পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্কের জামাইকায় একটি আন্তর্জাতিক সীরাতুন্নবী সা. সভায় আহূত হয়ে যোগদান করতে এসেছিলাম। কিছুটা সময় হাতে নিয়ে মাঝপথে ব্রিটেনের লন্ডনসহ বেশ কয়েকটি শহর ভ্রমণ করে হিথ্রো থেকে এসে পৌঁছলাম নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দর হয়ে কনফারেন্স স্থলে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলিম স্কলারদের দাওয়াত দেয়া হয়েছে এ কনফারেন্সে। তাঁরা এসেছেন এবং সীরাতুন্নবীর বিভিন্ন দিকের নির্ধারিত বিষয়ের উপর সারগর্ভ বক্তব্য রেখেছেন। আমার বিষয় ছিল বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর অবদান এবং বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে সদ্ভাব ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা। কনফারেন্সে এত জনসমাগম হবে তা আমি ধারণা করতে পারিনি। বিশাল মিলনায়তন। উপচেপড়া ভিড়। পিনপতন নীরবতার মধ্য দিয়ে প্রত্যেকে ভাষণ শুনলেন গভীর মনোযোগ সহকারে। মনে হলো, শ্রোতাদের মধ্যে প্রবাসী বাঙালিদের সংখ্যাই বেশি এবং অধিকাংশই তরুণ। দেশে থাকাকালীন এরা এতটা ইসলামী অনুরাগী ছিল কি না জানি না। তবে এখানকার বিভিন্ন স্টেটে সফরকালীন সময়ে আমি এই তরুণ মুসলিমদের মধ্যে ইসলামকে জানবার, বুঝবার, আমল করবার এবং ইসলাম প্রচার ও প্রসারের জন্য মসজিদ, বিদ্যালয়, সংগঠন গড়ে তোলায় বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ করে মুগ্ধ হলাম।
এক মাস সময় হাতে নিয়ে এসেছিলাম আমেরিকার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখার জন্য এবং দেখলাম। সে সবের বর্ণনা দেয়া বক্ষ্যমান নিবন্ধের লক্ষ্য নয়। সে যা হোক, আমার এ সফরের শেষ গন্তব্য স্থান ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি। জামাইকার ইসলামী কনফারেন্সে যোগদান করতে আসা কয়েকজন উৎসাহী তরুণ আমন্ত্রণ জানালেন ওয়াশিংটন ডিসি ভ্রমণের। আমন্ত্রণের মূল লক্ষ্য ছিল ওয়াশিংটন ডিসির যে এলাকায় তাঁরা বসবাস করেন, সেখানে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা। বেশ কিছুটা জমি এ জন্য তারা ইতোমধ্যেই কিনে নিয়েছেন। তাদের এ মহৎ উদ্দেশ্যের কথা শুনে আমার আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। আমি লক্ষ করেছি, এখানকার মসজিদগুলো শুধু নামাজঘর নয়, ঐ এলাকার মুসলিমদের মিলন কেন্দ্র, কালচারাল সেন্টার। সমাজসেবা দাতব্য চিকিৎসা ইত্যাদি পরিচালনা করা হয় এখান থেকে, এ জীবন্ত প্রাণবন্ত এক ইবাদতগাহ।
যথাসময় হাজির হলাম। খুব একটা বেশি না হলেও বেশ কিছু উৎসাহী লোকজন জমায়েত হয়েছেন, তাদের মধ্যে যুবকের সংখ্যাই বেশি। আলোচনা করলাম গভীর মনোযোগের সাথে শুনলেন এবং বক্তৃতা শেষে আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বললেন, আল্লাহপাক তাওফীক দান করলে এবং আগামী বছর এখানে এলে ইনশাআল্লাহ প্রস্তাবিত এই মসজিদে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করতে পারবেন। বললাম, আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ কবুল করুন। আমি যেন ভাবাবেগে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম, ইয়া আল্লাহ তোমার এ কী লীলা! এ যেন গভীর অন্ধকারে প্রোজ্জ্বল আলোকবর্তিকার ইশারা। আল্লামা কবি ইকবাল বলেছেন, ‘মুসলমানের হুঁশ ফিরেছে পশ্চিমা ওই ঝল্কাতে/সিন্ধুজলে মুক্তা ফলে তরঙ্গের সংঘাতে।’ হ্যাঁ, এ যেন উত্তাল তরঙ্গের প্রচণ্ড সংঘাতে সিন্ধুজলে মুক্তা ফলতে শুরু করেছে। বিশ্বব্যাপী ইসলাম ও মুসলমানদের ঘোর দুর্দিন, প্রশান্ত মহামারী দ্বীপ মিন্দানাও থেকে শুরু করে মিয়ানমার, ভারত, কাশ্মীর, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, মিসর, লিবিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে, চীনের উইঘুর অঞ্চলে মুসলমানদের আজ কী করুণ অবস্থা! ইসলামের অগ্রগতি ঠেকানোর জন্য বৃহৎ শক্তিবর্গের কত না ষড়যন্ত্র! তারা ইন্ধন জোগাচ্ছে, ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াইয়ের জুগিয়ে যাচ্ছে রসদ/পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আল্লাহ পাকের ভাষায়- ‘ওরা চায় আল্লাহর নূর দ্বীন ইসলামের বাতিকে ফুৎকারে নিভিয়ে দিতে’ কিন্তু পারবে কি? না, পারবে না। এ স্বয়ং আল্লাহরই ঘোষণা ওরা যতই নেভাতে চাক না কেন ‘আল্লাহ তার নূরকে ছড়িয়ে দেবেন, পরিপূর্ণ করবেন, যদিও কাফেরদের কাছে, মুশরিকদের কাছে অথবা অপছন্দনীয়, মনোকষ্টের ব্যাপার।’ এই সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা.-এর তায়েফের সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা ও তার একটি উক্তি মনে পড়ে গেল। তায়েফের কাফেরদের হাতে বিশ্বনবী সা. যখন চরমভাবে লাঞ্ছিত, অপমানিত, প্রস্তরাঘাতে জর্জরিত রক্তাক্ত। তখন প্রাণ নিয়ে কোনো রকম আশ্রয় নিলেন এক পর্বত পাদদেশে। ক্লান্ত অবসন্ন দেহে কাতর কণ্ঠে প্রার্থনা করতে লাগলেন- ‘হে পরম দয়াময়, তুমিই যে প্রতিপালক, তুমিই যে দুর্বলের বল, প্রভু! তোমায় ব্যতীত আমার তো আর কেহ নাই। তুমি আমাকে কাহার হস্তে সমর্পণ করিবা? হে প্রভু তুমি কি আমায় এমন পরের হস্তে সমর্পণ করিবা- রুক্ষ মুখের কর্কশ ভাষায় যে আমাকে জর্জরিত করিবে? অথবা এমন শত্রুর হাতে আমাকে তুলিয়া দিবা, যে আমার সাধনাকে ব্যর্থ বিপর্যস্ত করিয়া দিবে?’ অন্য বর্ণনায় আছে, হযরতের এই অসহায় করুণ অবস্থা দেখে ও প্রার্থনা শুনে একমাত্র সঙ্গী হযরত যায়েদ রা. হতাশ কণ্ঠে বললেন, তবে কি আল্লাহর দ্বীন মিটে যাবে? এ কথা শুনে মুহূর্তে বিশ্বনবী সা.-এর মুখের ভাব পরিবর্তন হয়ে গেল। এক বিস্ময়কর দৃঢ়তার নূরে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন না! ইসলামের বিজয় অবশ্যই হবে। বিশ্বময় ইসলাম ছড়িয়ে পড়বে। এমনকি মেষ ও উটের খোঁয়ারগুলো পর্যন্ত যতক্ষণ না তাওহীদি কালেমা গুঞ্জরিত হবে ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত হবে না। বিভিন্ন রিওয়ায়েতেও এরূপ ভবিষ্যদ্বাণী আছে। আজ বিশ্বের দিকে দিকে আমরা কি তা বাস্তবায়িত হতে দেখতে পাচ্ছি না? এ কি গভীর অন্ধকারে আলোর ঝলকানি নয়? এক দিকে যেসব ব্যূহ শক্তি মুসলিম জাহানে তাণ্ডব চালাচ্ছে ইসলামকে খতম করে দেবার জন্য চালিয়ে যাচ্ছে অপতৎরপতা- অপরদিকে তাদেরই দেশে প্রতিদিন শত শত অমুসলিম তৌহিদের কলেমা উচ্চারণ করে স্থান নিচ্ছে ইসলামের ছায়াতলে। মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে মসজিদের মিম্বর। আল্লাহু আকবার তকবির ধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে আকাশ-বাতাস। গড়ে উঠছে নিত্যনতুন মাদরাসা।
হচ্ছে সেমিনার সিম্পোজিয়াম, ওয়াজ মাহফিল। এ দৃশ্য আমি যেমন বহুবার প্রত্যক্ষ করেছি, জামাইকায়, ম্যানহাটনে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের ধারে, কাফেলোতে, মিসিগানের বিভিন্ন এলাকায়, কানাডার সীমান্তে যুক্তরাষ্ট্রের শহর বেটরয়েটে, তেমনি দেখেছি ব্রিটেনের লন্ডন, ম্যানচেস্টার, বার্মিংহাম, বিস্টল, ওয়েলসের কার্ডিফ, ইংল্যান্ডের গ্লাসগো, অ্যাবাডিনসহ ছোট-বড় অনেক শহরে, জুমার দিন মসজিদে মসজিদে দেখেছি উপচে পড়া ভিড়।
এবার ফিরতে হবে দেশে। জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্ট থেকে আরোহণ করলাম বিমানে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। দীর্ঘপথ। তবু পথক্লান্তি দূর করার একটা উপায় আমি পেয়ে গেছি উড়ন্ত এয়ারক্র্যাফটে। বড় পর্দায় নেভিগেশন দেখানোর ব্যবস্থা আছে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশ্ব মানচিত্র। যে পথ দিয়ে চলছে সে পথ তো বটেই। যে দেশের ওপর দিয়ে যাচ্ছে সে দেশ এবং তার আশপাশের দেশের মানচিত্র তার সাগর, উপসাগর, নদ-নদী, পাহাড়, পর্বত, মরুভূমি, বন-বনানী, সব কিছু ভেসে ওঠে চোখের সামনে। সাথে সাথে মনের পর্দায় ভেসে ওঠে তার ইতিহাস, ভুগোল, অতীত ও বর্তমান। তা এতই বাস্তবানুগ, মনেই হয় না যে ছবি দেখছি। মনে হয় যেন পায়দলে চলছি আর দেখে চলছি সামনের ও আশপাশের দৃশ্যাবলি। সফরের সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আমি দেখি আর চলে যাই বর্তমান থেকে অতীতে। বিচরণ করি ইতিহাসের পাতায় পাতায়।
বিমান চলছে উত্তর-পূর্ব দিকে। আটলান্টিকের পূর্ব তীর ধরে, যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা পেরিয়ে পৌঁছল কানাডার নিউফাউন্ড ল্যান্ডের ওপরে। এবার আটলান্টিকের পাড়ি, পশ্চিম দুনিয়া থেকে পূর্ব দুনিয়া। আসার পথে এসেছিলাম দক্ষিণ ইউরোপ তথা ভূমধ্যসাগরের উত্তর প্রান্ত দিয়ে, সিরিয়া ইসরাইলকে বাঁয়ে ফেলে। ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করে সামনে পড়ল গ্রিস সাইপ্রাস। ইটালি পার হবার আগে উত্তরে দেখা গেল আলবেনিয়া, বসনিয়া, হার্জে গোভিনা। মনটা ব্যথায় কঁকিয়ে উঠেছিল সেখানকার মুসলমানদের উপরে সার্ভ ও ক্রোট জল্লাদদের পৈশাচিক অত্যাচার ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানোর কথা মনে করে। ইনকিলাবে তখন বিদেশি এক সংবাদমাধ্যমের বরাতে লিখেছিলাম। কয়েকটি শিশুর তাদের মায়ের কাছে করুণ জিজ্ঞাসার কথা। তাদের বাপকে নরপিশাচরা হত্যা করেছে দাঙ্গার প্রারম্ভেই অন্যত্র। মা, ইয়াতিম বাচ্চাদের নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত আস্থায় কাটাচ্ছিলেন দিন। আক্রমণ হলো সেই মহল্লায়। প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাচ্চাদের নিয়ে আশ্রয় নিলেন এক মসজিদে গিয়ে। সেখানেও যখন আক্রমণ শুরু হলো, পালালেন তখন গভীর জঙ্গলে। কয়েক দিন যেতে না যেতেই আক্রমণ শুরু হলো সেই জঙ্গলেও। এবার এতিম শিশুরা মায়ের বুকের সাথে মিশে গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে প্রাণভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল- মাগো! ঘরে ছিলাম, থাকতে পারলাম না, মসজিদে গিযে আশ্রয় নিয়েছিলাম, সেখানেও থাকতে পারলাম না। পালালাম গভীর জঙ্গলে এসে। এখানেও ধেয়ে আসছে জল্লাদ পিশাচরা। মা, মাগো! এখন আমরা কোথায় যাবো? তাদের অপরাধ একটিই, তারা মুসলমান। এই অপরাধে কত মুসলমান যে পাইকারি হত্যার শিকার হয়েছিল, তা লেখার অবকাশ এখানে নেই। কেবল দেশের নাম দেখে মনের পর্দায় ভসে উঠল তাদের করুণ ছবি, আর কানে যেন ভেসে আসছিল তাদের অসহায় জিজ্ঞাসা। যা হোক, এগিয়ে যাচ্ছিলাম পশ্চিম দিকে ইটালি পার হয়ে সার্দেনিয়া ও কার্সিকা দ্বীপের মধ্য দিয়ে পৌঁছেছিলাম ফ্রান্সের আকাশে, বামে ছিল স্পেন। যেখানে মুসলমানরা রাজত্ব করেছিল ৭০০ বছর। ইউরোপীয়দের দিয়েছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানে হাতেখড়ি, গড়ে তুলেছিল অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। আলহামরা প্রাসাদের মতো নয়নাভিরাম স্থাপনা। অবশেষে পতন হলো তাদের, নিহত হলো লাখ লাখ মুসলমান। থাক সে ইতিহাস। পার হলাম ফ্রান্স ডানে উত্তর দিকে ম্যাপে ভেসে উঠল বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড। ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে বিমান ল্যান্ড করল লন্ডনের হিথ্রো এয়ারপোর্টে। এ তো ছিল যাবার পথ। কিন্তু ফিরছিলাম উত্তর ইউরোপের পথ ধরে। ঊর্ধ্বে অসীম নীল আকাশ। নিম্নে আটলান্টিক মহাসগরের সীমাহীন জলরাশি। পাড়ি যার ৩২৭০ নটিকাল মাইল। পর্তুগাল থেকে আমেরিকা পৌঁছতে কলম্বাসের লেগেছিল কত মাস। আধুনিক বিজ্ঞান কত সহজ করে দিয়েছে জীবনযাত্রা। যার বদৌলতে দিনের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে। চলছি আমরা পূর্ব-উত্তর দিকে। আমাদের রুট থেকে উত্তর দিকে দেখা যাচ্ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম দ্বীপ গ্রিনল্যান্ড, আরো কিছু দূর অগ্রসর হতে বামে দেখা গেল আইসল্যান্ড। চলছি সামনে থেকে আরো সামনে। আটলান্টিকের পরে নর্থ সি পাড়ি দিয়ে, নরওয়ের সুইডেনের ওপর দিয়ে অগ্রসর হয়ে নিচে দেখলাম বাল্টিক সাগর। দক্ষিণ দিকে দেখা গেল জার্মানি। পূর্ব দিকে পোল্যান্ড ও নিথুনিয়ার মাঝ দিয়ে ইউক্রেনে ঢুকে দক্ষিণে রইল বুলগেরিয়া। ঢুকলাম কুষ্ণ উপসাগরে। যার দক্ষিণ তীর জুড়ে তুরস্ক। দেশটি নজরে আসতেই মনে পড়ল দার্শনিক কবি ইকবালের অমর দু’টি পঙÍ্ক্তি : ‘উসামনীদের চারদিকেতে যদিও আজি বিপদ ঘোর/ভয় কি তাতে, হাজার তারার মরণে হয় একটি ভোর।’
উসমানী সালতানাত ও খিলাফত ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়ের স্থিতিকাল ১২৯৯ ঈসায়ী সাল থেকে ১৯২৪ ঈসায়ী সাল পর্যন্ত ৬২৫ বছর। এক সময় এর বিস্তৃতি ঘটেছিল ৫২ লাখ বর্গমাইলে। প্রথম উসমান এর প্রতিষ্ঠাতা। দ্বিতীয় মুহাম্মদ জয় করেন ইউরোপের কনস্টান্টিনোপাল। সুলতান ১ম সুলাইমানের শাসনামলে। উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে এই সালতানাত ও খিলাফত। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা তিন মহাদেশ বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছিল এই সা¤্রাজ্য। দক্ষিণ-উত্তরে রাশিয়ার কৃষ্ণ উপসাগর। পশ্চিম এশয়িার ককেশাস। উত্তর আফ্রিকা ও হর্ন অব আফ্রিকা, ইউরোপের বলকান অঞ্চল। তথা বেলগ্রেড, গ্রিস, বসনিয়া হার্জেগোভিনা, পারস্যের এক অংশ, বাগদাদ, মধ্যপ্রাচ্য, আরব অঞ্চলসমূহ নিয়ে যে সালতানাত ও খেলাফত একদিন সারা দুনিয়ায় চমক লাগিয়েছিল, সেই ৫২ লাখ বর্গমাইলের সা¤্রাজ্য শেষে ৩ লাখ বর্গমাইলে এসে দাঁড়িয়েছে। বাকি অঞ্চলে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে ৪৯টি রাষ্ট্রের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এই সালতানাতের বিলুপ্তি ঘটে।
তুরস্ক সালতানাতের অবসান ঘটে ১৯২২ সালের ১লা নভেম্বর কামাল আতাতুর্ক কামাল পাশা ওসমানিয়া সালতানাত ও খিলাফতের শেষ শাসক সুলতান ২য় আবদুল মজীদকে অপসারণ করে রাষ্ট্রের সর্বময় কতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯২৩ সালে গ্রান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলি তুরস্ককে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। তুরস্কের ৯৮ শতাংশের অধিক অধিবাসী মুসলমান এবং তারা সুন্নী ও হানাফী মাজহাবের অনুসারী। কামাল পাশা তুরস্ককে এক দিকে চরম সঙ্কট থেকে উদ্ধার করেন, অপর দিকে “১৯২৪ সালে ধর্মীয় আদালতসমূহ উঠিয়ে দেন, ধর্মীয় স্কুলসমূহ ও দরবেশ সম্প্রদায় বাতিল করেন, ফেজটুপি পরিধান নিষিদ্ধ করেন। শাসনতন্ত্রের যে ধারায় ইসলাম রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসাবে বিধিবদ্ধ ছিল তাও বাতিল করেন; আরবী বর্ণমালার পরিবর্তে রোমান বর্ণমালা প্রবর্তন করেন।” (বাংলা বিশ্বকোষ ১ম খণ্ড)। তুরস্কের ইসলামের এই দুর্দিনে সৈয়দ বদিউল আলম নূর্সি প্রমুখ। ইসলামের যে খিদমত সন্তর্পণে চালিয়ে যান তার সুফল এখন ফলতে শুরু করেছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট তাইয়েব এরদোগান ও তার দল এনেছেন দেশে ইসলামের পুনর্জাগরণ। ইসলামী উম্মাহর দুর্দিনে তাদের পাশে এসে দাঁড়ানো, মুসলিম জাহানের ঐক্য প্রচেষ্টা তাকে মুসলিম উম্মাহর একজন অনন্য অভিভাবকের মর্যাদায় আসীন করেছে। আজ মুসলিম জাহানের এই দুর্দিনে তাদের মধ্যে ঐক্য প্রয়োজন। ইসলামী জ্ঞানার্জনের সাথে সাথে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে উৎকর্ষ অর্জন আবশ্যক; এ জন্য চাই যোগ্য নেতৃত্ব। তুরস্ককে নিয়ে তাই আলোচনা একটু দীর্ঘ হলো।
যা হোক কৃষ্ণ উপসাগর পাড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছলাম ককেশাস পর্বতমালার অঞ্চলে, নিচে চেচনিয়া, গ্রোজনী। মনে জাগে, চেচনিয়া শার্দুল, স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা জওহর দুদায়েভের বুকফাটা করুণ আবেদনের কথা। তিনি বলেছিলেন, দুশমনরা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, ট্যাংক চালিয়ে, কামানের গোলা বর্ষণ করে আমাদের নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছে, দুনিয়ার মুসলমান ভাইয়েরা! তোমরা আমাদের পাশে এসে তো দাঁড়ালেই না, একটি বুলেট দিয়েও সাহায্য করলে না। না, সেজন্য আফসোস করে কোনো লাভ নেই। তবে তোমাদের কাছে আমাদের একটা বিনীত নিবেদন, তোমরা শেষ রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে, আল্লাহর দরবারে একটু দোয়া তো করতে পারো, সেটুকু অন্তত করো, গ্রোজনী আতিক্রমকালে তাঁর সেই মর্মভেদী ফরিয়াদ যেন আমার কানে ভেসে আসছিল নিজের আজান্তেই দু’চোখ থেকে নেমে আসছিল আশ্রুধারা। গ্রোজনী ত্যাগ করে আমরা পৌঁছলাম কাস্পিয়ান সাগরে। পৃথিবীর বৃহত্তম হ্রদ এই কাস্পিয়ান সাগর। চোখে পড়ল বিখ্যাত তেল রফতানি কেন্দ্র, বাকু বন্দর, কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ তীর ধরে ইরম, পূর্ব দিকে উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তানে, বোখারা সমরখন্দ প্রভৃতি ইসলামী জ্ঞানচর্চার তৎকালীন প্রাণকেন্দ্র, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম নসায়ী, ইমাম তিরমিজি প্রমুখ সর্বকালের শ্রেষ্ঠ হাদিস বেত্তাগণের সাধনা কেন্দ্র। ছাহেবে হিদায়া মুর গেলানী, ছাহেবে মবসুত আল্লামা সরযমী- এমন অসংখ্য মনীষীর বাসস্থান এ অঞ্চলে। পরবর্তীতে মুসলমানদের অনৈক্যের কারণে বলশেভিক বিপ্লবের পরে এসব এলাকা কমিউনিস্ট শাসনাধীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রায় এক শতাব্দী ধরে চলে এই অক্টোপাসি শাসন। আল্লাহর মেহেরবানিতে সেই নস্তিক্যবাদী স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে, জানি না তারা কবে আবার তাদের সেই হরানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারবে। কাস্পিয়ান পার হয়েই শুরু হলো পার্বত্য এলাকা, আকাশছোঁয়া পাহাড়ের সারি। নিচে চাঁই চাঁই পাথর আর পাথর, পামির এলাকা, পামিরকে বলা হয় পৃথিবীর ছাদ। সামনে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল, তার সাথে পর্দায় ভাসছে আজাদ কাশ্মীর, পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ। সে দৃশ্য পিছে ফেলে ভারতীয় কাশ্মীরের ওপর দিয়ে উড়ে চললাম ভারতের ওপর দিয়ে। রাজধানী দিল্লি অতিক্রম করে এগিয়ে চললাম। পূর্ব দিকে বামে দেখা যাচ্ছিল পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত হিমালয়। তার অনেক শৃঙ্গই নজরে এলো, তবে বুঝতে পারলাম না যে এভারেস্ট শৃঙ্গ কোনটা? চলছিলাম নেপালের পাশ ঘেঁষেই। বারানশ, পাটনার ওপর দিয়ে অবশেষে প্রবেশ করলাম আমার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের আকাশে, উত্তরে দেখা যেতে লাগল আসাম, খাসিয়া, জৈন্তিয়া-পর্বত শ্রেণী, পূর্বে মিয়ানমার। মনে ভেসে উঠল রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুর্দশা। আসামের মুসলমানদের ভয়ে দুরু দুরু অবস্থা। দেখলাম গঙ্গা। কনতোয়া। কিন্তু পানি তো পাচ্ছি না আমরা। তবু আমরা এগিয়ে যাবো, যাবোই ইনশাআল্লাহ। ইতোমধ্যে এত বাধাবিপত্তি থাকা সত্তে¡ও আমরা তো উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে অভিনন্দিত। ঐ তো আমাদের প্রিয় রাজধানী ঢাকা। গন্ধ পেলাম দেশের মাটির, প্রাণ জুড়িয়ে গেল, নয়ন জুরিয়ে গেল। বিমান অবতরণ করল হযরত শাহজালাল এয়ারপোর্টে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।