Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নয়ন গং অধরায় শঙ্কা

পুলিশের কনস্টেবল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সাগরসহ গ্রেফতার ২

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

বরগুনায় স্ত্রীর সামনে প্রকাশ্যে রিফাত শরীফকে (২২) কুপিয়ে হত্যাকান্ডের ঘটনার ৫ দিন পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত মূল আসামিদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এতদিনেও নয়ন বন্ড ও তার সহযোগী রিফাত ফরাজীসহ প্রধান আসামীরা গ্রেফতার না হওয়ায় জনমনে ক্ষোভ ও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। খুনিরা আত্মগোপনে আছে, না দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে- সেই প্রশ্নই এখন চারিদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে।

এদিকে, রিফাত হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে তানভীর ও সাগর নামের আরও দু’জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতার সাগর পুলিশে নিয়োগ পাবার জন্য প্রাথমিক ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য অপেক্ষমান ছিলেন। তাদের দু’জনকে নিয়ে হত্যার ঘটনায় এ পর্যন্ত ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রিফাত হত্যা মামলার আসামিদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেছেন আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ। আজ সোমবার এ বিষয়ে শুনানি হওয়ার কথা। রিফাতের হত্যা নিয়ে তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ফেসবুকসহ বিভিন্নভাবে বানোয়াট কথা প্রচার করা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি। গতকালও বরগুনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আসামিদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

রিফাতের স্বজন ও স্থানীয়রা জানান, হত্যাকান্ডের পর এতদিন পার হলেও মূল আসামিদের গ্রেফতার করা যায়নি। তারা আদৌ দেশে আছে না বিদেশে পালিয়ে গেছে সেটিও নিশ্চিত নয়। এতদিনেও গ্রেফতার করতে না পারায় মূল আসামিদের গ্রেফতার ও শাস্তি নিয়ে তারা শঙ্কা প্রকাশ করছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, নয়ন গংদের ওপরে ক্ষমতাসীন দুটি পক্ষের সমর্থন থাকায় তাদের হয়তো কোথায় লুকিয়ে থাকতে সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। তদ্রুত মূল আসামিসহ সবাইকে গ্রেফতারের দাবি জানান তারা।

বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন গতকাল নিজ কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, আসামি ধরা ঘণ্টাব্যাপী বা সেকেন্ডব্যাপী হয় না। টেকনিক্যাল অনেক বিষয় আছে। তানভীর ও সাগরসহ এ পর্যন্ত মোট ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি বলেন, আসামি কোথায় আছে না আছে এবং কখন নক করলে তাদের সুবিধাজনকভাবে ধরা যাবে সেসব বিষয় মাথায় রাখতে হয়। এর মানে এটা না যে- এত ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও আসামিরা আমাদের নজরদারির বাইরে চলে গেছে কিংবা আমাদের গাফিলতি আছে। আমরা রাতদিন কাজ করছি। শিগগিরই সববাইকে ধরতো পারবো বলে আশাবাদী।

কতজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে এমন প্রশ্নে এসপি বলেন, এটা এই মুহূর্তে বলা যাবে না। কারণ, অনেকেই গোপনে আমাদের কাছে এসে তথ্য দিচ্ছেন। আবার অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছে। তাই বিষয়টি আপাতত গোপন রাখতে চাচ্ছি।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নতুন গ্রেফতার হওয়া সাগর বরগুনা সদর উপজেলার ৯নং ইউনিয়নের এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবদুল লতিফ মাস্টারের ছেলে। তিনি পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষায় প্রাথমিক বাছাই ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীণ হয়ে মৌখিক পরীক্ষার জন্য অপেক্ষমান ছিলেন। রিফাত হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা করা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ ০০৭-এ তারও যুক্ত থাকার প্রমান মিলেছে। যদিও হত্যাকান্ডের সময় তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন না বলে গ্রেফতারের আগে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন।

গ্রেফতারের আগে সাগরের সাথে সাংবাদিকদের কথা হয়। তখন তিনি ঢাকার একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন এবং পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগের বাছাইপর্বে লাইনে দাড়াতে ২২ তারিখ বরগুনা আসে বলে জানায়। সাগর জানায়, মঙ্গলবার বরগুনা জেনালের হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় আবদুল্লাহ নামে একজন মারা যাওয়ার প্রতিবাদে আমরা সবাই মানববন্ধন করেছিলাম। এরপর রিফাত শরীফের ওপর হামলার দিন সকালে আমি ঘুম থেকে জেগে দেখি সাবইকে কলেজে যাওয়ার কথা লেখা রয়েছে। আমি মানববন্ধনেরই কিছু হতে পারে এমনটি ভেবে সেই লেখায় একটি লাইক দিয়েছি। এরপর আমি বের হয়ে পরীক্ষার রেজাল্ট আনতে যাই এবং সাড়ে ১১টার দিকে সেখান থেকে ফিরে আসি। তিনি আরও বলেন, দুই বছর আগে স্থানীয় তানভীর তাকে ডেকে নয়ন এবং রিফাত ফরাজীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং যোগাযোগ রাখতে বলে।
কনস্টেবল পরীক্ষায় সাগরের উত্তীর্ণের বিষয়ে এসপি মারুফ বলেন, সে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু, যখন গ্রুপে তার সংশ্লিষ্ট জানতে পারি তখনই তাকে গ্রেফতার করি। তিনি আরও বলেন, গত শনিবার রাতে বরিশালের নানার বাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করা হলেও রোববার বিষয়টি মিডিয়ায় এসেছে।

২৪ ঘণ্টায় গ্রেফতারের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট
রিফাত হত্যা মামলার সব আসামিদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়েছে। একইসঙ্গে এ মামলার আসামিদের দেশত্যাগ ঠেকাতে সীমান্তে রেড অ্যালার্ট জারির নির্দেশনাও চাওয়া হয়েছে। গতকাল রোববার হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রিটকারী আইনজীবী ড. ইউনুছ আলী আকন্দ। তিনি বলেন, রিটে আইন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইজিপিসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে। আজ সোমবার এই রিটের ওপর শুনানি হতে পারে।

ফেসবুকে প্রচারণায় ক্ষুব্ধ মিন্নি
ফেসবুকসহ বিভিন্ন জায়গায় হত্যাকান্ডে রিফাত শরীফের স্ত্রী মিন্নির সম্পৃক্ততা থাকার কথা প্রচার করার প্রতিবাদ জানিয়েছেন মিন্নি। শনিবার রাতে বরগুনা পৌর শহরের মাইঠা এলাকায় নিজ বাসায় তিনি বলেন, ফেসবুকে আমাকে নিয়ে যারা বানোয়াট কথা প্রচার করছেন তারা সন্ত্রাসীদের বাঁচানোর জন্য আজেবাজে কথা ছড়াচ্ছে। তিনি বলেন, মিথ্যা প্রচারকারীরা এই হত্যাকান্ড সমর্থন করে এবং তারাও খুনের সঙ্গে জড়িত বলে আমি মনে করি। তাদেরও শাস্তি হওয়া উচিত।

মিন্নি বলেন, আমাদের বিয়ের বয়স দুই মাস হলেও দুই-তিন বছর আমাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। বিষয়টি পরিবারকে জানালে দুই মাস আগে আমাদের আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়। তিনি আরও বলেন, নয়ন দীর্ঘদিন ধরে আমাকে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। বিয়ের আগে-পরে নয়ন আমাকে রাস্তাঘাটে বিরক্ত করতো। জোর করে আমার রিকশায় উঠতো। আমার সঙ্গে ছবি তুলতো। যা আগেও বলেছি।

বরগুনাসহ বিভিন্ন জায়গায় মানববন্ধন
বিচার, অভিযুক্তদের দ্রুত গ্রেফতার ও শাস্তির দাবিতে গতকালও বরগুনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। জেলা প্রেস ক্লাবের সামনে বরগুনা জেলা বিএনপি, বরিশাল নগরীর অশ্বিনী কুমার হলের সামনে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট বরিশাল জেলা শাখা, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ঢাকাস্থ বরগুনাবাসী ও এইড ফর ম্যান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ আরও বিভিন্ন জায়গায় মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকায় মানববন্ধনে অভিনেতা মীর সাব্বির বলেন, সারাদেশের মানুষ এই ঘটনাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমাদের কোনও দল নেই। আমাদের একটিই দল, সেটা সত্য ও সুন্দরের দল। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

বরিশালে ছাত্রফ্রন্টের বক্তারা বলেন, দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলছে। প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ দেওয়ার আগ পর্যন্ত অপরাধীরা স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় নির্বিঘ্নে চলাচল করার সুযোগ পাচ্ছে। অপরাধীদের রক্ষার জন্য রাজনীতিবিদরা পর্যন্ত পক্ষপাতিত্ব করছে। এ অচলাবস্থা থেকে বের হয়ে সব অপরাধীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

প্রসঙ্গত, গত ২৬ জুন স্ত্রীর সামনে প্রকাশ্যে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ১২ জন আসামির নাম উল্লেখ করে মামলা করেন তার বাবা মো. আ. হালিম দুলাল শরীফ। মামলায় পাঁচজনকে অজ্ঞাত আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ মামলার প্রধান আসামি সাব্বির আহমেদ নয়ন (২৫)। বাকি আসামিরা হলেন মো. রিফাত ফরাজী (২৩), মো. রিশান ফরাজী (২০), চন্দন (২১), মো. মুসা, মো. রাব্বি আকন (১৯), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রায়হান (১৯), মো. হাসান (১৯), রিফাত (২০), অলি (২২) ও টিকটক হৃদয় (২১)। নিহত রিফাত শরীফের বাড়ি বরগুনা সদর উপজেলার ৬নং বুড়িরচর ইউনিয়নের বড় লবণগোলা গ্রামে। তিনি মা-বাবার একমাত্র সন্তান ছিলেন।

 



 

Show all comments
  • Mohammed Shafiquzzaman Limon ১ জুলাই, ২০১৯, ৩:৫৭ এএম says : 0
    বাংলাদেশে 90% অপরাধ রাজনৈতিক ছত্রছায়াতেই হয়।
    Total Reply(0) Reply
  • Abedin HM ১ জুলাই, ২০১৯, ৩:৫৮ এএম says : 0
    দলের সাপোট না থাকলে কেউ এতবর কাজ করার সাহস পায়না। এতে বুঝা যায় আজ পর্যন্ত যত খুন,ধর্ষণ হয়েছে। এদের শাস্তি না হওয়ার কারনে হাত রয়েছে কোন কোন ক্ষমতার অধিকারের।
    Total Reply(0) Reply
  • Robert Hassan ১ জুলাই, ২০১৯, ৩:৫৮ এএম says : 0
    PM will be doing for Right
    Total Reply(0) Reply
  • Shihab Sumon ১ জুলাই, ২০১৯, ৪:০০ এএম says : 0
    বিচারহীনতা ও দলীয়করণ থেকে আজকের এই অশুভ শক্তির রোষানলে বাংলাদেশ
    Total Reply(0) Reply
  • Gulamali Azmal Azmal ১ জুলাই, ২০১৯, ৪:০০ এএম says : 0
    "বিচারহীনতা" সময় যেদিন প্রকৃতির আপন নিয়মে বিচার শুরু করবে "বিপদ" তখন তাঁর স্বরূপ নিয়ে সবার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।পথ পাবে না কেও।
    Total Reply(0) Reply
  • Md Masum Howlader ১ জুলাই, ২০১৯, ৪:০১ এএম says : 0
    পুলিশ যদি ওদেরকে না ধরে। আপনারা সাংবাদিক ভাইয়েরা, বরগুনায় থাকবেন তথ্য নেন প্রতিটি মানুষের কাছে কাছে যান, ওদেরকে পেয়ে যাবেন জনসমক্ষে আপনারাই প্রকাশ করতে পারবেন।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হত্যা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ