পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিশ্বে ঝড়-ঝঞ্ঝা ও বন্যার দেশ হিসেবে একসময় বাংলাদেশের ব্যাপক পরিচিতি ছিল। ঘুর্ণিঝড় আঘাত হানার পরবর্তী সময়ে ব্যাপক প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞ বিশ্বকে মর্মাহত করত। উন্নত বিশ্ব থেকে ত্রাণসামগ্রী ও উদ্ধার কাজে সহায়তা দিতে এগিয়ে আসত। এখন এ অবস্থা নেই। ঝড়-ঝঞ্ঝার পূর্বাভাস অনুযায়ী উপকূলবর্তী এলাকা থেকে মানুষকে আগেভাগে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশ অর্জন করেছে। গত সপ্তাহে ঘূর্ণিঝড় ফণী যেভাবে আঘাত হানার কথা ছিল, সেভাবে আঘাত হানলেও হয়তো প্রাণহানিসহ ক্ষয়ক্ষতি খুব বেশি হতো না। এর কারণ আগেভাগেই পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। অবশ্য ফসল ও বাড়িঘরের ক্ষতি হলেও প্রাণহানির সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। তারপরও সারাদেশে ঝড়ো হাওয়া ও বজ্রপাতে ১৫ জন নিহত হয়েছে। এছাড়া খুলনা অঞ্চলের কিছু এলাকায় বাঁধ ভেঙ্গে ঘরবাড়ি ও ফসলী জমি প্লাবিত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়েল প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, ফণীর প্রভাবে সারাদেশে ২১ হাজার ৩৩টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুরোপুরি বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেড় লাখের বেশি একর জমির ফসল। এ ক্ষতি কম না হলেও আগে যেভাবে ব্যাপক প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি হতো, তার তুলনায় কমই বলা যায়। এর কারণ আগাম প্রস্তুতি। বলা যায়, ক্ষয়ক্ষতি কমানোর ক্ষেত্রে দেশ আগের চেয়ে সক্ষমতা অর্জন করেছে। একটা সময় ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি এবং ত্রাণ নিয়ে যে হাহাকারের সৃষ্টি হতো এখন তা হয় না বললেই চলে। ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণসহায়তা বাংলাদেশ নিজেই দিতে পারছে। এটা বাংলাদেশের একটি বড় অর্জন। তবে ঝড়-জলোচ্ছ¡াস ভূখণ্ডে যে আঘাত হানে, তাতে সমগ্র উপকূল এবং বঙ্গোপসাগরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা চর ও দ্বীপাঞ্চলগুলো ব্যাপক ক্ষতির মুখোমুখি হয়। পরবর্তী সময়ে যথাযথ সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ না থাকায় এগুলোর অনেকের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এক্ষেত্রে যথেষ্ট উদাসীনতা রয়েছে। এ উদাসীনতার অন্তরালে একটা আত্মতৃপ্তিও যেন তাদের মধ্যে কাজ করে। তাদের আচরণে মনে হয়, ঝড়ের কবল থেকে মানুষের জান বাঁচানোর সক্ষমতা অর্জন করতে পারলেই হলো, ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি-জমি রক্ষার প্রয়োজন নেই। তারা উপলব্ধি করছে না, বেঁচে যাওয়া মানুষের পুনর্বাসন এবং কর্মসংস্থানের জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি রক্ষা করা খুবই প্রয়োজন। তা নাহলে এসব মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। কাজের সন্ধানে শহরমুখী হয় এবং বেকার হয়ে পড়ে। দেশের আর্তসামাজিক ব্যবস্থার উপর বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এসব বিষয় সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় খুব একটা আমলে নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির প্রভাব যে কতটা ভয়াবহ হচ্ছে এবং এ থেকে উত্তরণ কত কঠিন, তার আলামত এখন পাওয়া যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেলের (আইপিসিসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমাগত বেড়ে লবণাক্ততার আগ্রাসন বাড়বে। সুপেয় পানির মারাত্মক সংকট দেখা দেবে এবং বিশাল এলাকায় জমির স্বাভাবিক উর্বরতা বিপন্ন হবে। সারাদেশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাবে, কৃষিখাতে বিপর্যয়, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, খরা, ঘূর্ণিজড়, জলোচ্ছ¡াস অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পাবে। এসব আলামত এখন পরিদৃষ্ট হয়ে উঠেছে। লন্ডনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ম্যাপলক্রাফট বিশ্বের ১৭০টি দেশের উপর জরিপ চালিয়ে যে ১৬টি দেশকে সর্বাপেক্ষা ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। বলার অপেক্ষা রাখে না, চির ঝড়-ঝঞ্ঝার দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশে জলবায়ুর পরিবর্তন নতুন প্রাকৃতিক বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তনজনিত কারণে ৭১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গোপসাগরীয় তটরেখার কিনারজুড়ে প্রতিনিয়ত পানি ফুলে-ফেঁপে স্ফীত হচ্ছে। এর ফলে দেশের ১৯টি জেলা তথা মোট আয়তনের শতকরা ৩২ ভাগ এলাকা ভয়াবহ হুমকির মুখে রয়েছে। এসব এলাকার ৪ কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রতিনিয়ত ভূমির পরিবর্তন ঘটছে। উপকূল, চর, দ্বীপাঞ্চলের ভূমি তলিয়ে বা হারিয়ে যাচ্ছে। বাস্তভিটা হারিয়ে উপকূলের মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে। কাজের সন্ধানে লাখ লাখ মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়া সামাজিক ভারসাম্য ও শৃঙ্খলার জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
দুই,
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যতই দিন যাচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগের তুলনায় বেশিমাত্রায় ঝড়-জলোচ্ছ¡াস আঘাত হানছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব এসব অঞ্চলের অস্তিত্ব ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সাগর অশান্ত হয়ে উঠছে। সাগরে অবস্থিত বিভিন্ন চর ও দ্বীপাঞ্চলে ভাঙ্গনের তীব্রতা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে সাগরের করালগ্রাসে কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়ার ২৫০ বর্গ কিলোমিটার, ভোলা জেলার ২২৭ বর্গ কিলোমিটর এবং চট্টগ্রামের স›দ্বীপের ১৮০ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেছে। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা শহররক্ষা বাঁধে ফাটল, পতেঙ্গা থেকে শুরু করে কক্সবাজার, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসছে। এ অঞ্চলের জীববৈচিত্রে দেখা দিয়েছে অস্বাভাবিকতা। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে লম্বালম্বি আকৃতির গুপ্তখালের সৃষ্টি হচ্ছে। সেখানে চোরাবালির ঘূর্ণিফাঁদ সৃষ্টি হয়েছে। ঘূর্ণিফাঁদে পড়ে ইতোমধ্যে অনেকেরই প্রাণহানি ঘটেছে। এছাড়া ভূমিধস ও ফাটল অব্যাহত রয়েছে। জলবায়ু ও ভূবিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, ২১০০ সাল নাগদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বৃদ্ধি পেতে পারে। এতে বাংলাদেশের মোট আয়তনের ১৮.৩ শতাংশ সাগরে তলিয়ে যাবে। সেন্টমার্টিনসহ প্রায় অর্ধশত দ্বীপ ও চরাঞ্চলসহ দেশের উপকূলভাগ ও বাসিন্দারা অস্তিত্ব ও মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এর প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া এখনই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। সেখানে আবাদি জমির পরিমান ও গড় উৎপাদন কমছে। মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় ফসল উৎপাদন কমে গেছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যেভাবে বাড়ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে প্রত্যন্ত উপকূল, চর ও দ্বীপাঞ্চলের কমপক্ষে ২ কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। সেন্টার ফর গ্লোবাল চেঞ্জের এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে প্রতিবছর দেশে ২০ লাখ মানুষের জীবিকা ধ্বংস এবং আড়াই থেকে তিন লাখ লোক বাস্তুহারা হচ্ছে। পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র বিপন্ন হয়ে পড়েছে। জলবায়ুর এই বিরূপ পরিবর্তন ও প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন বিচলন বা সচেতনতা কতটা আছে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। উপযুক্ত পদক্ষেপ না নেয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। জলবায়ু ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় প্রতিনিয়ত আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ ও করণীয় সম্পর্কে বলে গেলেও সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তেমন কোন উদ্যোগী ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যতক্ষণ না পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত যেন টনক নড়বে না। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল শতাব্দীর সবচেয়ে প্রলয়ংকারি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসের ধ্বংসযজ্ঞের পর কীভাবে প্রাকৃতিক এই বিপর্যয় থেকে মানুষের জানমাল রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কমিটি গঠিত হয়েছিল। এ কমিটির প্রধান ছিলেন তৎকালীন সচিব এম মোকাম্মেল হক। এটি মোকাম্মেল কমিটি হিসেবে পরিচিত ছিল। এ কমিটি দুর্যোগ প্রবণ সমুদ্র উপকূল, চর ও দ্বীপাঞ্চলবাসীর জানমাল সুরক্ষায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উপযুক্ত অবকাঠামো গড়ে তোলার সুপারিশ করেছিল। এতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ, বহুমুখী সুবিধাসম্পন্ন সাইক্লোন সেন্টার স্থাপন, সহজ ও বোধগম্য আবহাওয়া সতর্ক সংকেত প্রচলন, দুর্যোগ সম্পর্কে গণসচেতনতা বৃদ্ধি, উপকূলভাগে এনজিও কার্যক্রমে সুষ্ঠু সমন্বয়, দুর্যোগকালীন খাদ্যশস্য ও গবাদিপশু রক্ষার ব্যবস্থা সম্পর্কিত খাতওয়ারি সমস্যা চিহ্নিত করে টেকসই উন্নয়নের দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। দুঃখের বিষয়, দুই যুগেও এই দিক নির্দেশনার পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। এই সুপারিশমালা যদি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হতো, তবে প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেভাবে সমগ্র উপকূল গ্রাস করে চলেছে, তা অনেকটাই সমাল দেয়া যেত। আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা অনেকাংশে সম্ভব হতো। সরকার অহরহ দেশের উন্নয়নের কথা বলে চলেছে। বিভিন্ন সূচকের উলম্ফ নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগছে। উন্নতির নিদর্শন স্বরূপ পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে, কর্ণফুলি টানেল ইত্যাদি মেগা প্রকল্পের কাজ করছে। দ্রুতগতিতে এসব প্রকল্প সমাপ্ত করে দেখাতে চাচ্ছে, বাংলাদেশ অতি উন্নত দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। এসব উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে, তবে দেশের সমগ্র উপকূল ও এর কোটি কোটি বাসিন্দাকে অরক্ষিত, ভঙ্গুর ও নাজুক অবস্থায় রেখে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন তাদের কাছে পরিহাসে পরিণত হচ্ছে। ক্ষয়ীষ্ণু উপকূলভাগ ও এর বাসিন্দারা যে ক্রমাগত ভেতরের দিকে অগ্রসরমান এবং এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া কি এসব উন্নয়ন দিয়ে ঠেকানো যাবে? রাজধানীর সাথে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করার জন্য যে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে, সেই অঞ্চলই যদি বিপন্ন ও অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি হয়, তখন এই সেতু কতটা কার্যকর হবে তা কি ভেবে দেখা প্রয়োজন নয়? এই সেতু দিয়ে যখন কোটি কোটি জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষ রাজধানীমুখী হবে, তখন সরকার এসব মানুষের সংস্থান কিভাবে করবে? পদ্মাসেতুসহ অন্যান্য মেগা প্রকল্প করতে কারো দ্বিমত নেই। তবে দেশের উপকূলভাগ মেরামত বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধক মেগা প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিয়ে যদি করা হতো, তাহলেই এ উন্নতি স্বার্থক হতো। উল্লেখিত মেগা প্রকল্পগুলোকে যদি সমগ্র উপকূল, চর ও দ্বীপাঞ্চলবাসীর কাছে অলঙ্কার, ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা ও উন্নতির সাইনবোর্ড মনে হয়, তবে কি তাদের দোষ দেয়া যাবে?
তিন.
দেশের সমগ্র উপকূল, চর, দ্বীপাঞ্চল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিলীন হওয়ার মুখে পড়ার পাশাপাশি বিশ্বে প্রকৃতির সপ্তাশ্চর্য তালিকায় স্থান পাওয়া সুন্দরবনের অস্তিত্বও এখন বিপন্ন হওয়ার পথে। জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি মনুষ্যসৃষ্ট অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের শিকার হয়ে বিশ্বের বৃহৎ এই ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংসের মুখোমুখি। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সুন্দরবনের আয়ু আছে আর মাত্র ১০ বছর। এ সময়ের মধ্যেই এই বনের বেশিরভাগ অংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সুন্দরবন যে প্রকৃতি ও মানুষের দ্বারা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা এখন সরাসরি দেখা যাচ্ছে। এ নিয়ে পরিবেশবিদ ও বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করলেও সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তাতে কোন চেতন আছে বলে মনে হয় না। উল্টো সুন্দরবেনর পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্রের ক্ষতি হয়, এমনসব প্রকল্প যেমন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, জাহাজভাঙ্গা কারখানা, শিল্পকারখানা, ইটভাটাসহ নানা ধরনের স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি দিয়ে সুন্দরবনকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এমন কর্মকাণ্ড দেখে পরিবেশবিদরা মনে করছে, সুন্দরবনের মর্ম কি, তা তারা উপলব্ধি করতে পারছে না। যারা উপলব্ধি করছে না, প্রকৃতির অপার দান এক সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে গেলে তাদের পক্ষে আরেকটি সুন্দরবন সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই সরল বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমলে নিচ্ছে না। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই বনের ৬ হাজার বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশে বাকি ৪ হাজার বর্গকিলোমিটার ভারতে। এটি বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক বিস্ময় হয়ে রয়েছে। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো এটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর গুরুত্ব কতখানি তা বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা উপলব্ধি করলেও আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা উপেক্ষা করে চলেছে। বিশ্বের পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানীদের কাছে এটি একটি অন্যতম প্রাকৃতিক গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত। অথচ প্রকৃতির অপার ও অমূল্য এই দান রক্ষায় সরকারের এক ধরনের শৈথিল্য রয়েছে। সুন্দরবনকে যেন অনেকটা অরক্ষিত অবস্থায় রেখে দেয়া হয়েছে। প্রকৃতি দিয়েছে প্রকৃতিই একে রক্ষা করবে, এমন একটা ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই প্রকৃতিই যে পরিবর্তন হয়ে সুন্দরবনকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে, তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উপলব্ধি করতে পারছে না। ২০০৭ সালে ইউনেস্কো বলেছে, প্রতি বছর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৪৫ সেন্টিমিটার করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ হারে বৃদ্ধি পেলে এ শতাব্দীর শেষ দিকে সুন্দরবনের শতকরা ৭৫ ভাগ ম্যানগ্রোভ ধ্বংস হয়ে যাবে। শুধু প্রকৃতির এই পরিবর্তনের প্রভাবে নয়, মনুষ্যসৃষ্ট কর্মকাণ্ডও সুন্দরবনকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা চিংড়ি হ্যাচারিগুলো সুন্দরবনের পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং জীববৈচিত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠেছে। এছাড়া সুন্দরবনের কাছাকাছি এলাকায় কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প, ইটভাটার মতো পরিবেশ দূষণকারী প্রকল্প স্থাপনও সুন্দরবনের অস্তিত্ব সংকটের কারণ হয়ে উঠেছে। সুন্দরবন যদি না থাকে তাহলে কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে তার কিছু নমুনা উল্লেখ করা প্রয়োজন। দেশের একমাত্র বৃহৎ বনজসম্পদের উৎস বন্ধ হয়ে যাবে। সংরক্ষিত বনের শতকরা ৫১ ভাগ হারিয়ে যাবে এবং বনজসম্পদ থেকে আয়ের শতকরা ৪১ ভাগ কমে যাবে। দেশের ৪৫ ভাগ কাঠ ও জ্বালানি উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। মৎস উৎপাদন বন্ধ হয়ে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। অর্থনৈতিক এ ক্ষতির পাশাপাশি কল্পনাতীত প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। ২০০৭ সালে যে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত এনেছিল, ইউনেস্কোর প্রতিবেদন অনুযায়ী তাতে সুন্দরবনের শতকরা ৪০ ভাগ ক্ষতি হয়েছিল। সুন্দরবন যদি না থাকত তবে এর উপর সিডর যে আঘাত হেনেছিল, তা এসে পড়ত লোকালয়ে। এ ধ্বংসযজ্ঞ কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠত, তা কল্পনাও করা যায় না। সুন্দরবনের মতো প্রাকৃতিক প্রাচীর থাকার কারণে একদিকে ঘূর্ণিঝড় যেমন পুরোপুরি আঘাত হানতে পারছে না, তেমনি বিশাল উপকূলীয় এলাকা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, অমূল্য সম্পদ সুন্দরবন মনুষ্যসৃষ্ট কর্মকাণ্ড এবং জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে ধীরে ধীরে নিঃশেষ হতে চলেছে। এটি রক্ষায় সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
চার.
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে সুন্দরবনসহ সমগ্র উপকূল, চর ও দ্বীপাঞ্চল যেভাবে ক্ষয়ে যাচ্ছে, প্রতিরোধে এখন থেকে কার্যকর উদ্যোগ না নিলে যে ক্ষতি হবে, তা কোনভাবেই পূরণ করা যাবে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করতে হবে। এখন পর্যন্ত যা টিকে আছে, যে কোন উপায়ে তা রক্ষা করতে হবে। দেশি-বিদেশি পরিবেশ বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে সুন্দরবন রক্ষা এবং উপকূলভাগ রক্ষা প্রকল্প নামে আলাদা প্রকল্প গঠন করে তাদের পরামর্শ অনুযায়ী মহাপরিকল্পনার উদ্যোগ নিতে হবে। চলমান মেগা প্রকল্পের মতো সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে অনতিবিলম্বে এর কার্যক্রম শুরু করতে হবে। সরকারের এমন অনেক অকার্যকর ও অপ্রয়োজনীয় বড় বড় প্রকল্প রয়েছে, যেগুলোতে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। এসব প্রকল্প বন্ধ করে সেসব অর্থের সমন্বয়ে সুন্দরবন ও সমগ্র উপকূল, চর ও দ্বীপাঞ্চল রক্ষা প্রকল্পে গড়ে তুলতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিশ্বজলবায়ু তহবিল থেকে যে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়, তা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। এ অর্থ নিয়ে নয়-ছয় করা কাম্য নয়। দুর্যোগ প্রবণ উপকূল, চর ও দ্বীপাঞ্চলবাসীর জানমাল সুরক্ষায় কার্যকর অবকাঠামো সুবিধা গড়ে তুলতে হবে। উপকূলে বসবাসরত কোটি কোটি মানুষের জন্য স্থায়ী বেড়িবাঁধ, পর্যাপ্ত সাইক্লোন সেন্টারসহ প্রতিরোধক ব্যবস্থা গড়ে তোলা অপরিহার্য। গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে বছরব্যাপী বিভিন্ন প্রচারণামূলক কার্যক্রম শুরু করতে হবে। ঝড়-ঝঞ্ঝা ও ভূমিক্ষয় ঠেকাতে উপকূল, দ্বীপ ও চরাঞ্চলে ব্যাপকহারে বৃক্ষরোপন কর্মসূচি গ্রহণ এবং প্যারাবন বা সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।