পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গণতন্ত্রের নামে বর্তমান দুনিয়ায় লোকরঞ্জনবাদ বেশ ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। নির্বাচনে খুব সহজে কেল্লা ফতে করার জন্য দরকার জনগণের মনোরঞ্জন। এদিকে নির্বাচন ছাড়া গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতায় আসার বিকল্প কোনো পথও নেই। ফলে রাজনীতিকরা খুব সঙ্গত কারণেই এদিকে মনযোগ দিচ্ছেন। সমস্যা হলো, রাজনীতিবিদরা যখন দেখতে পান, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির মাধ্যমে একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনোরঞ্জন করা বেশ কঠিন, তখন তারা বিকল্প সহজ পথটি বেছে নেন নির্বাচনের কেল্লা ফতে করার জন্য।
বিকল্প পথটি খুব সহজই বলা চলে। প্রথমেই দেশের জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে জনমনে শঙ্কা তৈরি করতে হবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নিকট জাতীয় শত্রু হিসেবে দেশের অভ্যন্তরের (হতে পারে কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়) কিংবা বাইরের কাউকে না কাউকে উপস্থাপন করতে হবে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যদি সেই শত্রুকে বাস্তবিক শত্রু মনে করতে শুরু করে এবং এও বিশ্বাস করতে শুরু করে যে আসলেই এই শত্রু মোকাবেলায় কোনো একটি নির্দিষ্ট দল কিংবা নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে দরকার, তাহলেই হলো। এরপর আর ভোটারের মনোরঞ্জনের জন্য দেশের সত্যিকারের উন্নয়নের দরকার পড়বে না, কথিত শত্রুর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান ব্যক্ত করেই লোকরঞ্জন করা সম্ভব হবে, ভোটের মাঠও ঠিক থাকবে।
আধুনিক গণতান্ত্রিক বিশ্বে এই বিষয়টি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ট্রাম্প যেভাবে প্রচারণা চালিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন, তার সাথে উপরের পদ্ধতির খুব একটা বেমিল নেই। সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের কথিত ‘একমাত্র গণতন্ত্রের দেশ’ ইসরায়েলে নেতানিয়াহুও একই ধরনের প্রচারণার জোরে পুনরায় ক্ষমতায় এসেছেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্তে¡ও তিনি ইসরায়েলের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে, ফিলিস্তিনিদেরকে দমন করার ক্ষেত্রে তার চেয়ে উত্তম বিকল্প এই মুহূর্তে আর নেই। ফলে দুর্নীতির অভিযোগ পাত্তা পায়নি, তিনিই বিজয়ী হয়েছেন।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দাবিদার ভারতের সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনেও একই ঘটনা ঘটেছে। গত পাঁচ বছরের শাসনামলে বিজেপি দেশটির উল্লেখযোগ্য কোনো সমস্যারই সমাধান করতে পারেনি, উল্টো আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। বেকারত্বের হার ইতিহাসের যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে অনেক বেশি, কৃষকের আত্মহত্যার রেকর্ড হচ্ছে, অনুন্নত প্রদেশগুলোতে বলার মতো কোনো উন্নয়নই হয়নি, তা সত্তে¡ও এবারের বিজেপির ইশতেহারে কিন্তু উন্নয়নের অঙ্গীকার ছিল না, ছিল না এসব সমস্যা সমাধানের কোনো আশ্বাস। গত মেয়াদে উন্নয়ন করতে না পারা কিংবা মোটা দাগের দুর্নীতিসমূহের জন্য কোনো কৈফিয়তও পেশ করেনি দলটি। সে তুলনায় কংগ্রেসের ইশতেহার ছিল অনেক বেশি গণমুখী। তবু বিজেপির ভূমিধ্বস বিজয় হলো। কিন্তু কেন?
নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি ভারতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে বিজেপির কোনো বিকল্প নেই। বিজেপি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করেছে পাকিস্তানকে, উপস্থাপন করেছে তথাকথিত বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী মুসলিমদেরকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মধ্যে উসকে দিয়েছে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে। সেই সাথে এ বিষয়টি স্পষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে এসব শত্রু মোকাবেলা কিংবা আদর্শ বাস্তবায়ন শুধুমাত্র বিজেপির পক্ষেই সম্ভব। বালাকোট হামলা কিংবা আসামের নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে তাদের সেই উপস্থাপনা বিশ্বাসযোগ্যতা হাসিল করেছে। ফলে কত কৃষক আত্মহত্যা করলো, বেকারত্বের হার কত কিংবা দেশের অর্থনীতির কী অবস্থা সেসব বিবেচনা না করেই ভোটাররা ‘দেশের স্বার্থে’ বিজেপিকেই আবারো ক্ষমতায় এনেছে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সস্তা মনোরঞ্জনের এই পদ্ধতিটি আসলে সকলের জন্যই ভয়াবহ। একদিকে এর ফলে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন ব্যাহত হয়, কোনো সমস্যারই সমাধান হয় না, অন্যদিকে সংখ্যালঘুদেরকে দেশের শত্রু হিসেবে উপস্থাপন করে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিকে অসহনীয় করে তোলা হয়। সরকার টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের জনগণের মনোরঞ্জন করতে না পেরে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় আবেগ ব্যবহার করে জনগণের নিকট নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে চায়।
ভারতে ভয়াবহ রকমের লোকরঞ্জনবাদের উত্থানে দেশটির অভ্যন্তরে কী হতে পারে, সে আলোচনা আপাতত বাদ দিলেও বাংলাদেশের জন্যও দুশ্চিন্তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। নির্বাচনের আগেই আসামের বাঙালিদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে। পরে অবশ্য ‘কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে অনুপ্রবেশকারী এমন হিন্দুদেরকে’ নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য আরেকটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এর ফলে আসামের বাঙালি মুসলমানরাই কেবল নাগরিকত্ব নিয়ে ঝামেলায় পড়বে।
নির্বাচনের সময় বিজেপির নেতৃত্ব পশ্চিমবঙ্গে ‘বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারীদেরকে’ বঙ্গোপসাগরে ছুড়ে ফেলার হুমকি দিয়েছে। কাজেই অদূর ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গেও যদি আসামের মতো নাগরিকত্ব আইন হয়, তাহলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। মনে রাখা উচিত, পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু এবার বিজেপির ভালো রকমেরই উত্থান হয়েছে।
আসাম কিংবা পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদেরকে বাংলাদেশি আখ্যায়িত করার ফলে অদূর ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের মতো এদেরকেও বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেওয়া হয় কি না, সে আশঙ্কাটি তৈরি হচ্ছে। রোহিঙ্গাদেরকেও মায়ানমার বাংলাদেশি বলেই আখ্যায়িত করে। হয়তো এখনই এরকম কিছু হবে না, কিন্তু নাগরিকত্ব বাতিলের ফলে ধীরে ধীরে এসকল মানুষ যখন ভারতের মূলধারার জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে, শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়বে, তখন এরকম কোনো কিছু হওয়ার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এবার বিজেপির পতন হলে হয়তো এ আশঙ্কা অনেকটা কমে যেতো, কিন্তু বিজেপি শুধু পুনরায় বিজয় অর্জনই করেনি, বরং আরো শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছেছে। ফলে আশঙ্কাটিও আরো তীব্র হচ্ছে। বাংলাদেশের উচিত এখনই এ বিষয়ে কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং ভারতের নাগরিকদের একটি অংশকে বাংলাদেশি বলে আখ্যায়িত করার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করা।
প্রশ্ন হলো, উপরে আলোচিত ভয়াবহ এই লোকরঞ্জনবাদের শেষ কোথায়? গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের নামে যেসকল তত্ত¡কথা আওড়ানো হয়, সেগুলো শুনতে যত সুশ্রাব্যই হোক না কেন, বাস্তবে গণতন্ত্রে সংখ্যাগিরষ্ঠ মানুষের মনোরঞ্জনের কোনো বিকল্প নেই। ক্ষমতালোভী রাজনীতিকরা এই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে যে কোনো ঘৃণ্য পন্থা অবলম্বন করতে পিছপা হয় না। ফলে সত্যিকারের উদার রাজনীতি করার সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই সমস্যার আদৌ কোনো সমাধান হবে কি না, তা যথেষ্ট সন্দেহের বিষয়।
তবে এ কথা সত্যি, নিছক উগ্র জাতীয়তাবাদ আর সংখ্যালঘুদের বিরোধিতার উপর একটি দেশ টিকে থাকতে পারে না। পেটে ভাত না থাকলে কিছু দিন হয়তো ধর্মের কথা, জাতীয়তাবাদ আর জাতীয় নিরাপত্তার কথা শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু একসময় ভাতই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। ভারতের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব আর কৃষকের ভয়াবহ দুর্দিনে কতদিন পর্যন্ত ভোটারদের মনোরঞ্জনে বিজেপির বর্তমান কৌশল কাজে লাগে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
লেখক: কলামিস্ট, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।
email: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।