পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
কুমিল্লায় বিচারকের খাস কামরায় আসামি দ্বারা অন্য আসামি হত্যার ঘটনায় দেশের বিচার অঙ্গনে আতঙ্ক নেমে এসেছে। নজিরবিহীন এ ঘটনায় আবারো সামনে চলে এসেছে বিচারাঙ্গনের সার্বিক নিরাপত্তার প্রশ্নটি। আদালত অঙ্গনে কার দ্বারা কে কখন আক্রান্ত হয়- এই ভীতি ও সংশয় পেয়ে বসেছে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। এ ঘটনায় সরকার পক্ষ থেকে দেশের ৬৪টি আদালতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের আশ্বাস মিলেছে। নিরাপত্তা নিশ্চিতের নির্দেশনা চেয়ে রিটও ফাইল হয়েছে হাইকোর্টে। তা সত্তে¡ও কমছে না উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
কুমিল্লার ঘটনা গতকাল মঙ্গলবার ছিলো ‘টক অব দ্য কোর্ট’। বিষয়টি যখন বিচারাঙ্গন সংশ্লিষ্ট সবার মাঝেই আলোচনা চলছিল ঠিক তখন সুপ্রিম কোর্ট বারে আসামির ওপর বাদী পক্ষে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনাও বিচারাঙ্গন সংশ্লিষ্ট সবার আতঙ্ক আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আদালত সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন- তাহলে আদালত অঙ্গনে নিরাপদ কে? গতকাল মঙ্গলবার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা, আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী এবং আদালত সহায়ক কর্মচারীদের সঙ্গে কথা হয়। তারা প্রায় প্রত্যেকেই বিচারাঙ্গনের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি তুলে ধরেন। কেউ কেউ বলেন, বর্তমান বিচারব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের অনাস্থা চলে আসার বিষয়টিও।
ঢাকা জজ কোর্ট কম্পাউন্ডে অবস্থিত চিফ মেট্রোপলিটন আদালত পরিদর্শনে দেখা যায়, প্রায় সবক্ষেত্রেই বিরাজ করছে বিশৃঙ্খলা। আদালতটি উন্মুক্ত বিদায় এখানে প্রবেশে কোনো বাধা নেই। দেহ তল্লাশির মুখোমুখি হতে হয় না কাউকেই। প্রধান ফটকে আর্চওয়ে থাকলেও সেটি সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ে নেই কোনো ব্যবস্থা। এখানে বাদী, বিবাদী, অভিযুক্ত আসামি, মামলা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, আইনজীবী, আইনজীবী সহকারী, দালাল, তবদিরকারক সব একাকার। সিএমএম’র ১০তলা ভবনটি লোকে-লোকারণ্য। ৩৫টি এজলাসের হাজতখানায় প্রতিদিন গড়ে ৬শ’র মতো আসামি আসে। আসামি-পরিবারের লোকজন, তাদের আইনজীবী, সহকারী, দালাল এবং আইনজীবীতে পার্থক্য করা যায় না। নিরাপত্তা কিংবা শৃঙ্খলার বালাই নেই। মামলায় অভিযুক্ত আসামিদের বিভিন্ন হাজতখানা এবং কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে করে এনে রাখা হয় দেয়াল ঘেরা একটি ভবনে। সেখান থেকে এক এক করে হাঁটিয়ে এজলাসে নেয়া হয়। এ সময় কারো হাতে হাতকড়া থাকে কারো হাতে থাকে না। একজন আসামির বিপরীতে ৩ জন পুলিশ সদস্য নিয়োজিত থাকার কথা। অথচ একজন আসামিকে একজন নিরস্ত্র পুলিশ কনস্টেবল প্রিজনভ্যানে ওঠানো-নামানোর দায়িত্ব দেয়া হয়। এ সময় পুলিশকে প্রায়ই মোবাইলে ব্যস্ত কিংবা অমনোযোগী থাকতে দেখা যায়। এছাড়া অর্থের বিনিময়ে আসামিকে হাতকড়া না পরানোর অভিযোগ পুরনো। টাকার বিনিময়ে আসামিকে মোবাইলে কথা বলতে দেয়া, হাজিরা দিতে আনা প্রভাবশালী আসামিদের স্ত্রী-সন্তান, পরিবার-পরিজনের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলার সুযোগ করে দেয়া, এমনকি স্ত্রী ও বান্ধবীর সঙ্গে আসামিকে একান্তে সময় কাটানোর ব্যবস্থা করে দেয়ার অভিযোগও রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। নিরাপত্তাহীনতার এ বাস্তবতায় ঢাকার আদালত থেকে পুলিশের মাঝ থেকেই আসামি পালিয়ে যাওয়ার একাধিক নজির রয়েছে। তবে সিএমএম’র একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, ইতোমধ্যে কর্তৃপক্ষকে বিশৃঙ্খল পরিবেশ, নিরাপত্তাহীনতা এবং বিভিন্ন সমস্যার কথা অবহিত করা হয়েছে।
একদিকে বিচার বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, বিচারকের খাস কামরায় আসামি হত্যার ঘটনার পর কুমিল্লার তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক ফাতেমা ফেরদৌসের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। নিজের সামনেই এ ঘটনা ঘটার পর তিনি কিংকর্তব্য বিমূঢ় এবং নার্ভাস। স্বাভাবিক হতে পারছেন না। মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। তার পক্ষে এজলাসে আপাতত: বসা সম্ভব নয় বলেও জানিয়েছেন। বিচার বিভাগীয় এ কর্মকর্তা বলেন, এ ঘটনা বিচারকদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। কারণ, এ হামলা সরাসরি বিচারকের ওপরও হতে পারতো। একটি নজির স্থাপন হলে একই রকম ঘটনা একের পর এক ঘটতেই থাকে। আমরা বিচারাঙ্গনের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা ভাবলেও সার্বিক নিরাপত্তার দিকে কোনো ভ্রæক্ষেপ নেই বলেও জানান তিনি।
হাইকোর্টে কর্মরত আরেক বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা বলেন, বিচারাঙ্গনের কোনো নিরাপত্তা নেই। আদালতের নিরাপত্তায় থাকেন কিছু নিরস্ত্র পুলিশ সদস্য। আদালতকে ঘিরে বিভিন্ন অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত, দন্ডিত আসামি, বাদী-বিবাদী, আইনজীবীসহ শত সহস্ত্র লোকের আনাগোনা। সে ক্ষেত্রে আদালতের নিরাপত্তা সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়া উচিৎ। বাস্তবে আদালত অঙ্গনে কিছু সিসি ক্যামেরা, আর্চওয়ে এবং কিছু নিরস্ত্র পুলিশ ছাড়া নিরাপত্তামূলক তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। তল্লাশি চৌকি নেই। আদালত কম্পাউন্ডে প্রবেশ করতে কাউকে আইডি কার্ড দেখাতে হয় না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয় না। ফলে জনবহুল আদালত অঙ্গনে যেকোনো হত্যাকান্ড থেকে শুরু করে যেকোনো অপরাধ সংঘটিত হতে পারছে।
সুপ্রিম কোর্ট বারের আইনজীবী ব্যারিস্টার আকবর আমীন বাবুল বলেন, কুমিল্লার ঘটনা সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন। সবখানেই যে বিচারাহীনতা চলছে এটির তারই প্রতিবিম্ব। ভাবনার বিষয় হলে এরপরও আমরা কোথায় যাবো? কিছুই তো বাকি থাকলো না। খুবই উদ্বেগজনক। ঢাকা সিএমএম আদালতের কর্মচারী মো. কামাল হোসেন বলেন, কুমিল্লার ঘটনা প্রমাণ করে শুধু বিচারক নন-আদালত অঙ্গনে অবস্থানকারী বাদী-আসামি, আইনজীবী, বিচারক এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও কোনো নিরাপত্তা নেই। স্থায়ী আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে না তোলাই হচ্ছে এর কারণ।
অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, আদালতে হত্যার ঘটনা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। এটি বর্তমান মানুষের নৈতিক অবস্থার নির্দেশক। সাধারণ মানুষও যেন ক্রমশই অসহিষ্ণু এবং অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠছে। হঠাৎ হঠাৎ সেই বিষয়গুলোই আমাদের সামনে ‘অপরাধ’ হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে। শুধুমাত্র আদালতের নিরাপত্তা বাড়িয়ে এটির স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন নৈতিক শিক্ষা। এটির বড় অভাব।
কুমিল্লায় বিচারকের সামনে আসামি হত্যার ঘটনায় আদালতের নিরাপত্তা চেয়ে রিট হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্ট বারের আইনজীবী ইশরাত হাসান বাদী হয়ে এ রিট করেন। আজ (বুধবার) বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহসান এবং বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের ডিভিশন বেঞ্চে শুনানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রিটের বাদী ইশরাত হাসান বলেন, ১ জুলাই কুমিল্লায় আদালত কক্ষে বিচারকের সামনে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তাতে একজন বিচারকের স্ত্রী হিসেবে আমি উদ্বিগ্ন। তাই দেশের সব আদালত চত্বরে বিচারকদের যথাযথ নিরাপত্তা দেয়ার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছি। রিটে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইন মন্ত্রণালয় সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে।
এদিকে রিট ফাইলের পরপরই গতকাল দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণেই সামনেই জামিনপ্রাপ্ত আসামিকে বাদীপক্ষের লোকদের হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলার শিকার মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বাজিতপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম হাওলাদার। হামলা ঠেকাতে চাইলে আসামিপক্ষের আইনজীবী আবদুল আউয়ালও মারধরের শিকার হোন। সুপ্রিম কোর্ট বার সূত্র জানায়, সিরাজুল ইসলাম হাওলাদার বাজিতপুরের আওয়ামী লীগ সমর্থিত ইউপি চেয়ারম্যান। গত ৯ মে বাজিতপুরের মজুমদার বাজার এলাকায় সোহেল হাওলাদার (৩২) নামক এক মুরগি ব্যবসায়ী ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় সিরাজুল ইসলামকে প্রধান আসামি করে রাজৈর থানায় মামলা করার পর থেকে তিনি পলাতক ছিলেন। গতকাল তিনি হাইকোর্টে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পান। জামিন পাওয়া ক্ষুব্ধ বাদীপক্ষের জুয়েল, বাচ্চুসহ কয়েকজন হামলা চালায়। পরে হামলাকারী যুবককে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয় আইনজীবী সমিতি।
এদিকে আদালত অঙ্গনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার গোলাম রাব্বানী ইনকিলাবকে বলেন, আদালতগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। প্রবেশদ্বারগুলোতে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। মাননীয় প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল দেশের বাইরে রয়েছেন। তারা এলে নিরাপত্তা সঙ্কটের স্থায়ী নিরসনে আশু করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জানান, শুধু কুমিল্লা নয় দেশের ৪টি আদালতেই নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত : ২০০৫ সালের ১৩ আগস্ট ৬৩ জেলার আদালত অঙ্গনে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ হয়। এ ঘটনায় সারা দেশ কেঁপে ওঠে। এর পরই দেশের বিচারাঙ্গনের নিরাপত্তার প্রশ্নটি প্রথম সামনে আসে। তৎকালিন সরকার ওই ঘটনার পর আদালতগুলোতে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করে। কথিত এই ‘জোরদার ব্যবস্থা’র ভেতরই একইবছর ১৪ নভেম্বর আদালতে যাওয়া-আসার পথে জঙ্গি হামলায় নিহত হন ঝালকাঠির সিনিয়র সহকারী জজ সোহেল আহম্মেদ এবং জগন্নাথ পাঁড়ে। সেবছর ২৯ নভেম্বর চট্টগ্রাম আদালতের মূল ফটকে পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন পুলিশ কনস্টেবল রাজীব বড়ুয়া এবং ফুটবলার শাহাবুদ্দীন। পরে হামলাকারী জেএমবি সদস্য মুহাম্মদ হোসেনও চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। এপর গাজীপুরসহ বিভিন্ন আদালতে হামলা হয়। কোনো একটি হামলা হলেই বিচারাঙ্গনের নিরাপত্তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মাঝে তোড়জোর শুরু হয়। এক সময় দৃশ্যপট থেকে উধাও হয়ে যায় বিচারাঙ্গনের নিরাপত্তা ইস্যু। থিতিয়ে পড়ে নিরাপত্তাব্যবস্থাও। ১৫ জুলাই কুমিল্লা আদালত এজলাসে বিচারকের খাস কামরায় সহ-আসামির ছুড়িকাঘাতে আসামি ফারুক নিহত হওয়ার ঘটনার পর যথারীতি আলোচনায় উঠে আসে আদালতের নিরাপত্তা বিষয়টি। এর আগে ২০১৬ সালে আদালতে বেশ কয়েকবার জঙ্গি হামলার হুমকি আসে। এ পরিপেক্ষিতে তৎকালিন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা আদালতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নিতে সরকারের কাছে চিঠি লেখেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ওই সময় আদালতের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তবে এখন সেই ব্যবস্থাও কার্যকর নয় বলে জানা গেছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।