পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
যাকাত ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: পাঁচটি বস্তুর ওপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত। এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহর ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ তার বান্দা ও রসূল, নামাজ কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, বায়তুল্লাহর হজ করা এবং রমজানের রোজা রাখা। পবিত্র কোরআনের বহু স্থানে একই সঙ্গে নামাজ ও যাকাতের আদেশ করা হয়েছে এবং অশেষ সওয়াব, রহমত, মাগফিরাত ও আত্মশুদ্ধির প্রতিশ্রæতি দেয়া হয়েছে। কোরআনের একটি আয়াতে বলা হয়েছে : তোমরা নামাজ আদায় করো এবং যাকাত প্রদান করো। তোমরা যে উত্তম কাজ নিজেদের জন্যে অগ্রে প্রেরণ করবে, তা আল্লাহর নিকট পাবে। অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে : তোমরা নামাজ আদায় করো, যাকাত, দাও এবং রাসূলের আনুগত্য করো, যাতে তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে পারো। আর একটি আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন : এবং যারা নামাজ আদায় করে যাকাত এবং আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে, আমি তাদের মহাপুরস্কার দেব। বলার অপেক্ষা রাখে না, যাকাত একটি গুরুত্বপূর্ণ এবাদত এবং প্রত্যেক সামর্থবান ব্যক্তির জন্য যাকাত ফরজ করা হয়েছে।
যাকাতের মধ্যে রয়েছে অপরিসীম কল্যাণ ও মঙ্গল। যারা যাকাত দেন তারা যেমন এই কল্যাণ ও মঙ্গলের অধিকারী হন, তেমনি যারা এর প্রাপক তারাও কল্যাণ ও উপকারভোগী হয়ে থাকেন। যাদের জন্য যাকাত বাধ্যতামূলক, তারা যদি যাকাত না দেন তাহলে কেয়ামতের দিন কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: আল্লাহ যাকে সম্পদ দিয়েছেন, কিন্তু সে যাকাত না দেয়নি, কেয়ামতের দিন তা বিষধর সাপরূপে উপস্থিত হবে এবং তা তার গলায় পেঁচিয়ে দেয়া হবে। সাপটি তার উভয় অধর প্রান্তে দংশন করবে এবং বলবে, আমিই তোমার ওই ধন, আমিই তোমার পুঞ্জিভুত সম্পদ। কী পরিমাণ সম্পদ ও অর্থ থাকলে একজনের প্রতি যাকাত প্রদান ফরজ হয়, তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। কারা যাকাতের হকদার তার বিবরণও রয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে : যাকাত তো কেবল নি:স্ব, অভাবগ্রস্ত ও যাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য, যাদের মনোরঞ্জন উদ্দেশ্য তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জেহাদকারী ও মুসাফিরদের জন্য। এ আল্লাহর বিধান।
আল্লাহপাকের এ বিধান থেকে যাকাতের উদ্দেশ্য অত্যন্ত স্পষ্ট। এর আধ্যাত্মিক দিক ছাড়াও মোটাদাগে, দারিদ্র বিমোচন, ধন ও আয় বৈষম্য হ্রাস এবং সমাজে একটি ন্যায়সঙ্গত ভারসাম্য প্রতিষ্ঠাই যাকাতের লক্ষ্য। বছরের যে কোনো সময় যাকাত প্রদান করা গেলেও আমাদের দেশে সাধারণত রমজান মাসেই যাকাত প্রদান করা হয়। কেননা এ মাসের একটি ফরজে ৭০টি ফরজের সওয়াব পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, দেশে দারিদ্র বিমোচন, ধন ও আয় বৈষম্য হ্রাস ও সুষম সমাজ প্রতিষ্ঠায় যাকাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। সম্প্রতি ঢাকায় ‘সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট’ আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, দেশে অর্থনীতির যে আকার, তাতে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি যাকাত আদায় সম্ভব। আর এ পরিমাণ যাকাত আদায় হলে দেশে কোনো দারিদ্র্য থাকবে না। সেমিনারে সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি এ মির্জা আজিজুল ইসলাম দেশে দারিদ্র্য বিমোচন ও আয় বৈষম্য নিরসনে যাকাতের ভূমিকা উল্লেখ করে বলেছেন, বর্তমানে যেভাবে যাকাত দেওয়া হয় তাতে গ্রহিতা সাময়িকভাবে উপকৃত হন, তবে উপকার টেকসই হয় না। এ জন্য যাকাত ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন দরকার, যাতে উপকার স্থায়ী হয়। তার এ বক্তব্যের তাৎপর্য বিশেষভাবে অনুধাবনীয়। বলা বাহুল্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায়েই হওয়া উচিৎ এবং যাকাত বন্টনে সমন্বয় থাকা প্রয়োজন। যাকাতকে রাষ্ট্র বা সরকার প্রাতিষ্ঠানিকরণ করার চেষ্টা করলে নেতিবাচক ফল ফলতে পারে। অনেকেই তাতে উৎসাহী নাও হতে পারেন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ অবশ্যই থাকবে। যাদের ইচ্ছা, তারা রাষ্ট্রীয় যাকাত ফাÐে অর্থ প্রদান করবে। এটা বাধ্যতামূলক করা ঠিক হবে না। কারণ, রাষ্ট্র যদি সর্বক্ষেত্রে শরীয়ত অনুসারী না হয়, তাহলে দ্বীনি কাজে মানুষ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় পূর্ণ আস্থাশীল হতে চায় না। যাকাত ব্যক্তি প্রদান করেন, এক্ষেত্রে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। যারা যাকাত প্রদান করেন, তাদের যথেষ্ট সচেতন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। যাকাত বণ্টনের ক্ষেত্রে তাদের শরিয়তের বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। লোক দেখানো বা প্রদর্শনীর মনোভাব তাদের পরিহার করতে হবে।
আমরাও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যাকাত দারিদ্র্য বিমোচন, ধন ও আয় বৈষম্য হ্রাসে ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। ইসলামের অর্থনীতির একটা বড় দিক হলো, সমাজে ধন-সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে সকলের জীবনযাপন সহজ ও নিরাপদ করা। এক্ষেত্রে যাকাতের কার্যকর ভূমিকার কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এ জন্য যাকাত দেয়ার উপযুক্ত ব্যক্তিদের উদ্বুদ্ধ করা একটি বড় কাজ। সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নিতে পারে। অর্থমন্ত্রী স্বয়ং নিতে পারেন বিশেষ ভূমিকা। বেসরকারী পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, আলেম-ওলামা পীর-মাশায়েখ এই উদ্বুদ্ধকরণে রাখতে পারেন ব্যাপক অবদান। মাহে রমজানে জুম্মার নামাজের বয়ানে এবং তারাবি নামাজের আগে ইমাম সাহেবগণ তাদের বক্তব্যে যাকাতের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরতে পারেন। এতে মুসল্লীরা উদ্বুদ্ধ হতে পারেন, যার ফল হতে পারে অত্যন্ত ইতিবাচক। প্রকৃতপক্ষে যারা যাকাত দেয়ার উপযুক্ত তারা যদি স্বত:স্ফূর্তভাবে শরীয়তসম্মত পদ্ধতিতে যাকাত প্রদান করেন তাহলে দারিদ্র্য বিমোচনসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হতে পারে। সরকারের উচিৎ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয় সকল বাড়াবাড়ি খর্ব করে মানবিক ব্যবস্থা কায়েমের মাধ্যমে স্বচ্ছতাপূর্ণ দরদী ন্যায়নীতি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। তখন যাকাতের ব্যবস্থাপনাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাষ্ট্র হাতে নিতে পারবে। শরীয়তগত নৈতিক সক্ষমতা অর্জন যাকাত ব্যবস্থাপনা হাতে নেওয়ার পূর্বশর্ত।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।