পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
খাদ্যে ভেজাল হলো খাদ্যে নিম্নমানের, ক্ষতিকর, অকেজো ও অপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মেশানো। প্রকৃতিগত, গুণগত ও নির্ধারিত মানসম্মত না হলে যে কোনো খাদ্যদ্রব্যই ভেজালযুক্ত বিবেচিত হতে পারে। অসৎ, অসাধু ব্যক্তি তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যই সাধারণত এ কাজ করে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯ সালে গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসকে হ্যামলক বিষ দিয়ে মারা হয়েছিল। শোনা যায় নেপোলিয়ান বোনাপার্ট, ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জসহ আরো অনেক নামকরা ব্যক্তি আর্সেনিকের বিষে ঘায়েল হয়েছেন। যিশুখৃষ্ঠের মৃত্যুর প্রায় অর্ধশতাব্দি পর রোমান স¤্রাট ক্লাউডিয়াসকে তার স্ত্রী একোনাইট বিষসহ মাশরুম খাদ্যের মাধ্যমে হত্যা করেছিল। এরপর পেরিয়ে গেছে বহু যুগ। বিষের ধরনেও এসেছে ভিন্নতা। বটুলিনাম, সায়ানাইড, মারকারি, পোলোনিয়াম, টেট্রোডোটক্সিন, ডাইমিথাইল-মারকারি, বেলাডোনা, অ্যানথ্রাক্স, বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত গ্যাস যুগেযুগে ব্যবহৃত হয়েছে বা হচ্ছে মানুষ মারার কাজে। বর্তমান সময়ে এই বিষগুলো সুনিপুণভাবে মিশিয়ে দেয়া হয় আমাদেও খাবারে।
ফল পাঁকার মূলনীতি না জানলেও যুগ যুগ ধরে গ্রামগঞ্জে বিভিন্নভাবে ফল পাঁকানো হয়েছে যা স্বাস্থ্যসম্মত। ছোটবেলায় দেখেছি বড় কোলা, ড্রাম, ভুসি বা তুলার মধ্যে কলা, বেল, আম, আতা, ছবেদা ইত্যাদি ফল রেখে পাঁকানো হতো। কলার ছড়া গর্তের ভেতর খড়ের উপর একত্র করে চারপাশএবং উপরে খড় দিয়ে ঢেকে রাখা হতো। কয়েকদিন পর পাওয়া যেত সুস্বাদু ফল। এ ধরনের পদ্বতিতে ইথিলিনের (বিশেষ ধরনের হরমোন) যে কতবড় ভূমিকা রয়েছে তা তাদের জানা না থাকলেও পূর্ববর্তী বংশধরদের কাছ থেকে তারা সঠিক পদ্বতিই শিখেছিল। যুগের সাথে পাল্টেছে পদ্বতিরও। প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখন মানুষ নিজেদের অজান্তে খাদ্যে ভেজাল মেশাচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে না জেনে বিষাক্ত কেমিকেলকে ক্ষতিকারক না ভেবে বরং উপকারী জিনিস হিসেবে বিবেচনা করে ভুল করছে। তাদের ভাষায়- এটাতো ঔষধ। রোগ সারাতে ঔষধ লাগে সূতরাং এটা খারাপ হয় কিভাবে! দেখা যায় তারা নিশ্চিন্তে এগুলো ব্যবহার করছে। ছোট আকারের এক বোতল ফরমালিন মেডিসিন হিসেবে এক ড্রাম পানিতে মিশিয়ে তাতে চুবিয়ে বাজারজাত করছে তাদের উৎপাদিত পটল, করলাসহ অন্যান্য শবজি। কাজটা একবার করতে পারলেই তারা নিশ্চিত হয় যে তাদের পন্য আর পঁচবে না। অনেক ক্ষেত্রে তারা জানেও না কি মেশাচ্ছে শাক-শবজি বা ফলে। গ্রামের নিরীহ মানুষ অনেক ক্ষেত্রে না জেনে ক্ষতিকর কেমিকেল মেশালেও বিভিন্ন আড়তের ঘটনা একেবারেই উল্টো। সেখানে এগুলো মেশানো হয় অনেকটা জেনে-বুঝে। জানা যায়, অতি মুনাফা লাভের আশায় বিবেক বিবর্জিত হয়ে অসাধু আড়ৎদাররা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মৌসুমি ফল বা কাঁচা শবজি যেমন টমেটো, করলা ইত্যাদি সস্তা দামে কৃষক বা বাজার থেকে কিনে কার্বাইড দিয়ে পাঁকিয়ে তাতে পচনরোধক ফরমালিন ব্যবহার করে গুদামজাত করে থাকে। পরে ধীরে ধীরে চড়াদামে বাজারে বিক্রি করে। তাদের ভাষায়- ফরমালিন একটি প্রিজারভেটিভ।অথচ ফল পাঁকার জন্য গাছের নিজস্ব এক প্রকার হরমোন (ইথিলিন) প্রধান ভূমিকা রাখে। ফল পাঁকা ও পাতা ঝরার সময় গাছের কান্ড, মুল, পাতা, ফুল, ফলসহ অন্যান্য অংশে ইথিলিন তৈরি স্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, যার প্রভাবে ফলের অভ্যন্তরে থাকা বেশ কিছু এনজাইম সক্রিয় হয়ে ওঠে- এর মধ্যে অ্যামাইলেজ, হাইড্রোলেজ এবং পেকটিনেজ অন্যতম। এনজাইমগুলোর কোনটা ফলকে নরম করে, কোনটা রং পরিবর্তন করে আবার কোনটা মিষ্টি, সুস্বাদু বা সুগন্ধির জন্য দায়ী। অ্যামাইলেজ ফলের ত্বক নরম করে ও ফলের মাংসে থাকা জটিল শর্করাকে ভেঙ্গে সরল চিনিতে পরিনত করে যার ফলে পাঁকলে ফল খেতে মিষ্টি লাগে। আমরা জানি ক্লোরোফিলের রং সবুজ যে কারনে কাঁচা ফল সবুজ দেখায়। হাইড্রোলেজ অ্যানজাইম সবুজ ক্লোরোফিলকে ভেঙ্গে এ্যানথোসায়ানিনে রুপান্তরিত করে যার কারনে পাঁকা ফল আকর্ষনীয় লালচে, হলদে বা কমলা রং ধারন করে। তাছাড়া এ অ্যানজাইম ফলের মধ্যে সুগন্ধি যৌগ তৈরি করে বিধায় পাঁকা ফল হতে মন মাতানো সুগন্ধ ছড়ায়। কাঁচা ফলে পেকটিন নামক এক প্রকার পদার্থ প্রচুর পরিমানে থাকার কারনে তা পাঁকা ফলের তুলনায় শক্ত হয়। পেকটিনেজ এনজাইম কাঁচা ফলের পেকটিনকে কমিয়ে দেয় ফলে পাঁকা ফল নরম ও কোমল হয়। কাজেই ইথিলিনের কম বেশীর সাথে ফলের পাঁকা না পাঁকার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। আর ফল পরিপক্কতার সাথে সম্পর্ক রয়েছে ইথিলিন ও উল্লেখিত এনজাইমগুলোর পরিমানের। অপরিপক্ক অবস্থায় গাছ থেকে ফল পেড়ে কৃত্রিমভাবে পাঁকালে তার রং, স্বাদ কোনটাই আশানুরুপ হয় না। বাজারে কলাসহ বিভিন্ন ফল পাওয়া যায় যার ভেতরে একাংশ নরম তো অন্য অংশ শক্ত এবং স্বাদে বিশ্রী। অপরিপক্ক অবস্থায় ফল পেড়ে কেমিকেল বিশেষ করে কার্বাইড দিয়ে পাঁকানোর কারনে এরকম হয়। জানা যায়- ফলের আড়তে কার্বাইডের পুটলি রেখে বা কার্বাইড মিশ্রিত দ্রবনে চুবিয়ে বা অনেক ক্ষেত্রে স্প্রে করে কৃত্রিমভাবে ফল পাঁকানো হয়। ইথিলিনের ব্যবহারে অনুমতি থাকলেও, কোন অবস্থায় কার্বাইড বা ফরমালিন ব্যবহারের অনুমতি নেই। বাংলাদেশের মত বিশ্বের সব দেশেই ফল পাঁকাতে কার্বাইডের ব্যবহার একেবারেই নিষিদ্ধ। তাছাড়া বানিজ্যিকভাবে বাজারে প্রাপ্ত কার্বাইড বিশুদ্ধ নয়। ভেজাল হিসেবে এর সাথে কিছু পরিমান আর্সেনিক ও ফসফরাস থাকে ফলে সুস্বাস্থ্যের জন্য সে কার্বাইড অনেক বেশী ক্ষতিকর।
শুধুই কি শাক-সব্জিতে? না ভেজাল রয়েছে প্রায় সব খাবারে। ভেজাল দেওয়ার প্রক্রিয়ায় খাদ্যশস্যে বহির্জাত পদার্থ সরাসরি যোগ করা হয়, যেমন ওজন বৃদ্ধির জন্য বালি বা কাঁকর, ভাল শস্যের সঙ্গে কীটপতঙ্গ আক্রান্ত বা বিনষ্ট শস্য মেশানো ইত্যাদি। কেউ কেউ ধানভানার সময় খুদ ও কুঁড়া যোগ করে ওজন বাড়ায়। আজকাল দানাশস্য-এর সঙ্গে শস্যদানার আকারের প্লাস্টিকের ছোট ছোট টুকরা আর ডালের সঙ্গে রঙিন টুকরা মেশানো হয়। অনেক সময় মজুদ খাদ্যশস্যের ওজন বাড়ানোর জন্য কেউ কেউ তাতে পানি ছিটায়। তেল ও চর্বিতে ভেজাল দেওয়া খুবই সহজ এবং এগুলি শনাক্ত করাও দুরূহ। ঘি-এর সঙ্গে পশুচর্বি দিয়ে ভেজাল দেওয়া হয়ে থাকে। ইদানিং কৃত্রিম রং ও গন্ধদ্রব্য আবিষ্কারের ফলে চর্বি দিয়ে নকল ঘি বানিয়ে ভোক্তাদের সহজেই ঠকানো যায়। তিল বা নারিকেল তেলের সঙ্গে প্রায়ই বাদাম তেল বা তুলাবীজের তেল মেশানো হয়ে থাকে। সরিষার সঙ্গে প্রায়ই শিয়ালকাঁটার বীজ একত্রে মিশিয়ে তেল বের করা হয়। উল্লেখ্য, শিয়ালকাঁটার তেলের স্যাঙ্গুইনারিন উপদান অত্যন্ত বিষাক্ত এবং যা পক্ষাঘাত ঘটায়। সয়াবিন তেল বা পামতেলের সঙ্গে এলাইলআইসোথিওসায়ানেট মিশালে তাতে সরিষার তেলের মতো ঝাঁঝ হয় এবং সহজেই সরিষার তেল বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। সয়াবিন তেলের সঙ্গে পামতেলের ভেজাল মেশানো অধিক মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ীদের একটি চিরাচরিত অপকর্ম। অনেক সময়ে দুধের মাখন তুলে নিয়ে অথবা দুধে পানি মিশিয়ে ভেজাল দুধ বাজারজাত করা হয়। কখনও কখনও সয়াবিন তেল বা বাদাম তেল, ময়দা ও অন্যান্য দ্রব্যাদি দুধে মেশানো হয়। মহিষের দুধ পানি দিয়ে পাতলা করে গরুর দুধ বলে সহজেই চালানো যায়। গুঁড়াদুধে ময়দা, সুজি ও অন্যান্য দ্রব্য মেশানো খুবই সহজ। ব্যবহৃত চা পাতা, কাঠের গুঁড়া ও শুকনা পাতার গুঁড়া দিয়ে চায়ে ভেজাল দেওয়া হয়। মসলার মধ্যে লঙ্কা বা হলুদ গুঁড়াতে সীসাজাতীয় রঞ্জক পদার্থ মিশিয়ে রঙের উজ্জ্বলতা বাড়ানো হয় এবং দেখতে ভাল দেখায়। মিষ্টিজাতীয় দ্রব্যাদি তৈরিতে ছানার পরিবর্তে বেশি বেশি চালের গুঁড়া, টিস্যুর গুড়া বা ময়দা মিশায়। কোমল পানীয় তৈরীতে তরল গøুকোজ বা চিনির সিরাপের পরিবর্তে প্রায়শ ব্যবহৃত কার্বোক্সি মিথাইল সেলুলোজ মেশানো হয়। বিভিন্ন ফলের রসের নামে কৃত্রিম ও নিষিদ্ধ দ্রব্য ব্যবহার করে নকল রস তৈরী হয়ে থাকে। মিনারেল ওয়াটার নামে বাজারে যে পানির ব্যবসা চলছে তাতে গুণ ও মানের নিশ্চয়তা অতি সামান্য বা অনেক ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। তবে সার্বিক ক্ষতির বিবেচনায় উল্লেখিত বিষের চেয়ে খাদ্যপন্যে ভেজাল আরো অনেক বেশী মারাত্বক। কেননা খাদ্যে ভেজালের মাধ্যমে কোন একজন ব্যক্তি নয় বরং গোটা জাতি তিলে তিলে শেষ হয়ে যায়। চার, পাঁচ বা ছয়স্তর বিশিষ্ট কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনি বা গ্রীন জোনের মধ্যে থেকেও ভেজালের কবল থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশে খাদ্যপন্য উৎপাদনকারী থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ ব্যাক্তি সবাই ভেজাল পন্য দ্বারা কোন না কোনভাবে ক্ষতিগস্থ হচ্ছেন। মৌসুমি ফল, শাক-শবজি, খাদ্যশস্য, শিশুখাদ্য, পানীয়, মুড়ি, বেকারি পন্য, জিলাপি, ফার্স্ট ফুড, পশুখাদ্য, ঔষধ সকল দ্রব্যেই রয়েছে ভেজাল।
খাদ্যে নিষিদ্ধ ফরমালিন বা কার্বাইডের উপস্থিতি পরীক্ষার উপকরন সহজলভ্য করা জরুরী। ‘কিটবক্স’ এর সুবিধা জরুরী ভিত্তিতে আরো অনেক বেশী বিস্তৃত করা দরকার। খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিনের অস্তিত্ব পরীক্ষায় এক অসাধারন সাফল্য পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট (বারি)। মাত্র ৫ সেকেন্ড সময়ে ও নামমাত্র মুল্যে ফরমালিনের অস্তিত্ব নির্ণয় করা সম্ভব এক ধরণের বিশেষ পদ্বতিতে। জাতীয়ভাবে এ ধরণের পদ্বতি সবার জন্য সহজলভ্য করতে হবে। খাদ্যে ফরমালিনের উপস্থিতি নির্ণয় করে তা পরিহার করার পাশাপাশি সাধারণ কিছু নিয়ম মেনে চললে ফরমালিনের হাত থেকে অনেকটা বাঁচা সম্ভব। মৌসুমি ফল অন্য মৌসুমে খাওয়া থেকে বিরত থাকা যেতে পারে। খোলাবাজার থেকে কাটা ফল যেমন আনারস, পেঁপে ইত্যাদি না খাওয়াই ভালো। ফল বা ফলজাতীয শবজি রান্নার আগে খোসা ফেলে দেওয়া ভালো। রান্নার আগে মাছ বা শাক-শবজি এবং খাওয়ার আগে ফল কিছুক্ষণ পানিতে ভিজিয়ে রেখে প্রবাহমান পানি দিয়ে ভালো মত ধুয়ে রান্না করা বা সরাসরি খাওয়া যেতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে লবনাক্ত পানিতে ফরমালিন দেওয়া মাছ ১ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখলে ৯০ ভাগ পর্যন্ত ফরমালিন কমে যায়। ভিনেগার মিশ্রিত পানিতে (১:৯ অনুপাতে) ফরমালিন মেশানো মাছ ১৫-২০ মিনিট ভিজিয়ে রাখলে শতভাগ পর্যন্ত ফর্মালিন দূর করা সম্ভব। শাক-শবজির ক্ষেত্রেও একই পদ্বতি অবলম্বন করা যেতে পারে। তবে দু:খের বিষয় হলো খাদ্য দ্রব্যতে এখন শুধু ফরমালিন দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না বিভিন্ন ধরণের বিষাক্ত পদার্থ দেওয়া হচ্ছে যা উল্লেখিত পদ্ধতিতে খাদ্যদ্রব্য থেকে বিষাক্ত পদার্থগুলো বের কওে আনা সম্ভব নয়।
বিষাক্ত কেমিকেলযুক্ত খাদ্য খেয়ে আমরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। এতে রয়েছে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি ভয়ঙ্কর প্রভাব। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে গর্ভবতী মা ও শিশুরা। বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন রোগ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বিষাক্ত কেমিকেল শরীরে স্থায়ী স্ট্রেসের সৃস্টি করে। কেমিকেলযুক্ত খাদ্যের দরুণ নষ্ট হচ্ছে আমাদের শরীরের অত্যবশ্যকীয় অঙ্গ যেমন- লিভার, কিডনি, হৃৎপিন্ড, ফুসফুস, চোখ, কান ইত্যাদি। আক্রান্ত হচ্ছি বিশেষ করে লিভার ক্যানসার, লিভার সিরোসিস, বøাড ক্যানসার, কিডনি ফেইলুর, হৃদরোগ, অ্যানিমিয়া ইত্যাদি রোগে। খাদ্যে অরুচি, ক্ষুধামন্দা, গ্যাস্ট্রিক আলসার, পাকস্থলী-অন্ত্রনালির প্রদাহ ইত্যাদি এখন নিত্যনৈমিত্বিক সমস্যা। বন্ধাত্ব, অ্যাবোরসন, হাবাগোবা বা বিকলাঙ্গ সন্তানের জন্ম হওয়া, সন্তানের বৃদ্ধি ব্যহত হওয়াসহ নানাবিধ সমস্যার জন্য ভেজাল খাবার একটি অন্যতম কারণ। গবেষণায় জানা যায়, খাদ্যে ভেজালের কারণে দেশে প্রতিবন্ধি শিশুর সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলছে। মারাত্বক এসব রোগের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা করেও লাভ হয় না। অকারণে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে চিকিৎসার প্রয়োজনে। কাজেই জনস্বাস্থ্যের মারাত্বক ক্ষতির পাশাপাশি ব্যপক চাপ বাড়ছে অর্থনীতির উপর। ভালোমানের চিকিৎসার ব্যয়ও ক্রমেই বাড়ছে। এমতাবস্থায় অর্থাভাবে ভাল চিকিৎসায় অক্ষম মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র মানুষ।
স্বার্থের জন্য মানুষ পানির মধ্যেও ভেজাল করছে। যেই দেশের কৃষকরা তাদের ন্যায্য মজুরি পায়না সেই দেশে আধা লিটার বিষাক্ত পানির মূল্য প্রায় ১৫-২০ টাকা। ভেজালের মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে আমাদের হয়তো পুরো শরীরটাই ভেজালে আছন্ন হয়ে আছে।এন্টিবায়োটিকেও বিষ। সম্প্রতি ভেজাল বিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ টিম সফলভাবে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। তারা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বাজারে ভেজাল পণ্য সনাক্তকরণ এবং তা বাজার থেকে তুলে নেয়ার জোড় নির্দেশ দিয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে। নি:সন্দেহে ভালো উদ্যোগ। শুধু কঠিন থেকে কঠিনতম আইন পাশ করলেই চলবে না প্রয়োজন তার যথাযথ বাস্তবায়ন। সাথে সাথে প্রয়োজন ব্যপক জনসচেতনতা। অসাধু ব্যবসায়ী বা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখাতে হবে এবং তাদেরকে আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি সুনিশ্চিত করতে হবে এবং তা গনমাধ্যমে ব্যপকভাবে প্রচার করতে হবে। গ্রামবাংলার আপামর জনসাধারণ থেকে শুরু করে শহরের উচ্চশিক্ষিত সবাইকে ব্যপক দ্রæততম সময়ে ব্যপক প্রচার-প্রসার করতে হবে বা অভিযানের মাধ্যমে সচেতন করতে হবে। খাদ্য ভেজাল একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, এর সচেতনতার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নাটক, সিনেমা, বাউল-সংগীত, আলোচনা ইত্যাদির আয়োজন করা এবং তা ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ব্যপক প্রচারের ব্যবস্থা করা, মাইকিং করা, সাথে সাথে পত্রিকা, ম্যাগাজিন, লিফলেট, পোস্টার, দেয়ালিকা, ফোল্ডার ইত্যাদি প্রকাশের মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করতে হবে। খাদ্য উৎপাদনের সাথে সরাসরি জড়িত ব্যক্তি, আইন প্রয়োাগকারী সংস্থার সদস্য, রাজনীতিবিদ, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, গবেষক- সবাই এ বিপর্যয়কে নিজেদের জীবন-মরণ সমস্যা মনে করলে খুব সহজেই সমস্যার সমাধান সম্ভব। তাই ভেজালে বিরুদ্ধে আমাদের সকলকে সোচ্চার হতে হবে। জীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালিত করতে হলে ভেজালমুক্ত খাদ্য’র কোন বিকল্প নেই। তাই ভেজালের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ ঘোষনা করতে হবে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় প্রতিষ্ঠিত সিন্ডিকেটকে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ভেঙ্গে দিতে হবে। আঞ্চলিক পর্যায়ে আধুনিক খাদ্য সংরক্ষনাগার নির্মাণ ও তার ব্যবহার সহজলভ্য করতে হবে যাতে করে কৃষক থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা, আড়ৎদার সবাই সহজে ও কম খরচে সে সুবিধা নিতে পারে। খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ প্রভৃতি কাজে যারা সরাসরি জড়িত তাদেরকে বিশেষ-ট্রেনিং এর মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। তাদেরকে সর্বোচ্চ সচেতন করে তুলতে হবে। কৃষিজাত পন্যে ভেজাল মনিটরিং করার জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি স¤প্রসারণ কর্মকর্তার সংখা বাড়ানো যেতে পারে। পাশাপাশি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন মোবাইল কোর্ট থাকবে যাতে যে কোন সময় বিনা নোটিশে বাজারের খাদ্যপন্য পরীক্ষা করে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়।
লেখক: শিক্ষক, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।