Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বেগম রোকেয়ার পূর্বসুরিরা

জোবায়ের আলী জুয়েল | প্রকাশের সময় : ৩ মে, ২০১৯, ১২:১১ এএম

এ উপমহাদেশের নারী শিক্ষার ইতিহাস যেমন করুণ, তেমনি প্রচ্ছন্ন ও নৈরাশ্যজনক। শিক্ষা সভ্যতার বাহন ও উন্নয়নের চাবিকাঠি, কিন্তু এ সত্য পরাধীন দেশে স্বীকৃত হয়নি বলে এ দেশে শিক্ষার বিস্তার ঘটে বহু দেরিতে। অতীত ইতিহাসে শুধু যে মুসলিম মেয়েরাই অজ্ঞ অশিক্ষিত ছিল তা নয়, হিন্দু মেয়েরাও অজ্ঞ ও শিক্ষা বঞ্চিত ছিল।
এদেশে সাড়ে পাঁচ শতাব্দী ধরে মুসলিম শাসন ব্যবস্থা ছিল। তখন গুটিকয়েক বিদুষী সম্রাজ্ঞী নিজ উদ্যোগে জ্ঞানার্জন করলেও সাধারণ মানুষের মাঝে শিক্ষা বিস্তার ঘটেনি। আঠারো শতকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ও বৃটিশ শাসনের শুরুর অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ পার হওয়ার পর গুটিকয়েক সমাজদর্শী দেশ-নেতা ও সংস্কারের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ও পাশ্চাত্য ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে নারী শিক্ষার উদ্যোগ নেন। উনিশ শতকের সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম একটি বিষয় ছিল নারী শিক্ষা প্রচলনের চেষ্টা। এদেশে নারী শিক্ষা প্রবর্তনের প্রথম চেষ্টা করে খ্রিষ্টান মিশনারিরা। তাঁরা ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে “ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি” নামে একটি সমিতি স্থাপন করে নারীদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। এই সমিতির উদ্যোগে বাঙালি মেয়েদের জন্য গৌরবাড়িতে প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দের মে-জুন মাসে। পরে এ সমিতি জানবাজার, চিৎপুর, শ্যামবাজার, বরাহনগর প্রভৃতি অঞ্চলে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। অন্যটি “খধফরবং ঝড়পরবঃু ভড়ৎ হধঃরাব ঋবসধষব ঊফঁপধঃরড়হ রহ ঈধষপঁঃঃধ ধহফ রঃং ঠরপহরঃু” এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে (তথ্যসূত্র: অমলেন্দু দে, বাঙালি বুদ্ধিজীবি ও বিচ্ছিন্নতাবাদ, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, পৃষ্ঠা ২৮)। ডেভিড হেয়ার (১৭৭৫-১৮৪২ খ্রি.) এই প্রতিষ্ঠানের জন্য চাঁদা দিয়েছিলেন।
বাংলায় প্রাতিষ্ঠানিক নারী শিক্ষার সূচনা হয় ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ৭ মে। জেইডি বেথুনের (১৮০১-১৮৫১ খ্রি.) প্রচেষ্টায় ন্যাটিভ ফিমেল স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে (তথ্যসূত্র: শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, কলকাতা, নিউএজ পাবলিশার্স প্রা. লি.)। এই স্কুলটি পরে “বেথুন স্কুল” নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৮৫০ থেকে ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় এই স্কুলের সম্পাদক ছিলেন। ব্রিটিশ ভারতে এটিই সর্বপ্রথম প্রাতিষ্ঠানিক মেয়েদের স্কুল। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জন ইলিয়ট ড্রিঙ্ক ওয়াটার বেথুন।
প্রাচীন যুগের কোনো মহিলা কবির পদ বা রচনা এখনো আবিস্কৃত হয়নি। মধ্যযুগে প্রথম মহিলা কবি হিসেবে চÐীদাসের সাধন সঙ্গিনী রজকিনী রামী বা রামতারাকে দেখা যায় পঞ্চদশ শতাব্দীতে। তাঁর পূর্বে কোনো লেখিকার ভণিতাযুক্ত কোনো পদের সন্ধান পাওয়া যায় না।
রামীর পরবর্তীতে ইন্দ্রমুখী, মাধুরী, গোপী, রসময়ী দেবী নাম্নী বৈষ্ণব নারী কবির ভণিতা যুক্তপদ পাওয়া যায়। ষোড়শ শতাব্দীর কবি মাধবী দাসী শ্রী চৈতন্যের সমসাময়িক ছিলেন। তাঁর অনেকগুলো পদ পদকল্পতরুতে পাওয়া যায়। ষোড়শ শতকের আরেক কবি হলেন চন্দ্রাবতী। তিনি বিখ্যাত মনসামঙ্গল রচয়িতা বংশী দাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্যা। খনা একজন গুণবতী রমণী ছিলেন। তাঁর জ্যোতিষ-শাস্ত্র সংক্রান্ত বিজ্ঞ মন্তব্যগুলো বাংলার গৃহ প্রবাদে পরিণত হয়েছে। তিনি মুসলমান শাসনের প্রথম যুগে এই প্রদেশে বসবাস করতেন। অষ্টাদশ শতকে প্রথম মুসলিম মহিলা কবি রহিমুন্নেসাকে দেখা যায়। তাঁর পূর্বে মুসলিম লেখিকার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। অষ্টাদশ শতকের শেষ ও উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে আরো কিছু লেখিকার রচনা পাওয়া যায়। যেমন- আনন্দময়ী দেবী, গঙ্গামনি দেবী, যজ্ঞেশ্বরী দেবী, সুন্দরী দেবী, দ্রব্যময়ী দেবী, ল²ী দেবী প্রমূখ। কিন্তু এঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়না (তথ্যসূত্র: শ্রীমতি অনুরূপা দেবী, সাহিত্যে নারী, স্রষ্টী ও সৃষ্টি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭৯ খ্রি. পৃষ্ঠা ১০২)।
বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম উপন্যাস “ফুলমনি ও করুনার বিবরণ”। তবে খুব আশ্চর্যের বিষয় বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাস লিখেছেন একজন ইংরেজ নারী হানা ক্যাথরিন ম্যালেনস। “ফুলমনি ও করুনার বিবরণ” প্রকাশিত হয় ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে। “ফুলমনি ও করুনার বিবরণ” ইংরেজী সহ তৎকালীন সময়ে উপমহাদেশের আরও কয়েকটি ভাষায় অনুদিত হয়। তবে পরবর্তীতে কোনো কারণে “ফুলমনি ও করুনার বিবরণ” পাঠকের দৃষ্টির অগোচরে চলে যায়। ফলে বাংলা ভাষায় লিখিত প্রথম উপন্যাস কোনটি এ বিষয়টি ঢাকা পড়ে যায়।
বাঙালি মহিলা রচিত প্রথম বই কৃষ্ণ কামিনী দাসীর “চিত্ত বিলাসিনী” প্রকাশিত হয় ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে। ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় রাসসুন্দরী দেবীর “আমার জীবন”। এটি বাঙালি মহিলার লেখা প্রথম আত্মজীবনী। ছাপার হরফে যাঁর প্রবন্ধ পুস্তক প্রথম প্রকাশিত হয় তিনি বোধ হয় কৈলাস বাসিনী দেবী। ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর এই প্রবন্ধ পুস্তকটি প্রকাশিত হয়। এখানে বোধ হয় বলার কারণ এই যে, কৈলাস বাসিনী দেবীর বছর দুয়েক আগে পাবনার বামা সুন্দরী দেবীরও একটি প্রবন্ধ মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই আড়াই হাজার শব্দের প্রবন্ধটিকে কেউ বই বলে বিবেচনা করলে কৈলাস বাসিনী প্রথম প্রবন্ধ গ্রন্থকার বা গ্রন্থকর্ত্রী হিসেবে মর্যাদা পাবেন না। কিন্তু সত্যিকার ভাবে একটা গোটা প্রবন্ধ বই প্রকাশের কৃতিত্ব কৈলাস বাসিনীরই প্রাপ্য।
নারী সম্পাদিত প্রথম বাংলা পত্রিকা “বঙ্গমহিলা” প্রকাশিত হয় খিদিরপুর থেকে ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে। এটি ছিল পাক্ষিক। সম্পাদনায় ছিলেন মোক্ষদায়িনী মুখোপাধ্যায়। মুসলিম বাংলার সাময়িক পত্রের ইতহাসে প্রথম নারী সম্পাদক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন মাসিক “আন্নেসার” সুফিয়া খাতুন। “আন্নেসা” প্রথম মুসসমান নারী সম্পাদিত পত্রিকা। মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ সিদ্দীকি কর্তৃক চট্টগ্রাম থেকে এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে (১৩২৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখ)। ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত হয় স্বর্ণকুমারী দেবীর “সখী সমিতি”। এটি বাঙালি নারী পরিচালিত প্রথম প্রতিষ্ঠান।
বাংলার প্রথম দু’জন মহিলা গ্রাজুয়েট কাদম্বিনী বসূ (১৮৬১-১৯২৩ খ্রি.) ও চন্দ্রমুখী বসূ (১৮৬৯-১৯৪৫ খ্রি.)। ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে কাদম্বিনী বসূ ও সরলা দাস মহিলাদের মধ্যে প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি পান। কাদম্বিনী বসূ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্রী। সরকার ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর জন্য বেথুন স্কুলে কলেজ শাখা খোলে। ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বি.এ পাশ করেন। বেথুন কলেজে তখন হিন্দু মেয়েদের প্রবেশাধিকার ছিল। চন্দ্রমুখী বসূ খ্রিষ্টান বলে বেথুন কলেজে প্রবেশাধিকার পাননি। তিনি এফ.এ (ফার্স্ট আটর্স) পড়েন ফ্রি-চার্জ-নর্মাল স্কুলে। ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে অ্যালেন ডি. অ্যাব্রæ নামে এক খ্রিষ্টান ছাত্রী বেথুন কলেজে ভর্তি হলে চন্দ্রমুখী বসুও ভর্তি হন এবং ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে বি.এ এবং ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজিতে এম.এ পাশ করেন। তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মেয়ে যিনি ইংরেজিতে এম.এ পাশ করেন এবং এই কলেজেই অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ হন।
১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাদম্বিনীর বিয়ে হয় এবং কোলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে পাঁচ বছর পড়াশোনা করেন তবে মেডিসিন পরীক্ষায় অকৃতকার্যতার জন্য এম.বি উপাধি পাননি। অধ্যক্ষ তাঁকে গ্রাজুয়েট অব বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ জিবিএমসি উপাধি দেন। ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইংল্যান্ডে যান এবং পরে খ.জ.ঈ.চ (এডিনবরা) খ.জ.ঈ.ঝ (গøাসগো) এবং উ.ঋ.চ.ঝ (ডাবলিন) উপাধি নিয়ে দেশে ফেরেন। কিছুদিন তিনি ডাফরিন হাসপাতালে ডাক্তারী করেন। পরে স্বাধীন চিকিৎসা ব্যবসা শুরু করেন। সুবক্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের তিনি প্রথম নারী বক্তা। (অসমাপ্ত)

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন