Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভবিষ্যত নিয়ে আতঙ্কিত ভারতের মুসলিমরা: বিবিসির প্রতিবেদন

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৬ মে, ২০১৯, ১১:৫২ এএম

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক ঘৃণা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক এই দেশটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অধীনে ক্রমশ ভয়াবহভাবে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। বিবিসিতে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখেছেন রাজিনি বিদ্যানাথান।

এতে তিনি লিখেছেন, ভারতে লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট গ্রহণের মাত্র কয়েকদিন আগের ঘটনা। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের একজন মুসলিম ব্যবসায়ী তার কাজ শেষে ফিরছিলেন। কিন্তু এ সময় তাকে ঘিরে ধরে দাঙ্গাকারীরা। ওই মুসলিমের নাম শওকত আলী। তাকে একদল দাঙ্গাকারী ঘিরে ধরে কর্দমাক্ত স্থানে হাঁটু গেঁড়ে বসতে বাধ্য করে। এরপর তার ওপর হামলা হয়। তাদের একজন শওকত আলীকে ভারতের নাগরিক কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন করেন। জানতে চান- ‘আপনি কি বাংলাদেশী?’ অন্য একজন শওকত আলীর দিকে আঙ্গুল নাচাতে নাচাতে জানতে চান, কেন এখানে গরুর মাংস বিক্রি করেছেন? এ সময় তার চারপাশে অনেক মানুষ সমবেত হয়। তারা শওকত আলীকে সহায়তা করার পরিবর্তে ঘটনা মোবাইলে ক্যামেরাবন্দি করতে শুরু করে।

প্রায় এক মাস পেরিয়ে গেছে। শওকত আলী এখনও ঠিক মতো হাঁটতে পারেন না। রাজিনি বিদ্যানাথান লিখেছেন, তিনি যেখানে দোকান চালান সেখান থেকে অল্প দূরেই তার বাড়িতে গেলাম সাক্ষাত করতে। তিনি বিছানায় পা ক্রস করে দিয়ে বসলেন। কথা বলার সময় অশ্রুতে চোখ ভরে যেতে লাগলো। তিনি বর্ণনা করতে লাগলেন কি ঘটেছিল সেদিন। শওকত আলী বলেন, তারা একটি লাঠি দিয়ে আমাকে পিটিয়েছে। মুখে লাথি মেরেছে। এ সময় তিনি তার থুঁতনির নিচে এবং মাথায় ক্ষতের চিহ্ন দেখান।

কয়েক দশক ধরে ছোট্ট একটি দোকান থেকে গরুর মাংস বিক্রি করে তার পরিবার। কিন্তু এর আগে কখনো তাদেরকে এমন বিপত্তিতে পড়তে হয় নি। ভারতের অনেক রাজ্যে গরুর মাংস বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে গরুর মাংস আসামে বিক্রি করা বৈধ। শওকত আলী শুধু শারীরিকভাবে আহত হন নি। একই সঙ্গে তার মানমর্যাদাও যেন কেড়ে নেয়া হয়েছে। তার ওপর হামলাকারীরা তাকে শূকরের মাংস ভক্ষণ করতে বাধ্য করেছে। তাকে বাধ্য করেছে ওই মাংস চিবাতে এবং তারপর তা গিলে ফেলতে। কান্নায় ভেঙে পড়েন শওকত আলী। তিনি বলেন, আমার এখন বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই। আমার ওপর যে আঘাত হানা হয়েছে তা আমার পুরো ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর আঘাত।

রাজিনি লিখেছেন, যেদিন আমরা শওকত আলীর সঙ্গে সাক্ষাত করতে গেলাম, সেদিন তার বাড়িতে সমবেত হলেন স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ। তারা সবাই শওকত আলীর কাহিনী শুনছিলেন। শুনতে শুনতে কেউ কেউ কাঁদতে শুরু করলেন। তাদের মধ্যে ভয়, তারাও কি একই রকম বিপর্যয়ের শিকার হবেন!

বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের নির্বাচন চলছে ভারতে। কিন্তু প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে, কিভাবে দেশটির ১৭ কোটি ২০ লাখ মুসলিমকে কিভাবে সেই যাত্রায় সবার সঙ্গে অঙ্গীভূত করা হচ্ছে তা নিয়ে। গরুর মাংস বিক্রির জন্য অথবা সন্দেহজনকভাবে গরুর মাংস বিক্রির অভিযোগে আক্রমণের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার সর্বশেষ শিকার শওকত আলী। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তার এক রিপোর্টে বলে যে, ২০১৫ সালের মে থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতের ১২টি রাজ্যে কমপক্ষে ৪৪ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৬ জনই মুসলিম। একই সময়ে ২০টি রাজ্যে শতাধিক হামলায় আহত হয়েছেন প্রায় ২৮০ জন। বার্ষিক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান মিশেলে ব্যাচেলেট সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হয়রানি ও তাদেরকে টার্গেট করা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে মুসলিম ও ঐতিহাসিকভাবে যেসব মানুষ পিছিয়ে পড়েছে এবং প্রান্তিক পর্যায়ে আছেন- যেমন দলিত, তারাই এমন আচরণের শিকার হচ্ছেন।

স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ভারতে সব ধর্মবিশ্বাসের মানুষের বিরুদ্ধে ধর্মীয় সহিংসতা কাঙ্খিত নয়। কিন্তু বাস্তব উদ্বেগের বিষয় হলো, যারাই বর্তমানে ক্ষমতা পান তারাই দায়মুক্তির সংস্কৃতি ভোট করেন। এর সবচেয়ে শিহরণ সৃষ্টিকারী ঘটনারগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে ভয়াবহ সব গণধর্ষণের পরের একটি বিষয়। গত বছর জানুয়ারিতে আট বছর বয়সী একটি মুসলিম মেয়ে তাদের ঘোড়াকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিল। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের কাঠুয়া জেলায় তার বাড়ি। সেখান থেকে তাকে অপহরণ করা হয়। হিন্দুদের একটি মন্দিরে তাকে এক সপ্তাহ জিম্মি রাখা হয়। এ সময়ে তাকে পর্যায়ক্রমে গণধর্ষণ করা হয়। নির্যাতন করা হয়। তারপর তাকে হত্যা করা হয়। এর পরে এ নিয়ে পুলিশ রিপোর্ট দেয়। তাতে বলা হয়, যাযাবর বলে পরিচিত মুসলিম বাকেরওয়াল সম্প্রদায়কে ওই এলাকা থেকে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি গ্রুপ। এ জন্যই তারা ওই অপরাধ ঘটিয়েছে।

এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। কাঠুয়ার প্রত্যন্ত এলাকায় ওই কন্যাশিশুর বাড়ির বাইরে এখন একজন পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে প্রহরা দিচ্ছেন। রাজিনি লিখেছেন, নিহত কন্যার পিতা আমার সঙ্গে যখন কথা বলছিলেন, তখন তার চোখ দিয়ে যেন অশ্রুর বাঁধ মানছিল না। তিনি বলছিলেন, অভিযুক্তরা বলেছে ও হলো একজন মুসলিম কন্যা। তাকে হত্যা করো। এতে তারা ভয়ে ভীত হয়ে যাবে এবং এ এলাকা থেকে পালিয়ে যাবে।

কিন্তু ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে তারা এক সময় যে বাড়িতে বসবাস করতেন তা তারা ছাড়তে পারেন নি। তারা ওই বাড়ি ছেড়ে যেতে চান না। কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। ওই কন্যাশিশুর মা বলেন, আমরা বাড়ির বাইরে যেতে ভয় পাই। ভয় হয় আমাদের জীবনও শেষ করে দিতে পারে। আমরা বাইরে পা বাড়ালেই লোকজন আমাদেরকে প্রহার করার হুমকি দেয়।

আট বছর বয়সী ওই কন্যাশিশুকে হত্যার পর হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে। ওই নৃশংসতায় অভিযুক্ত আটজন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের পক্ষেই রয়েছে বেশি মানুষের সমর্থন। তারা নির্যাতনে শিকার হয়ে মারা যাওয়া ওই শিশু ও তার পরিবারের প্রতি কোনো সহানুভূতি দেখায় নি। অভিযুক্তদের পক্ষে রাজপথে সমর্থন জানিয়ে যারা বিক্ষোভ করেছে তার মধ্যে রয়েছে রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা বিজেপির দু’জন মন্ত্রী চৌধুরী লাল সিং এবং চন্দর প্রকাশ গঙ্গা। ওই সময় এক র‌্যালিতে লাল সিং বলেছিলেন, একজন মেয়ে মারা গেছে। অনেক তদন্ত হচ্ছে। এখানে তো এরকম অনেক নারীই মারা যান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ