Inqilab Logo

বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মানবিক মূল্যবোধ পেছনে ফেলে আমরা এ কোন উন্নয়নের পথে

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ২৬ জুলাই, ২০১৯, ১২:০২ এএম

বাংলাদেশের মানুষ কি দিন দিন চিয়াত কৃষ্টি, সংস্কৃতি, নীতি-নৈতিকতা, পারিবারিক-সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় বিধি-নিষেধ ও অনুশাসন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে? এ প্রশ্ন এখন খুব বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এর কারণ দেশের বিভিন্ন জনপদে একের পর এক যেসব অকল্পনীয় ও শিউরে উঠার মতো ঘটনা ঘটে চলেছে, এসব ঘটনা কোনোভাবেই আমাদের পরিবারিক, সামাজিক এবং মানুষের আচার-আচরণের সঙ্গে মিলে না। এ দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, আদব-কায়দা ও মায়া-মমতার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করা। পরিচিত হোক আর অপরিচিত হোক, একের দুঃখে অপরের দুঃখিত হওয়া, সহমর্মীতা প্রকাশ করা, বিপদে ছুটে যাওয়া কিংবা পাশে দাঁড়িয়ে সান্ত¦না দেয়া। তরুণ সমাজ বেয়াদবির পথে ধাবিত হলে, তাকে বারণ করা। সমাজে অসঙ্গতি দেখা দিলে, সামাজিকভাবে তা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া, এমনকি পারিবারিক কলহ মিটাতেও এগিয়ে আসা। বাংলাদেশের মানুষের বৈশিষ্ট্য তো এই যে, তারা সমাজ ও পরিবারে শান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে সবসময়ই সচেতন। এমনকি অতিথিপরায়ণতার দিক থেকেও অতুলনীয় বৈশিষ্টের অধিকারী। গাঁয়ের পথ ধরে কোনো তৃষ্ণার্ত পথিক কোনো বাড়িতে গিয়ে এক গøাস পানি চাইলে বাড়ির কর্তাব্যক্তি শুধু এক গøাস পানি নিয়ে আসেন না, সাথে একবাটি মুড়ি-মিঠাইও নিয়ে আসেন। চেনা নেই জানা নেই, এমন ব্যক্তিকে অতিথি ভাবার মতো এমন মানুষ কি দুনিয়ার আর কোথাও আছে? এই সময়ে এসে দেশের মানুষের চিরায়ত এই চরিত্র যেন হারিয়ে যাচ্ছে। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন আলগা হয়ে যাচ্ছে। মানুষ ক্রমেই যেন নিষ্ঠুরতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। জনসম্মুখে একজন আরেক জনকে খুন করার দৃশ্য অবলীলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। সন্দেহের বশবর্র্তী হয়ে একজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলার জন্য মহাউল্লাসে ঝাপিয়ে পড়ছে। কেউ আবার শিশু হত্যা করে তার মাথা ব্যাগে ভরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। ধর্ষণের মাত্রা যে হারে বেড়েছে তাতে আমাদের সমাজকে অনেকে ধর্ষক সমাজ বলে অভিহিত করছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ কেউই ধর্ষকের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ধর্ষক শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, খুনও করছে। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন চারদিকে ধর্ষকের চোখ নারীদের তাড়া করে ফিরছে। দেখা যাচ্ছে, মানুষের মধ্যে আদিমতা এবং হিং¯্র পশু চরিত্র এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, তা আমাদের চিরায়ত সামাজিক ও পারিবারিক বৈশিষ্ট্যকে ¤øান করে দিচ্ছে। একটা কথা প্রচলিত রয়েছে যে, সমাজে ভাল মানুষের সংখ্যা বেশি, খারাপের সংখ্যা কম। এখন দেশে একের পর এক যেসব অভাবনীয় ও অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটছে, তাতে মনে হচ্ছে এ কথা শুধুই কথার কথায় পরিণত হচ্ছে। তা নাহলে সমাজের ভাল মানুষগুলো গেল কোথায়? তারা কি মন্দের কাছে আত্মসমর্পণ বা বশ্যতা শিকার করে চুপ মেরে বসে রয়েছে? আপাত দৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছে। আবার এর বিপরীতে বলা যায়, দেশ যারা শাসন করছেন তারা কি ভাল মানুষের দলে নেই? ভাল মানুষের দলে হলে তাদের শাসন কোথায়? অনেকে বলেন, তাদের শাসন আছে, সুশাসন নেই। এই সুশাসন নেই বলেই এতসব ভয়ংকর ঘটনা ঘটে চলেছে।

দুই.
একটি দেশের সরকার যারা চালায় তাদের শাসনকালে পরিবার ও সমাজ যদি অস্থির-অস্থিতিশীল এবং নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় তীব্র হয়ে ওঠে, হত্যাকাÐের মতো অপরাধ লাগামহীন হয়ে পড়ে, তবে তার দায় সরকারের উপরই বর্তায়। বিগত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে যেসব খুন, গুম, ধর্ষণসহ অমানবিক ঘটনা ঘটছে, তার দায় সরকারেরই এবং তার সুশাসনের অভাবকেই নির্দেশ করছে। আবার এসব খুন, গুমের পেছনে যখন রাষ্ট্রের কিছু সংস্থার প্রচ্ছন্ন হাত থাকার অভিযোগ ওঠে, তখন তো সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বলে কিছু থাকে না। এখন পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যারা জনগণকে নিরাপত্তা দেবেন তারাও গানম্যান নিয়ে চলাফেরা করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মন্ত্রী-এমপিদের অনেকে নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্যে চলাফেরা করেন। গানম্যান বা নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া চলাচল তারা চিন্তাই করতে পারেন না। যে দেশে সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধিদেরই নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, সেখানে সাধারণ জনগণের অবস্থা কি, তা বোধ করি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কাদের ভয়ে নিজেদের সুরক্ষিত করে চলাফেরা করেন? তারা কি সাধারণ মানুষকে ভয় পান? নাকি সন্ত্রাসী বা দুষ্কৃতিকারীদের? যদি তাই হয়, তবে এই সন্ত্রাসীরা সমাজে বিচরণ করছে কিভাবে? তারা কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা জনপ্রতিনিধিদের চেয়ে শক্তিশালী? এ থেকে কি এটাই প্রতীয়মাণ হয় না, তারা সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা না করে সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতিকারীদের প্রশ্রয় দিয়ে এক শ্বাপদসংকুল পরিবেশ সৃষ্টি করে দিচ্ছেন? আর এই পরিবেশের মধ্যেই সরকার উন্নয়নের শ্লোগান দিচ্ছে? যেখানে সাধারণ মানুষ নিরাপদ নয়, পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খল ভেঙ্গে পড়ছে, মানুষের নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ তলানিতে চলে যাচ্ছে, মানবিক গুণগুলো ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছেÑএক অসহনীয় পরিস্থিতি ও বিশৃঙ্খলভাবে সমাজ এগিয়ে চলছে, সেখানে এসব উন্নয়ন কি কোনো কাজে আসবে? মানুষই যদি নিরাপদ না থাকে, হিং¯্র হয়ে ওঠেÑতাহলে এ উন্নয়ন দিয়ে কি হবে? এ কথা তো চিরসত্য যে, মানুষ আগে সমাজবদ্ধ ও সামাজিক হওয়ার পর নিজেদের সভ্য করে ও নীতি-নৈতিকতাবোধের মাধ্যমে উন্নয়নের দিকে এগিয়েছে। পৃথিবীতে যত উন্নয়ন হয়েছে তার মূল ভিত্তিই হচ্ছে মূল্যবোধ ও মানবিকতা। আমাদের দেশের মানুষ ধন-সম্পদে ঐশ্বর্যশালী না হলেও তাদের মূল সম্পদ নীতি-নৈতিকতা, মায়া-মমতা ও মূল্যবোধ। কেউ না খেয়ে থাকলেও মান-সম্মান খোয়ানোর ভয়ে অসম্মানজনক কাজে জড়ায় না এবং অন্যকে জড়াতে দেখলে তাতে বাধ সাধে। এই মূল্যবোধকে ভিত্তি করেই আমাদের দেশের মানুষ এগিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, বিগত একদশক ধরে চিরায়ত এই বৈশিষ্ট্যে চরম ধস নেমেছে। বিশ্লেষকদের অনেকেই বলেন, এটা তখন থেকেই শুরু হয়েছে, যখন সরকারের পক্ষ থেকে উন্নয়নের জিকির তোলা হয়েছে। প্রচ্ছন্নভাবে এমন একটি আবহ সৃষ্টি করা হয়েছে, যে যেভাবে পারো উন্নতি করো, অর্থ কামাই করো। সোনালি ব্যাংক দুর্নীতির কেলেঙ্কারিতে সাবেক অর্থমন্ত্রী যখন বলেছিলেন, সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা কিছুই নয়, তখন সারাদেশের মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিল। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কারো কাছ থেকে যখন দুর্নীতি নিয়ে এমন প্রশ্রয়মূলক কিংবা দুর্নীতিকে প্রকারন্তরে স্বীকৃতি দেয়ার মতো মন্তব্য করা হয়, তখন নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ বিস্মিত হলেও, দুর্নীতিবাজরা ঠিকই মহাউল্লাসে বগল বাজিয়েছে। এই প্রশ্রয়ই দুষ্টু চক্রকে আরও দুর্বীনিত করে তুলেছে এবং তা সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ‘যেভাবে পারো অর্থ কামাও’ এমন একটা অপসংস্কৃতি ধীরে ধীরে জায়গা করে নিয়েছে। মানির সাথে মাসল বা অর্থের সাথে পেশি শক্তি যুক্ত হয়ে গেছে। ফলে দেখা যায়, দেশের এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে সরকারি দলের একশ্রেণীর লোকজন ও প্রভাবশালীরা নেপথ্যে থেকে দুষ্টুচক্র গড়ে তোলেনি। তাদের ভয়ে সাধারণ মানুষের টু শব্দ করার জো নেই। তাদের প্রশ্রয়ে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে কুপিয়ে মানুষ মেরে ফেললেও প্রতিকার পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, আমরা কি উন্নয়ন করছি? উন্নয়ন মানে কি মানবিকতাকে বিসর্জন দেয়া? পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনকে ছিন্নভিন্ন করে অর্থের দিকে ছুটে যাওয়া? যে মানুষের জন্য উন্নয়ন, তারা যদি অমানবিক হয়ে উঠে, অসহায় হয়ে পড়ে, তবে এ উন্নয়ন কি কোনো কাজে আসবে? আমাদের সমাজে এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে এবং এমন অনেক পরিবার রয়েছে, যাদের অঢেল ধন-সম্পদ রয়েছে, তাদের পরিবারে সুখ-শান্তি বলে কিছু নেই। স্বামী-স্ত্রী, সন্তান সম্পদের মধ্যে থেকেও অসুখী। এর অন্যতম কারণ অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে তারা অর্থের মোড়কে ঢেকে দিয়েছে। এ কথা কেউই অস্বীকার করে না, জীবনে অর্থের প্রয়োজন নেই। তবে সেই অর্থ উপার্জন যদি পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধকে বিসর্জন বা উপেক্ষার মধ্য দিয়ে হয়, তবে তা যে চরম অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, এখন হাড়েহাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে। রাষ্ট্রকেও যদি একটি বিশাল পরিবার ধরা হয় এবং তার পরিচালকও যদি সেই পরিবারের সদস্যদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, সুশাসন বাদ দিয়ে কেবল উন্নয়নের দিকে ছোটে, তাহলে সেই রাষ্ট্র কখনোই সুষম ও টেকসই উন্নয়ন এবং উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতে পারে না। আমাদের দেশের উন্নয়ন এখন এ ধারাই হচ্ছে। সরকার উর্ধশ্বাসে উন্নয়নের দিকে ছুটছে। মাথাপিছু আয় ও জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির পেছনে ছুটে চলেছে। একটা সময় দেখা যাবে, যে মানুষের জন্য সরকার রকেট গতিতে ছুটছে, সেই মানুষই যোজন যোজন দূরে পড়ে রয়েছে।

মানুষের মধ্যে এই ভয়ংকর নৃশংস মানসিকতা সৃষ্টির কারণ কি? এ প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ যদি ধরা হয় অর্থ এবং এর প্রতি মানুষের প্রবল আকর্ষণ, তবে এ কথাও তো বলা যায়, অর্থের টানাপড়েনের মধ্যে বাংলার মানুষ যুগযুগ ধরেই ছিল, সে সময়ও মানুষ তার নৈতিক চরিত্র হারায়নি। অভাবের মধ্যেও তার নীতি-নৈতিকতা বেশ টনটনে ছিল। আমরা এখন এমন এক সমাজে বসবাস করছি, যেখানে মান-সম্মান ইজ্জতকে কেউ আর তোয়াক্কা করছে না। অনেকের মধ্যে এমন একটা প্রবণতা বিরাজমান, ভাল মানুষ না হলেও অর্থ-বিত্তের মালিক হতে পারলে মান-সম্মান কেনা যাবে। দেখা যাচ্ছে, সমাজের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ ও চিহ্নিত সন্ত্রাসীই সমাজের নিয়ন্তা হয়ে বসে আছে। তার অর্থ আছে গায়ের জোরও আছে। সে মনে করছে এই দুই শক্তি থাকলে মান-সম্মান এমনিতেই পায়ে লুটিয়ে পড়বে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, আমরা সম্মিলিতভাবেই তার অবস্থানকে শক্ত করার সুযোগ করে দিচ্ছি। আমাদের মধ্যে যাদের এখনও একটু-আধটু সুকুমারবৃত্তি রয়েছে, তারা কোনোভাবেই এক হতে পারছি না। একেক জন যেন আলাদা হয়ে বিচ্ছিন্ন দ্বীপবাসী হয়ে বসবাস করছি। কে মরল আর কে মারল, এ নিয়ে কোনো বাদ-প্রতিবাদ করি না। কীভাবে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে হয়, তা জেনেও উদ্যোগী হচ্ছি না। আমাদের দুর্বলতার এ সুযোগটাই নিচ্ছে সমাজের মাথা হয়ে থাকা দুষ্টচক্র। শুধু সমাজের এই দুষ্টচক্র নয়, রাজনীতি থেকে রাষ্ট্র পরিচালকরাও এ সুযোগ নিচ্ছে। তারা জানে, হুমকি-ধমকি দিয়ে আমাদের ভীত করতে না পারলে কোনোভাবেই তাদের দুষ্কর্মের রাজত্ব কায়েম করতে পারবে না। আর আমরাও আমাদের নৈতিক মূল্যবোধ প্রাধান্য না দিয়ে ঐসব ভীতিসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর হুমকি মেনে নিচ্ছি। আর হুমকি-ধমকি প্রদানকারী চক্র তাদের প্রাধান্য ধরে রাখার জন্য একের পর এক এমনসব ইস্যু সৃষ্টি করছে, যাতে দেশের মানুষ তার চিরায়ত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ফিরে যেতে না পারে। এর ফলে আমাদের অবদমিত সুকুমারবৃত্তি প্রায়ই ভয়ংকর আকার ধারণ করে। মা সন্তানকে, সন্তান পিতা-মাতাকে, স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে, শিক্ষক ছাত্রকে, ছাত্র শিক্ষককে হত্যার মতো ঘটনা অবলীলায় ঘটছে।

তিন.
বাংলাদেশের ৯২ ভাগ মানুষ মুসলমান। একটা সময় এদেশে শিক্ষার হার খুবই কম ছিল। বলা হয়, অশিক্ষিত জাতি ও বর্বর জাতির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য থাকে না। তবে এ কথা যে আমাদের দেশের মানুষ কোনো দিনই মানেনি, তা তাদের আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। তাদের শিক্ষার ভিত্তি হয়েছিল, ধর্মীয়, পারিবারিক-সামাজিক মূল্যবোধ, বিধি-নিষেধ এবং অনুশাসন। এসব গুণাবলী আঁকড়ে ধরে বাংলার মানুষ অতুলনীয় মানবিকতার প্রতীকে পরিণত হয়। তারা নিজেদের আলাদা কোনো সম্প্রদায় মনে করেনি। আমরা বাংলাদেশী, এই একটি সম্প্রদায়েই বিশ্বাস করত। গত এক দশক ধরে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে তাদের এই বিশ্বাসের মূলে একটি শ্রেণী, সর্বোপরি রাষ্ট্র পরিচালকরাও আঘাত হেনে তছনছ করে দিচ্ছে। যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান, যারা কোনো দিনই সম্প্রদায়গত পার্থক্য করত না, সেই তাদের সামনেই বারবার অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে দ্বিধা সৃষ্টি করে দিচ্ছে। কয়েক বছর আগে সাবেক প্রেসিডেন্ট মরহুম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলেছিলেন। তিনি প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন, অসাম্প্রদায়িকতার মানেটা কি? এর মানে কি দেশে কোনো সম্প্রদায় থাকবে না? মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বলে কি কোনো সম্প্রদায় থাকবে না? এরা কি সম্প্রদায় নয়? সম্প্রদায় ছাড়া কি কোনো দেশ হয়? এর মাধ্যমে তিনি এটাই বোঝাতে চেয়েছেন, অসাম্প্রদায়িক কথাটা ভিত্তিহীন। সম্প্রদায়ের বাইরে কোনো জাতি বা গোষ্ঠী হতে পারে না। যারা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা বলছেন, তারা এ শব্দটির প্রকৃত অর্থ জানেন না। বাংলাদেশের তথাকথিত প্রগতিবাদীরা এই শব্দটিকে ব্যবহার করেন শুধু মুসলমানদের হেয়প্রতিপন্ন এবং আমাদের চিরায়ত মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য। যার প্রতিক্রিয়া এখন সমাজে দেখা দিয়েছে। এতে যারা সামাজিক নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা করতে চায় না, তারা দুর্বীনিত হয়ে উঠেছে। যারা তা মেনে চলেন এবং অন্যকে মানতে উদ্বুদ্ধ করেন তারা নীরব হয়ে গেছেন। তাদের এই নীরবতার সুযোগে দুষ্কৃতিশ্রেণী সমাজে আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে। দুঃখের বিষয়, যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, তাদের একটি শ্রেণী এই দুষ্কৃতিকারীদের প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। তারা এটা উপলব্ধি করছে না, আমাদের সমাজ ব্যবস্থার ধরণ কি? কোন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে তা গড়ে উঠেছে। এ বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে এমন এক বিপজ্জনক তত্ত¡ হাজির করেছে যা এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান না মেনে নিতে পারছে, না সইতে পারছে। তারা এক বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গেছে। এই বিভ্রান্তির সুযোগ নিচ্ছে একশ্রেণীর দুর্বৃত্ত শ্রেণী। কেউ ধর্মের কথা কিংবা নীতি-নৈতিকতার কথা বললেই তাকে মৌলবাদী বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। ফলে অনেকেই এই ভয়ে নীরব থেকে যাচ্ছেন। ফলশ্রæতিতে একের পর এক নৃশংসতা, খুন, গুম, ধর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার উন্নয়নের আবেশে আবিষ্ট হয়ে পড়ায় এদিকটি খেয়াল করছে না। অথচ বিশ্বের কোনো দেশই তার সামাজিক বৈশিষ্ট্য, নীতি-নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ উপেক্ষা করে উন্নয়নের দিকে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেনি। সমাজকে দ্বিধা-দ্ব›েদ্বর মধ্যে ফেলে এগোয়নি। বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্বে এখন ধর্মনিরপেক্ষতা কথাটির অস্তিত্ব বিলোপ হয়ে গেছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো এখন তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরেই এগিয়ে চলেছে। এমনকি পার্শ্ববর্তী ভারতের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখব, সেখানে তার ধর্মনিরপেক্ষতার বৈশিষ্ট্যকে বাদ দিয়েছে। সেখানে উগ্রবাদী হিন্দুদের দ্বারা মুসলমানরা আক্রান্ত হলেও তারা হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করতে উঠেপড়ে লেগেছে। হিন্দুত্ববাদকে ধারণ করেই সে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার নীতি অবলম্বন করছে। অন্যদিকে আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান যারা চিরকাল অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করে আসছে, যেখানে অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি কোনো বিদ্বেষ পোষণ করে না, সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতার তত্ত¡ ঢুকিয়ে দিয়ে এক বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে। সরকারও যেন এই মূল্যবোধকে আমলে না নিয়ে কেবল উন্নয়নের দিকে ছুটছে। মানুষের মধ্যকার মানবিকতাবোধ এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়কে বজায় রেখে এই উন্নতি কি কোনো সুফল বয়ে আনবে?

চার.
আমাদের নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অধঃপতনের যে কথা এখন উঠছে এর মূল কারণই হচ্ছে, অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার মতো একটি হাইপোথ্যাটিক্যাল কথা উপস্থাপন করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানকে মূল চেতনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। তা নাহলে মা কর্তৃক সন্তান, সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে হত্যার মতো অচিন্তনীয় ঘটনা এবং গণপিটুনি, ধর্ষণের মতো পশুবৃত্তি বেড়ে যাবে কেন? যদি এসব ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট থাকত, তাহলে এ ধরনের অকল্পনীয় ঘটনা ঘটত না। এখন রাষ্ট্র পরিচালকদের পক্ষ থেকেই বলা হয়, বাংলাদেশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। অথচ এ দুটো শব্দের অর্থ সাধারণ মানুষের কাছে পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তারা কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। যারা বুঝতে সক্ষম, তাদের মধ্যে এ প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে কি এই, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের বিশ্বাস প্রাধান্য পাবে না? আবার এই প্রশ্নও তো আসতে পারে, ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে যদি প্রত্যেক ধর্মের মানুষ পারস্পরিক সহবস্থানে থেকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করা বোঝায়, তাহলে বাংলাদেশে কি এই পরিস্থিতি নেই? রাষ্ট্র পরিচালনায় যারাই থাকুক না কেন, তাদের ধর্মের প্রতিফলন কি তাদের কর্মের উপর প্রভাব ফেলে না? যদি তা না হয়, তাহলে তো তাদের কর্মে সব ধর্মেরই প্রতিফলন থাকতে হবে। এটা কি সম্ভব? অথচ স্বাভাবিক নিয়মই হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষেই রাষ্ট্র পরিচালকদের থাকতে হয় এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের সহবস্থান নিশ্চিত করতে হয়। সারা বিশ্ব এ নিয়মেই চলছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মূল্যবোধ ও বিশ্বাস যখন রাষ্ট্র পরিচালকদের পক্ষ থেকে উপেক্ষিত হয়, তখন এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পুরো সমাজে পড়তে বাধ্য এবং সমাজে একের পর এক অস্বাভাবিক ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন