পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দ্বীন ও ঈমানের খেদমতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের নানামুখী উদ্যোগের অন্যতম হলো ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা। সে প্রতিষ্ঠান তারই সুযোগ্য উত্তরসূরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডায়নামিক ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপে বিশাল খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে। দুঃস্থ, অসহায়, অক্ষম জনগোষ্ঠিকে স্বাবলম্বীকরণ, পুনর্বাসন ও পীড়িত মানুষের চিকিৎসাসেবাসহ বিভিন্নমুখী সেবা নিশ্চিত করার জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালনায় যাকাত ফান্ড কাজ করে যাচ্ছে। নবগঠিত জাতীয় যাকাত বোর্ডে স্থান পেয়েছে দেশবরণ্য ওলামায় কেরাম। তাই যাকাত বোর্ড আজ দুঃস্থ মানুষের সেবক হিসেবে পরিকল্পনাভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে, যা সত্যিই আশাব্যাঞ্জক। আমরা জানি, যাকাত দান নয়, যাকাত প্রদান একটি ফরয ইবাদত। আল কুরআনে যাকাত পরিভাষাটি ৩২ বার এসেছে। যেমন, ‘নামায কায়েম করো যাকাত দাও’। সকল আয়াতেই যাকাত দাও, যাকাত দাও কথাটি বারবার উচ্চারিত হয়েছে। কোথাও যাকাত খাও বা যাকাত গ্রহণ করো একথাটি বলা হয়নি। তাতে সহজেই বুঝা যায়, ইসলামি দর্শনে যাকাত প্রদান করা এবং মুসলিম মাত্র স্বাবলম্বী হওয়া অন্যতম দায়িত্ব। একজন মুসলামানের আকিদা বিশ^াস হবে, জান ও মালের সবটুকু মালিকানা আল্লাহ তায়লার। আমি বা আমার বলতে কিছুই নেই। যতদিন আল্লাহ তায়ালা দয়া করে জীবন রাখবেন ততদিন আমি মালের রক্ষক। আল্লাহর দেয়া সম্পদ আল্লাহর দেয়া বিধানমত খরচ করাই আমার দায়িত্ব। মুসলিম জনগোষ্ঠির এ দর্শন ও আকিদার কারণে বর্তমান ৪০টি দেশের একক খলিফা ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ রাদিআল্লাহু আনহুর আমলে গোটা মুসলিম বিশে^ ১৯ দিন ব্যাপী ঢোল পিটেয়ে একজন মুসলমানকে যাকাত গ্রহণকারী পাওয়া যায়নি। বলতে পারেন তখনকি কোনো গরিব মিসকীন ছিল না? হ্যাঁ, যারাই ছিল, প্রতিটি এলাকার ধনী ও বিত্তবান লোকেরা তাদের স্বাবলম্বী করে তুলেছিলেন। রাজকোষ থেকে যাকাতের মাল আমি আগে নেব না আমার অপর ভাই গ্রহণ করুক, এ মানবিক দিক বিবেচনা করে কেউ প্রার্থী হয়নি। অবশেষে রোমান সম্রাটসহ বিভিন্ন দেশে নিলামে লক্ষ লক্ষ টন যাকাতের মাল বিক্রি করতে হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশে যাদের উপর যাকাত, ফেৎরা, ওশর ফরয। দেশে-বিদেশে তাদের বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা জমা রয়েছে। তাদের যদি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় যাকাত কালেকশনের আওতায় আনা যায়, পরিসংখ্যান মতে, মাত্র ৮ বছরের মাথায় ক্ষুদ্র, মাঝারী শিল্প ও স্বাবলম্বী করার প্রকল্প গ্রহণ করলে দেশে একজন গরিব-মিসকীনও থাকবে না। কিন্তু দুভার্গ্য হলো ৯০% ভাগ মুসলমানের দেশে এ দুরাস্থার কারণ আল্লাহ প্রদত্ত ও প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম প্রদর্শিত বিধান মেনে না চলা। এ যাকাত না দেয়ার ফলে যে সম্পদ নাপাক হয়ে যায়, সে সম্পদ যে বিষধর সর্পে পরিণত হয়ে যাকাত প্রদান যে করে না তাকে ছোবল মারবে, এ ভয় সম্পদশালীদের বেশিরভাগ লোকের নেই। এ যাকাত না দেয়া সম্পদকে আগুনের স্কুলিংগ করে তার মুখে, পিঠে, সমগ্র অঙ্গে দাগ দেয়া হবে, সেক দেয়া হবে, মুসলিম নামধারী ধনীদের এ বিষয়ে খবরই নেই। এ প্রসঙ্গে আল কুরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আর যারাই স্বর্ণ ও রৌপ্য সঞ্চয় করে রাখে তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদের পীড়াদার আযাবের সুসংবাদ দাও, যেদিন তাদের উপর উত্তপ্ত করে তাদের মুখে, পাশের্^ ও পিঠে দাগ দেয়া হবে, আর বলা হবে, এগুলো তোমারই পঞ্জিভূত সম্পদ, যেগুলো তুমি জমা রেখেছিলে।’
এ যাকাত দিয়েই চলছে হাজার হাজার এতিমখানা, দুঃস্থ, অসহায় প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কতকাল এভাবে এতিমখানা যাকাত দিয়ে চলবে? চামড়ার টাকা দিয়ে কি গরিবদের স্থায়ী সমাধান কোনদিন কী হবে? প্রয়োজন রাষ্ট্রীয়ভাবে বিত্তশালীগণের সমন্বয়ে একটি মৌলিক পরিকল্পনার। যাতে গোটা দেশের অসহায়, গরিব, দুঃস্থ, পঙ্গু, এতিম, মিসকীন, বিধবাদের তালিকা প্রস্তুত করে দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষা দেয়া সম্ভব হয়। এ বিষয়টি নিয়ে সমাজের পীর, মাশায়েখ, আলেম, ওলামা, খতীব, দীনদার ধনী বৃত্তবানদের ভাবার সময় কী আসেনি? এতিমখানাগুলোকে পরিকল্পনাভিত্তিক স্বাবলম্বী করার চিন্তাভাবনা করা সময়ের দাবি। ২৪ ঘণ্টা হেফজখানা বা মাদরাসায় তত্ত্বাবধানে রেখে পরিকল্পনাভিত্তিক উৎপাদনমুখী প্রজেক্ট গ্রহণ করে নিজেরা স্বনির্ভর হওয়া মোটেই কঠিন নয়। এর জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ ও সরকারি সহযোগিতা। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বাধীন ইসলামিক ফাউন্ডেশন পরিচালিত জাতীয় যাকাত বোর্ড যাকাত গ্রহণ ও বিতরণে শতভাগ নিশ্চয়তা দিচ্ছে। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান এমপির নেতৃত্বে সরকার দেশের শীর্ষ স্থানীয় আলেমদের সমন্বয়ে জাতীয় যাকাত বোর্ড গঠন করেছে। এ বোর্ডের সদস্য রয়েছেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী এনামুল হাসান এনডিসি, সদস্য সচিব ইফার মহাপরিচালক ড. মো. মুশফিকুর রহমান, বোর্ডের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ড. মোহাম্মদ হারুনুর রশিদ। আলেমগণের মধ্য রয়েছেন বাইতুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সম্মানিত খতীব ও ইফার গভর্নর হাফেজ মাওলানা মুফতী মোহাম্মদ রুহুল আমিন, গভর্নর ড. মুফতী কাফীলুদ্দীন সরকার সালেহী, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, রয়েছেন মুফতী মিজানুর রহমান সাঈদ, মুফতী মাওলানা ইযাইইয়া মাহমুদ, মুফতী আবুল কাশেম ফজলুল হক, ড. মাওলানা হায়দার আলী আকন্দ, ড. মাওলানা এ. কে. এম. মাহবুবুর রহমান। দেশের শীর্ষ স্থানীয় মুফতী ডক্টর-প্রফেসরদের নিয়ে গঠিত এ বোর্ডের প্রথম বৈঠক গত ১৩ মার্চ ২০২২ অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে বিগত বছরের যাকাতের অর্থ ব্যায়ের খাতগুলো তুলে ধরা হয়, যা ছিল অত্যন্ত চমৎকার। যেমন:
(১) বিভাগীয় ও জেলা থেকে আদায়কৃত অর্থ দুঃস্থ অসহায়দের মাঝে বিতরণ।
(২) যাকাত বোর্ড শিশু হাসপাতাল, গাজীপুর এ গরিব রোগীদের মধ্যে ঔষধ বিতরণ।
(৩) সেলাই প্রশিক্ষণার্থী দুঃস্থ মহিলাদের যাকাত প্রদান।
(৪) সেলাই প্রশিক্ষণ সমাপ্তকারী মুসলিম দুঃস্থ মহিলাদের মধ্যে সেলাই মেশিন প্রদান।
(৫) দুঃস্থ প্রতিবন্ধিদের পুনর্বাসন।
(৬) দুঃস্থ পুরুষদের কর্মসংস্থান কার্যক্রম (রিকসা, ভ্যান, ক্ষুদ্র ব্যবসার পুঁজি, গাভী ক্রয় ইত্যাদি)।
(৭) দুঃস্থদের যাকাত ভাতা (পুরুষ-মহিলা) এতিম, ভিক্ষুক, অক্ষম গরিব ও অসহায় পুরষ ও মহিলাদের সেলাই মেশিন প্রদান, গৃহ মেরামত, মেয়েদের বিবাহ খরচ প্রদান, ঋণ গ্রস্থদের ঋণ পরিশোধ, হাঁস-মুরগী, ছাগল ক্রয় করে দুঃস্থদের স্বাবলম্বী প্রকল্প বাস্তবায়ন।
(৮) দুঃস্থ নও মুসলিমকে স্বাবলম্বীকরণ কার্যক্রম (মহিলা-পুরুষ) ধর্ম ত্যাগের পর মুসলামন হয়ে বহু নও মুসলিম অসহায় হয়ে পড়ে, এ শ্রেণিকে যাকাত ফান্ড থেকে অর্থ দিয়ে থাকা-খাওয়া ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।
(৯) দুঃস্থ শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান কার্যক্রম (ছাত্র-ছাত্রী) মাদরাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়ের দুঃস্থ ও গরিব শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান।
(১০) দুঃস্থ ও গরিব রোগীদের চিকিৎসা বাবদ আর্থিক সহায়তা কার্যক্রম।
(১১) প্রাকৃতিক/আকাস্মিক দুর্যোগ ক্ষতিগ্রস্থদের ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রকল্প (বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, গরিবদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ। বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন, খাদ্য ও ত্রাণ সামগ্রীসহ পুনর্বাসন খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় হয়।
যাকাতের খাতগুলো সম্পূর্ণ কুরআন সুন্নাহভিত্তিক চলছে। ২৩টি কেন্দ্রে সেলাই প্রশিক্ষণ অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশের বিত্তবান দানবীর দেশে-বিদেশে যেখানেই থাকুক না কেন ইফার যাকাত ফান্ডে অর্থ প্রদান করলে অসহায়, গরিব, মিসকীন, পঙ্গুসহ দুঃস্থ জনগোষ্ঠিকে স্বাবলম্বী করার ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা যাবে। যাকাতের টাকা ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক খাতে যথাযথ মনিটরিংয়ের আওতায় ব্যয় হবে এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। তাই ইফার যাকাত ফান্ডে আপনার যাকাত প্রদান করে অসহায়দের স্বাবলম্বী করা, দুঃস্থ, পীড়িত, অক্ষম লোকদের পাশে দাঁড়ানো সময়ের দাবি। ভিক্ষাবৃত্তি থেকে দেশকে মুক্ত করে অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো আমার আপনার সকলের কর্তব্য।
লেখক: সদস্য, জাতীয় যাকাত বোর্ড;
অধ্যক্ষ, ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মাদ্রাসা, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর এবং
সভাপতি, ইসলামি শিক্ষা উন্নয়ন বাংলাদেশ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।