Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারতে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সাফল্য

টাইমস অব ইন্ডিয়া | প্রকাশের সময় : ৬ মে, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় শাহিদ রাজা খানের মা-বাবা অর্থাভাবের কারণে তাকে প্রাইভেট স্কুল থেকে সরিয়ে বিহারের গয়া জেলার একটি গ্রাম্য মাদরাসায় ভর্তি করেন। ২৭ বছর বয়স্ক যুবকটি তার তৃতীয়বারের চেষ্টায় চলতি বছর ইউপিএসসি (ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন) পরীক্ষায় ৭৫১তম স্থান লাভ করেছেন।
নয়াদিল্লির জওয়াহরলাল নেহেরু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) পিএইচডির এ ছাত্র বলেন, আমার বয়স যখন ১৭ বছর তখনই আমার ভাই (বর্তমানে দন্ত চিকিৎসক) সিভিল সার্ভিসের ব্যাপারে ভাবার জন্য উৎসাহিত করেন। মাদরাসায় আমার একটি সাধারণ জ্ঞানের বই ছিল। আমার সহপাঠি বন্ধুরা জিজ্ঞেস করত কেন আমি সিলেবাসের বাইরে পড়ছি।
মাদরাসাগুলোতে ক্ল্যাসিক ইসলামি শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। তাই তুলনামূলক পরীক্ষার ব্যাপারে মাদরাসা ছাত্ররা প্রায়ই অসুবিধার সম্মুখীন হয়। কিন্তু এখন উত্তর প্রদেশের মত বেশ কয়েকটি রাজ্যের মাদরাসাগুলোই শুধু তাদের পাঠ্যক্রমকে আধুনিকায়ন করেনি। বেশ কিছু লাভজনক কোচিং প্রতিষ্ঠানও আগামী দিনের ডাক্তার, প্রকৌশলি ও সিভিল সার্ভেন্ট তৈরিতে সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে।
উদাহরণ স্বরূপ শাহিদ খানের কথা বলা যায়। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য তিনি দিল্লিভিত্তিক এনজিও যাকাত ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়াতে কোচিং করেন। এ এনজিওটি চলতি বছর সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার্থী ২৭ জন মুসলিমকে কোচিং করায়। তাদের মধ্যে ১৮ জন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।
কর্নাটকের বিদারে শাহীন গ্রুপ অব ইনস্টিটিউশনস গত দুই দশকে মাদরাসা শিক্ষিত ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পরিচালিত ব্রিজ কোর্সের মাধ্যমে বেশ কিছু ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করেছে। ঐতিহ্যগত ভাবে মাদরাসাগামী ছেলেমেয়েদের অধিকাংশই শোবা-ই-হিফজ (কুরআন হাফেজি বিভাগ)- এ ভর্তি হয়। আর এ বিভাগ থেকে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে হাফেজ হয়ে থাকে।
শাহীন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল কাদির বলেন, হুফ্ফাজের (হাফিজের বহুবচন) এ কোর্স সম্পন্ন করার পর আরো জ্ঞান ও শিক্ষা লাভের সকল অধিকার রয়েছে। বাস্তবে হুফ্ফাজ প্রথম ও মধ্যযুগে হেকিম বা ডাক্তার হিসেবেও কাজ করতেন। শাহীন ইনস্টিটিউশনসের একটি কোর্স আছে যা হুফফাজকে আধুনিক শিক্ষার সাথে সংযুক্ত করে। ‘হিফজ প্লাস’ নামে আখ্যায়িত ভিত্তি ও সেতুবন্ধনকারী এ কোর্সটি শিক্ষার্থীদের একটি শাহীন কলেজের দশম শ্রেণিতে ভর্তি হতে প্রস্তুত করে। বিদার ছাড়া কর্নাটকের হাসান ও দেশের বিভিন্ন স্থানে আরো ৬টি শাখায় শাহীন এ সুযোগ দিচ্ছে।
সংবাদপত্রে এ ইনস্টিটিউটের খবর জানতে পেরে গোরখপুরের ১৫ বছরের কিশোর হাফিজ ওয়াহিদ আবদুল্লাহ শাহীন কলেজে ভর্তি হন। তিনি নীট-এ (ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি কাম এন্ট্রান্স টেস্ট) ৫৭৯ নম্বর পান। এখন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারি পড়ছেন। আরেক মাদরাসা ছাত্রী হাফিজা রাবিয়া বসরি বাঙ্গালোর মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়েছেন। এখন তিনি হায়দারাবাদে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত।
এনজিও যাকাত ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ জাফর মাহমুদ বলেন, সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য তাদের কোচিং সেন্টার প্রতি বছর ৬৫ জন প্রার্থী নিয়ে থাকে। তাদের মধ্যে ৫ থেকে ৬ জন মাদরাসা ছাত্রও থাকে। তিনি বলেন, আমি তাদের ও মূলধারার ছাত্রদের মধ্যে পড়াশোনা ও কর্মক্ষমতার বেলায় কোনো পার্থক্য দেখি না। তিনি বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি হতে হয়, তাই তারাও সমপর্যায়ের ছাত্র।
মাহমুদ সাচার কমিটি রিপোর্ট বিষয়ে একজন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। এ কমিটি ভারতীয় মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষাগত পশ্চাৎপদতার দিক তুলে ধরে। কমিটির রিপোর্ট তাকে কোচিং সেন্টার চালু করতে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি বলেন, সিভিল সার্ভিসের মত ক্ষেত্রগুলোতে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের অভাব উদ্বেগের বিষয়।
চলতি বছর যারা সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে তাদের মধ্যে ৩.৭ শতাংশ মাত্র মুসলিম। তিনি বলেন, সরকারি তথ্যে দেখা যায় মুসলমানরা পিছিয়ে আছে। একমাত্র একটি ক্ষেত্রে তাদের সংখ্যা বেশি। তা হলো হাসপাতালের লাইনে। মুসলমানদের তথ্য, আস্থা ও সম্পদের অভাব রয়েছে এবং এ ব্যবধান পূরণে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
একটি উদাহরণ হচ্ছে ২০০৯ সালে মুম্বাইয়ে তাদের সদর দফতর হাজ হাউজে চালু করা হজ কমিটির আইএএস এবং সমন্বিত সেবা কোচিং ও গাইডেন্স সেল। এর সিইও মোহাম্মদ কায়েস বলেন, সাচার রিপোর্টে যে মারাত্মক ছবি উঠে এসেছে তার প্রেক্ষিতে হজ কমিটি অব ইন্ডিয়া মুসলিম ছাত্রদের জন্য ২ বছরের আবাসিক কোচিং সার্ভিস চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের এক সফল ছাত্র হচ্ছেন আহমদ নগরের শেখ মোহাম্মদ জইব (২২৫তম স্থান অধিকারী)। তার পিতা জেলা আদালতে চাকরি করেন। তিনি বলেন, এটা ছিল আমার চতুর্থ প্রচেষ্টা। হজ কমিটি আমাকে একটি ভালো ভিত্তি দিয়েছে।
অ্যাক্টিভিস্ট ও পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্যা সৈয়দা হামিদা বলেন, মাদরাসা ছাত্র-ছাত্রীরা অত্যন্ত মেধাবী। কিন্তু মাদরাসাগুলোকে সন্ত্রাসবাদী তৈরির আখড়া বলে বলে গণ্য করা হচ্ছে। এ লেবেলটা ছেলেমেয়েদের বেলায় সেঁটে দেয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রের মাদরাসাগুলোর আধুনিকায়নে সাহায্য করা ও যাকাত-এর মত মডেলে ব্যাপকভাবে কোচিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা দরকার।
কিছু মাদরাসা ছাত্র যেমন ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি অংক ও বিজ্ঞান পড়ে। শাহিদ খান সেভাবে আধুনিক শিক্ষার বিষয়গুলো পড়ার সুযোগ পাননি। তিনি বলেন, আমি যখন সাধারণ বিষয়গুলো পড়া শুরু করি, আমার ভিত্তি ছিল না। আমার ক্লাস থ্রির অংক বুঝতে সমস্যা হত। তাই আমাকে অন্যদের সাথে এক পর্যায়ে আসতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। ইংরেজি শেখাটাও আমার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। ইংরেজি সংবাদপত্র পড়তে আমার কষ্ট হত।
মাদরাসার কঠোরতা তাকে সাহায্য করেছিল। কুরআন শিক্ষা কিভাবে আমাকে মুখস্থ করতে ও মনে রাখতে হবে, তা শিখিয়েছিল। শুধু তাই নয়, তা আমার মধ্যে জীবনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করে, তবে তাতে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
কোজিখোড়ের শাহিদ টি কোমাথ একটি মাদরাসায় ১০ বছর পড়েছেন। এমনকি দুই বছর শিক্ষকতাও করেছেন। গত বছর তথ্য বিভাগে যোগ দেয়া ৩০ বছর বয়স্ক এ যুবক বলেন, জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু আমরা সহানুভ‚তি, সমবেদনা ও আশা শিখেছি। আমি প্রাথমিক পরীক্ষাগুলোতে ৫ বার ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু আমি ধৈর্য্যধারণ করতে, লেগে থাকতে ও ব্যর্থতার জন্য হতাশ হয়ে না পড়তে শিখেছি। তিনি তার ইউপিএসসি র‌্যাংক- এর উন্নতির জন্য আবারো পরীক্ষা দেয়ার আশা করছেন। তার মাদরাসা তাদেরকে একই সাথে উন্মুক্ত শিক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে মূলধারার শিক্ষায় যোগদানে উৎসাহিত করেছে।
এই সাফল্যের কাহিনীগুলো মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেককেই উৎসাহিত করছে। শাহিদ খান বলেন, তার গ্রামে কলেজ গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা ৫ থেকে ৬ জন। তিনি বলেন, আর্থিক দৈন্যের কারণে আমার সম্প্রদায়ের মানুষের, বিশেষ করে মেয়েদের জন্য সুযোগ খুবই কম। পরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণ হওয়ার পর মানুষজন তাদের সন্তানদের ব্যাপারে নতুন করে আশা দেখতে পাচ্ছে । বহু মাদরাসা ছাত্র আমার সাথে পরামর্শের জন্য যোগাযোগ করছে। আপনি কখনো এ ধরনের স্বপ্ন দেখতে পারবেন না, এ মিথ ভেঙে গেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ