া চাষবাদও যেমন সম্ভব নয়, তেমনি কল-কারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠান, সবকিছুই অচল। পানি ছাড়া টেকসই উন্নয়নও অসম্ভব। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য দেশে শিল্পায়ন যেমন প্রয়োজন, শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে তদ্রæপ পানিরও প্রয়োজন। এজন্য বরাবর দেশে পানির চাহিদা বাড়বে। কিন্তু দেশ ভবিষ্যতে সে চাহিদা কতটুকু মেটাতে পারবে, সেটাই দেখার বিষয়।
শহরের বিত্তবান ও গরিবদের পানির ব্যবহারে অস্বাভাবিক অসমতা উঠে এসেছে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) একটি গবেষণায়। গত ১৮ জুলাই মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টার ইন মিলনায়তনে গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করা হয়। ঢাকার পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে এই গবেষণায় বলা হয়, জনপ্রতি প্রতিদিন পানির ব্যবহার হওয়া উচিত ১৫০ লিটার। কিন্তু বস্তি এলাকার বাইরে যারা থাকেন, তারা প্রতিদিন গড়ে ৩১০ লিটার করে পানি ব্যবহার করেন। সবচেয়ে বেশি পানির ব্যবহার হয় গুলশান-বনানী এলাকায়। এসব এলাকার বাসিন্দারা গড়ে ৫০৯ লিটার করে পানি ব্যবহার করেন। আর বস্তির বাসিন্দা বা নি¤œ আয়ের মানুষ প্রতিদিন মাত্র ৮৫ লিটার পানি ব্যবহার করেন। সার্বিকভাবে দেখা যায়, ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানির ব্যাপক অপচয় করছেন সমাজের বিত্তবানেরা। অথচ পানির চরম সংকটে আছেন নি¤œবিত্তরা। তারা প্রয়োজন অনুযায়ী পানি পান না। পানি ব্যবহারের এই অসমতা ঠেকাতে এবং অপচয় বন্ধ করতে গবেষণাটিতে বিদ্যুতের বিলের মতো বেশি ব্যবহারে বেশি বিল ধরার সুপারিশ করা হয়েছে।
ঢাকায় সচ্ছল একটি পরিবার শুধু টয়লেটের কমোড ফ্ল্যাশ করে দিনে যতটা পানি খরচ করে, তা দিয়ে বস্তির একটি পরিবার খাবার, রান্না, গোসলসহ সব কাজ চালাতে পারে। অথচ দুটি পরিবারকে একই দামে সরকারের কাছ থেকে পানি কিনতে হয়। ওয়াসার এই পানিতে ধনী ও নি¤œবিত্ত পরিবার ভেদে সরকারের ভর্তুকিতে কোনো বেশি-কম নেই। ধনী পরিবারটি হেলায়-ফেলায়, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, পানির অপচয় করার সুযোগ পায়। অথচ বস্তির পরিবারটি অনেক হিসেব ও টানাটানি করেও অতিপ্রয়োজন মেটাতে পারেন না। পানি সরবরাহকারী একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসার তথ্য এবং নগরবাসীর পানি ব্যবহারের মানদÐ বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তির শুধু ‘অপচয়ের’ পানি দিয়ে একটি পরিবারের সারা দিনের খরচ চলে! এটা অন্যায্য। সচরাচর ধনী পরিবারে একবার কমোড ফ্ল্যাশ করলে ১৫ লিটার পানি যায়। এটা অপচয়। এজন্য সরকার যদি কমোডে পাঁচ লিটার ক্ষমতার লোডাউন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে, তাহলে পানির অপচয় অনেক কমে আসবে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটার এইডের গবেষণায় এসেছে, শহরে স্বচ্ছল একটি পরিবারে পানি ব্যবহারের ধরনে দেখা গেছে, সরবরাহ করা পানির ২২ শতাংশ কমোড ফ্ল্যাশের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অথচ একটি নি¤œ আয়ের গোটা পরিবার দৈনিক এর চেয়ে অনেক কম পানি পেয়ে থাকে। বিষয়টি খুবই অমানবিক। এরচেয়ে বৈষম্যমূলোক বিষয় আর কি হতে পারে! নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পানি সমমূল্য দিয়েও কেনো গরিবেরা কম পাবেন? এই জন্য আয় ও পানির ব্যবহারের ভিত্তিতে পানির বিল নির্ধারণের জন্য দাবি তুলেছেন অধিকারকর্মীরা। পানির অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন তারা বলেন, সরকারের ভর্তুকি দেওয়া পানি কেউ অপচয় করবে বা ইচ্ছেমতো ব্যবহার করবে, এটা অন্যায়। এ জন্য যত কঠিন হোক, আয় ও ব্যবহারের ভিত্তিতে পানির মূল্য নির্ধারণ করা জরুরি।
ইতোপূর্বে জার্মানির সোশাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য উলা বুরশার্ড্ট নিরাপদ পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে তার দেশকে আরো দায়িত্বশীল হওয়ার আহবান জানিয়ে বলেন, ‘জার্মানি পানির অধিকার নিশ্চিতে সঠিক পথে থাকলেও তিনি মনে করেন, অন্যদের সমস্যার জন্যও তাদের দায় রয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের এই সমস্যার জন্য আমরাও কিছুটা দায়ী। তিনি বলেন, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন দুটোই মানুষের অধিকারের মধ্যে পড়ে। কিন্তু কয়েকশ’ কোটি মানুষের সেই অধিকারের স্বীকৃতি নেই, এটা দুঃখজনক।’
স¤প্রতি ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ২০০ কোটি মানুষ পরিস্কার ও নিরাপদ পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এই সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ভোগেন দরিদ্র আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। জাতিসংঘের ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০১৯’ অনুযায়ী, বিশ্বের ২১০ কোটি মানুষ নিরাপদ ও পানযোগ্য পানির প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত। এমনকি ৪৩০ কোটি মানুষ এখনো স্যানিটেশন সুবিধা পান না। ‘পানি সম্পদের ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সুবিধার প্রাপ্যতা, দারিদ্র্য দূরীকরণ, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সমাজ, টেকসই উন্নয়নের জন্য আবশ্যক,’ এমন মন্তব্য করেছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিলো, লিভিং নো ওয়ান বিহাইন্ড, অর্থাৎ কাউকে পেছনে ফেলে নয়। ভবিষ্যতে পৃথিবীতে পানির সংকট তৈরি হবে এমন পূর্বাভাস দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পরিবেশগত বিপর্যয় ও পানির অভাবে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৪৫ ভাগ এবং বিশ্বের শস্য উৎপাদনের ৪০ ভাগ ক্ষতিগ্রস্থ হবে বলে এতে আভাস দেয়া হয়েছে।
খাদ্যের অপচয় হলে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কিন্তু সমাজের প্রায় প্রতি স্তরে প্রতিদিনই নানাভাবে পানির অপচয় হচ্ছে, সে বিষয়ে কারোই যেন খুব একটা মাথা ব্যথা নেই। অথচ খাদ্যের অপচয় মানে পানিরও অপচয়। মানুষ যে পরিমাণ পানি ব্যবহার করে তার প্রায় ৭০ ভাগই খরচ হয় খাদ্য উৎপাদনে। এক গবেষণায় এসেছে বিশ্বে প্রতি বছর যে খাদ্যের অপচয় হয়, ওই অপচয়িত খাদ্য উৎপাদনের জন্যই ব্যয় হয় প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি।
বিআইজিডির কর্মসূচি ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম ওই গবেষণায় সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘বস্তি এলাকার বাসিন্দাদের দিনে গড়ে ১৫০ লিটার পানি ব্যবহার করার কথা। কিন্তু তারা গড়ে প্রতিদিন ৬৫ লিটার পানি কম ব্যবহার করছে’। গবেষণায় দেখা গেছে, ৩২ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে পানির সংকটে ভোগে। অথচ উচ্চবিত্তরা যে হারে পানির বিল দেয়, তারাও সেই হারে বিল দেয়। গবেষণায় ওয়াসার সরবরাহ করা পানির নি¤œমানের বিষয়টিও উঠে এসেছে। এতে দেখা গেছে, ৩৩ শতাংশ ব্যবহারকারী পানির বাদামি রং, ২৭ শতাংশ অস্বচ্ছ ও ৪৯ শতাংশ ব্যবহারকারী নোংরা পানি পাওয়ার কথা জানিয়েছে। এ ছাড়া ওয়াসার পাম্প স্টেশন, বাসাবাড়ির ভূগর্ভস্থ ট্যাংক বা রিজার্ভার ও ছাদের ওপর পানির ট্যাংক থেকে পাঁচটি করে নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণাগারে পরীক্ষা করা হয়েছে। পাম্প স্টেশনের পাঁচটি নমুনার একটিতে দূষিত পানি, ভূগর্ভস্থ ট্যাংকের চারটিতে এবং ছাদের ওপর ট্যাংকের পাঁচটি নমুনাতেই দূষণ পাওয়া গেছে।
ঢাকার পানির চাহিদা পূরণ করাটা ভবিষ্যতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়াবে। কারণ, বেশীরভাগ মানুষ অবহেলায়, অসচেতনতায় বিপুল পরিমাণ পানির অপচয় করছে। অথচ ইচ্ছা করলেই এই অপচয় রোধ করে কোটি কোটি লিটার পানির অপচয় হ্রাস করা সম্ভব। কিন্তু সেই ইচ্ছেটাই মানুষ করে না! শহরগুলোতে বৈদ্যুতিক পাম্প মেশিন দ্বারা ভবনের রিজার্ভ জলাধারে ও ছাদের ট্যাংকিতে কোটি কোটি লিটার পানি তোলা হয়। সে পানি ব্যবহার করার জন্য বাড়িতে, অফিসে, মসজিদে, যে সব পানির কল ব্যবহৃত হয় তার সিস্টেমেই সমস্যা। হাতমুখ ধোয়া, দাত ব্রাশ করা বা অযু করার সময় এই কল যখন খুলে থাকেন, তখন অব্যাহতভাবে পানি পড়তে থাকে। এভাবে একজন মানুষ প্রতিদিন ব্যাপক পানির অপচয় করে থাকেন। যদি সচেতনতার সাথে প্রয়োজনীয় পানি ব্যবহার করে, কল বন্ধ করে আবার খুলে অথবা অন্য একটা পাত্রে তার প্রয়োজনীয় পানি নিয়ে ব্যবহার করলে এই অপচয় রোধ করা যেত। কিন্তু সেই বোধশক্তি প্রয়োগের মানসিকতা বলতে গেলে ৯৯ ভাগ মানুষের মাঝেই নেই। সুতরাং এই অপচয় থেকে বাঁচতে হলে রাষ্ট্রকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। আর তা হলো, বাজারে প্রচলিত পানির কল উৎপাদন ও আমদানি বন্ধ করে, এর পরিবর্তে এমন কল ব্যবহার করতে হবে, যে কলের শুধু চাপ দিলেই পানি পড়বে ও বন্ধ হয়ে যাবে। এতে করে মানুষ ঝামেলামুক্তভাবে যেকোন হাত ব্যবহার করেই পানির ট্যাপ বন্ধ ও অপচয় রোধ করতে পারবে। অধিকাংশ মানুষই সাধারণত নিজের ইচ্ছায় কখনো কোন নিয়ম মেনে চলেন না। কিন্তু তাদেরকে স্বাভাবিক নিয়মের গÐিতে নিয়ে আসতে পারলে, তাতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। সুতরাং রাষ্ট্র ইচ্ছে করলেই প্রতিদিন কোটি কোটি লিটার পানির অপচয় থেকে দেশকে বাঁচাতে পারে।
দেশের ধনী-গরিব সকলকে পানির অপচয় রোধে সচেতন হতে হবে। সমাজের বিত্তবানরা যদি একটু কম অপচয় করেন, তাহলে দরিদ্র মানুষের পানির অভাব দূর হবে। পানির ব্যবহারে সকলকে সচেতন হতে হবে। দেশের কথা ভেবে, সমাজের কথা ভেবে, যার যার অবস্থান থেকে দায়ীত্বশীল ও সচেতন হলে পানির সংকট দূর করা সম্ভব হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।