শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
শৈশবে আমি না-কি খুব বেশি অস্থির রেখেছি আমার মাকে। কারণে অকারণে অর্থহীন চিৎকারে তাঁকে ডেকে উঠেছি কান্নার ভাষায়। মা আমাকে কোলে তোলে আদর করে বুকে জড়িয়ে রাখত, আমি সুখ পেতাম। এ সুখ তখন বুঝিনি। মা প্রায়ই আমাকে এ কথাগুলো বলে থাকেন। আমি ছাড়া আমার আরও সাত ভাই-বোন কেউ নাকি মাকে ততটা কষ্ট দেয় নি, যতটা কষ্ট আমি দিয়েছি। শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে এখন আমি মধ্যযৌবনে। মায়ের মুখে এসব কথা শুনে মনে মনে ভীষণ অনুতপ্ত হই। কথাগুলো মা এমনি এমনি বলেন না। এ বয়সেও যখন নিজের অজান্তে আমি মাকে এক-আধটু কষ্ট দিয়ে ফেলিÑ তখনই মা কথাগুলো বলেন। সেদিন বাসায় ফিরতে দেরি হয়ে গিয়েছিল আমার। দেরি বলতেÑ প্রতিদিন যে সময়ে বাসায় ফিরি তার চেয়ে আধ ঘণ্টা বেশি দেরি হয়েছিল। আমি কাজের চাপে মাকে ফোন করে দেরি হওয়ার কথা জানাতে ভুলে গিয়েছিলাম। মা পাঁচবার ফোন করেছেন। আমি একবারও ফোনটা রিসিভ করতে পারি নি। আমাকে কলব্যাকও করিনি। বাসায় ফেরার পর মা আবার সেই কথাগুলো বলা শুরু করেছে। সারাজীবন ধরেই নাকি আমি মাকে জ¦ালিয়ে মারছি। আমি কি কখনোই মাকে জ¦ালাতে চাই? আমি চাইÑ আমার শরীরের সব রক্তকণার বিনিময়ে হলেও আমার মাকে সুখী করতে। কিন্তু মাকে তা বোঝাতে পারি না। মাকে আমি যে কতটা ভালোবাসি কখনও তা বলতেও পারি নি। মাকে নিয়ে আমার একটা গল্প অথবা কবিতা লেখার কথা ছিল। কিন্তু লিখতে পারি নি। লিখতে বসলেই মনে হয়, আমি আমার মাকে নিয়ে ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’র চেয়ে বড় একটা কাব্য লিখতে পারি। কিন্তু কখনও লেখা হয় নি। আজ মাকে নিয়ে লিখতে বসে বার বার একটি কথা মনে পড়ছে। সেদিন সময়টা ছিল বিকেল। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। আমার শোবার ঘরের আলনা কিংবা শো’কেসের আড়ালে কী যেন এক প্রাণীর অদ্ভুত ডাক শুনতে পাই। মা দৌড়ে ছুটে এসে বলে, ‘ওদিকে যাবি না, আমি দেখছি কী না কী লুকিয়ে আছে ওখানে। সাপ কিংবা বিষাক্ত কিছু হয় যদি!’
আমি তখন মনে মনে ভাবি, সাপ-কি মায়েদের ছোবল দেয় না? এই একটা ঘটনা নিয়ে লেখা শুরু করলেই আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মহাকাব্য লেখা হয়ে যাবে। কিন্তু আজো একটি কাব্যের চরণ লেখা হয় নি। মা আমার পৃথিবীর সবচেয়ে আপন ও প্রাণের চেয়ে প্রিয়। আমি না লিখলে কী হবে? মাকে নিয়ে অনেকে কবি-সাহিত্যিক লিখে গেছেন তাঁদের নিজেদের মতো করে। কাজী নজরুল ইসলাম ‘মা’ কবিতায় লিখেছেনÑ ‘যেখানেতে দেখি যাহা/ মা-এর মতন আহা/একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,/মায়ের মতন এত/ আদর সোহাগ সে তো/ আর/কোনখানে কেহ পাইবে ভাই!/হেরিলে মায়ের মুখ/দূরে যায় সব দুখ,/মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান।’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেনÑ ‘আমি যদি দুষ্টুমি করে/চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি,/ভোরের বেলা, মা গো,/ডালের ’পরে/কচি পাতায় করি লুটোপুটি-/তবে তুমি আমার কাছে হারো-/তখন কি, মা, চিনতে আমায় পারো?’
‘বীরপুরুষ’ কবিতায় লিখেছেনÑ‘মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে/মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।/তুমি যাচ্ছ পালকিতে, মা, চ’ড়ে/দরজা দু’টো একটুকু ফাঁক ক’রে।’
জসীম উদ্দীন তার পল্লী-জননী কবিতায় লিখেছেনÑ ‘রুগ্ন ছেলের শিয়রে বিসয়া একেলা জাগিছে মাতা, /করুণ চাহনি ঘুম ঘুম যেন ঢুলিছে চোখের পাতা। /শিয়রের কাছে নিবু নিবু দীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলে, /তারি সাথে সাথে বিরহী মায়ের একেলা পরাণ দোলে।’
কবি কামিনী রায় লিখেছেনÑ ‘জড়ায়ে মায়ের গলা শিশু কহে আসি,-/‘মা, তোমারে কত ভালোবাসি!’/কত ভালবাস ধন?’ জননী শুধায়।/‘এ-ত।’ বলি দুই হাত প্রসারি দেখায়।/‘তুমি মা আমারে ভালবাস কতখানি?’/মা বলেন ‘মাপ তার আমি নাহি জানি।/‘তবু কতখানি, বল।’/‘যতখানি ধরে/তোমার মায়ের বুকে।’
কবি শামসুর রাহমানের ‘কখনো আমার মাকে’ কবিতাটি পড়ে আমরা আবেগাপ্লুত হয়েছি। ‘কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি/সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে/আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না।’
‘আমাদের মা’ কবিতাটি পড়লে হুমায়ুন আজাদের মা যেন হয়ে উঠে আমাদের মাÑ ‘আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।/আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,/কথা বলতে গিয়ে কখনোই/কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতো না।’
কবি কালিদাস তাঁর বিখ্যাত ‘মাক্তৃভক্তি’ কবিতায় লিখেছেনÑ ‘বায়েজিদ বোস্তামী- /শৈশব হতে জননীর সেবা করিতেন দিবাযামী। /দুপুর রাত্রে জননী জাগিয়া ডাকিলেন, ‘বাছাধন, /বড়ই পিয়াস পানি দাও’ বলি মুদিলেন দু’নয়ন। /দেখিল বালক ঘরের কোণের কলসিতে নেই পানি, /বহুদূর পথ ঝরনা হইতে কলসি ভরিয়া আনি।
কবি সুভাষ মখোপাধ্যায় লিখেছেনÑ ‘আমি ভীষণ ভালবাসতাম আমার মাকে/কখনও মুখ ফুটে বলি নি।/টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে/কখনও কখনও কিনে আনতাম কমলালেবু/শুয়ে শুয়ে মা-র চোখ জলে ভ’রে উঠত/আমার ভালাবাসার কথা/মা-কে কখনও আমি মুখ ফুটে বলতে পারি নি।’
কবি আল মাহমুদ লিখেছেনÑ ‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে /হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।’
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ লিখেছেনÑ ‘মাগো, ওরা বলে,/সবার কথা কেড়ে নেবে/‘তোমার কোলে শুয়ে/গল্প শুনতে দেবে না।/বলো মা, তাই কি হয়?’
মাকে নিয়ে লেখা আরও লিখেছেন, আম্মা- আবদুল মান্নান সৈয়দ, মায়ের চোখে- দাউদ হায়দার, আমার হারানো মাকে-পুর্ণেন্দু পত্রী, আমার মায়ের চোখ- রফিক আজাদ, তোমার মা- হাবীবুল্লাহ সিরাজী, মা- দিলওয়ার, মা থাকো- দেবারতি মিত্র, তাদের মাতা, জগৎমাতা- জাহিদ হায়দার, মা-র কাছে ফেরা- রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, মা- জাহাঙ্গীর ফিরোজ, মাকে নিয়ে- আশিস স্যানাল, মাও যেন কবিতা লেখেন- জয় গোস্বাম, মা- সুজিত সরকার, আলোর ভাসান- সুনীলকুমার নন্দ, মা আমাকে ফিরিয়ে নাও- মাহমুদ শফিক, চক্রবর্তী, মা- পঙ্কজ সাহ, আমার মা-মাকিদ হায়দার, মাকে- আবদুল গনি হাজারী, মা- অসীম সাহা, আমার মা- শ্যামলকান্তি দা, মা- সুমিত্রা দত্তচৌধুরী, মা আমার- বৃন্দাবন দাস, গল্প লেখার মাকে- নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়, মা, তোমাকে- বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।