পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রতিদিন টিভি চ্যানেলগুলো খুললেই কোনো না কোনো চ্যানেলে যে মুখটি সর্বদা উদ্ভাসিত হতো সেই চিরচেনা হাস্যোজ্জ্বল, ধীশক্তিসম্পন্ন সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ আর আমাদের মাঝে নেই। ২৭ এপ্রিল সকাল ১০.১০ মিনিটে থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গত ২ এপ্রিল মারাত্মক হৃদরোগ নিয়ে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য ১১ এপ্রিল তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ঐ হাসপাতালের আইসিইউতে তাঁর চিকিৎসা চলতে থাকে। অতঃপর ২৭ এপ্রিল সকালে শেষ পর্যন্ত না ফেরার দেশে চলে গেলেন মাহফুজ উল্লাহ। মুত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর।
সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ ১৯৫০ সালে নোয়াখালীর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ভারতীয় উপমহাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মুজফফার আহমেদের দৌহিত্র ছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যা ও সাংবাদিকতায় স্মাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করার পর সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। জীবনের শেষ পর্যন্ত এই পেশাতেই ছিলেন। কার্যত এই পেশাই তাঁকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক পরিচিতি এনে দিয়েছে। অসাধারণ বাগ্মীতা, ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তা, নির্মল ও সত্য যুক্তির আলোকে অনবদ্যভাবে যে সমস্ত লেখনি বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি লিখেছেন তা তাঁকে সাংবাদিক জীবনে যশ, খ্যাতি এনে দিয়েছে। এমনকি ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমগুলোতে রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতির বিষয়ে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত, মননশীল ও বিদগ্ধ আলোচনা-সমালোচনা সবাইকে হতবাক করে দিতো। প্রত্যেকটি বিষয়ের ওপর তাঁর পরিষ্কার ধারণা ও প্রখর যুক্তিসম্বলিত কথাবার্তা সবাইকে যেমন আকৃষ্ট করতো, তেমনি তাঁর সমালোচনাকারীরাও বিষয়টি মেনে নিতে বাধ্য হতেন। একজন প্রাজ্ঞ সাংবাদিক হিসেবে এটিই তাঁর জীবনের সার্থকতা, সফল্য। তাঁর সমালোচনাকারীরাও তাঁকে সমীহ করতেন, শ্রদ্ধা-ভক্তি প্রদর্শন করতেন। মানুষের জীবনে এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী বা হতে পারে! যেকোনো বিষয়ে সমালোচনা করতে গিয়ে কখনোই প্রতিপক্ষকে আহত করে কোনো কথা বলার অভ্যাস তাঁর ছিল না। তাঁর বক্তব্যের মধ্যে অপরের প্রতি অশ্রদ্ধাবোধ, অসম্মানও কখনোই প্রদর্শিত হয়নি। কারো মনঃকষ্টের কারণ হতে পারে, উদ্বেগ-উৎকন্ঠা বাড়াতে পারে এমন কোনো বক্তব্য তিনি কখনোই দিতেন না, বলতেন না। অত্যন্ত সাবলীল, স্বচ্ছ, ধীরস্থির, যুক্তিযুক্ত ভাষণে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন। পরমতসহিষ্ণুতা, ধৈর্যশীলতার গুণাবলীই মূলত তাঁকে একজন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছে।
বস্তুত ছাত্রজীবনে তিনি শুধু অধ্যয়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালের আয়ুব শাসনামলে সংগ্রামরত সমস্ত ছাত্র সংগঠনের প্রণীত ও প্রদত্ত ১১ দফা আন্দোলেনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তিতে তাঁর নিজস্ব যোগ্যতা ও দক্ষতা বলে ছাত্র রাজনীতির প্রথিতযশা, মেধাবী ও প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যা তাঁকে রাজনীতির অঙ্গনে ব্যাপকভাবে পরিচিতি এনে দিয়েছিল। ছাত্র রাজনীতি করতে গিয়ে তিনি আয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে ঢাকা কলেজ থেকে বহিষ্কৃত পর্যন্ত হয়েছিলেন। ছাত্রাবস্থায় মার্কসীয় দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখতেন এই মানুষটি। শ্রেণি বৈষম্যহীন সমাজ কাঠামো এদেশে গড়ে উঠবে, মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠিত হবে; পরিপূর্ণভাবে খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি পাবে বাংলাদেশের মানুষ, এটাই ছিল তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রামের ব্রত। কিন্তু ক্রমান্বয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো যখন ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে, তখন সেই ছোঁয়া থেকে মুক্তি পায়নি আমাদের দেশও। একইসঙ্গে সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের ব্যাপক পরিবর্তন, মতাদর্শগত পার্থক্য, উগ্রপন্থার জন্ম ইত্যাদি উপাদানগুলো এই আদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালে উদারনৈতিক গণতন্ত্রসমৃদ্ধ, মানবিক রাষ্ট্র গঠনের আদর্শ থেকে কখনো বিচ্যুতি হননি মাহফুজ উল্লাহ। তিনি চেয়েছিলেন রাষ্ট্রে আইনের শাসন, গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার নিশ্চয়তা।
মানুষের অধিকার, মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে ছাত্রাবস্থাতেই মাহফুজ উল্লাহ সাংবাদিকতা পেশার সাথে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের এক সময়ের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় বিভিন্ন বাংলা ও ইংরেজি দৈনিকে তিনি দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। রেডিও, টেলিভিশনে অনুষ্ঠান উপাস্থাপনা থেকে শুরু করে প্রচুর টকশো করেছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। অসুস্থ হওয়ার আগে এই বিষয়ের নিয়মিত শিক্ষক হিসেবে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত ছিলেন। আবার একাধারে তিনি যেমন ছিলেন পত্রিকার নিয়মিত কলাম লেখক অন্যক্ষেত্রে বাংলা ও ইংরেজিতে ৫০-এর অধিক গবেষণালব্ধ বই লিখেছেন, যা পৃথিবীর বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে সংগৃহীত আছে। আবার সামাজিক, রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে চীন প্রজাতন্ত্রে বিশেষজ্ঞ হিসেবে ও কলকাতাস্থ বাংলাদেশ উপদূতাবাসে কূটনৈতিক দায়িত্বের কাজ করেছেন। একইসঙ্গে বিশ্ব পরিবেশ নিয়েও নিবিড়ভাবে কাজ করার ফলে তাঁকে আন্তর্জাতিক পরিবেশবিদ হিসেবেও খ্যাতি এনে দিয়েছে। তিনি আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠন ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর অবজারভেশন অব নেচারের’ পরিচালনা পর্ষদে প্রথম বাংলাদেশি সদস্য ছিলেন। এভাবে সব্যসাচী প্রতিভায় সমৃদ্ধ একজন সাংবাদিক, গবেষক হিসেবে তার কর্মজীবনকে প্রসারিত করেছেন। স্বাধীন সাংবাদিকতা, বাক স্বাধীনতা, অবাধ গণমাধ্যমে বিশ্বাসী এই মানুষটি সর্বদা এসব অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রাম করে গেছেন; কলম ধরেছেন, বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন। অন্যায়, অপকর্ম, জুলুম, শোষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি, সত্য প্রকাশে পিছপা হননি; দ্বিধাবোধ করেননি।
প্রত্যেক মানুষের জীবনে তাঁর নিজস্ব কিছু ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-আদর্শ থাকে এবং যা তাঁর কর্মে-মননে প্রতিফলিত হয়। বিশেষ করে আদর্শবান মানুষের ক্ষেত্রে আমরা এই গুণাবলী দেখতে পাই। তেমনি একজন আদর্শবান সাংবাদিক ছিলেন মাহফুজ উল্লাহ, যিনি সমাজ ও রাষ্ট্রের দর্পণ হিসেবে নিত্য কাজ করেছেন। রাষ্ট্র ও সমাজের অসঙ্গতি, ত্রুটি, দুর্বল দিক অপসারিত করে কীভাবে অবাধ গণতন্ত্র, সুশাসন, উন্নয়ন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় এ বিষয়ে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা, গণতন্ত্র, সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। শত বাঁধা, প্রতিকূলতা, রাজনৈতিক-সামাজিক চাপ তাঁকে এই আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। জীবনের সৌন্দর্য ও সৌকর্য বৃদ্ধির জন্য কোনো লোভ-লালসা তাঁকে কখনো গ্রাস করতে পারেনি। অর্থ, পদমর্যাদা, সুখ-সুবিধার অবারিত দ্বার তাঁকে সুবিধাভোগী করতে পারেনি। তাঁর সততা, আদর্শ, ত্যাগ এদেশের সাংবাদিক জগতে আলোর পথ দেখাবে, অন্যদের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। টিভি টকশোগুলোতে তাঁর উপস্থিতি অনেককে অনুপ্রাণিত করতে ও সত্য-সুন্দর প্রকাশে তাঁর বিভিন্ন মন্তব্য অনেক দর্শকের মুখে উচ্চারিত হতে দেখেছি। সব শ্রেণির মানুষের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল এটা অনেক দর্শক, শ্রোতা ও পাঠকদের মুখ থেকে আমরা শুনেছি। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসনের পক্ষে তাঁর সার্বক্ষণিক অবস্থান, সংগ্রাম এবং এরপক্ষে অকাট্য যুক্তি তাঁকে মানুষের মাঝে অনেকদিন বাঁচিয়ে রাখবে, মানুষ তাঁর অভাববোধ করবে।
পরিশেষে বলা যায়, আমরা কেউ অবিনশ্বর নই। সবাইকে একসময় চলে যেতে হবে। মাহফুজ উল্লাহকে সেই পরমসত্যের মুখোমুখি হয়ে মানুষের সর্বশেষ পরিণতি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হলো মাত্র ৬৮ বছর বয়সে। সাংবাদিক জীবনে তাঁর সাথে আমার বহুবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে। সাংবাদিকতার অনেক গুণগত ও প্রায়োগিক দিকগুলো আমি তাঁর কাছ থেকে শিখেছি, জেনেছি, যা আমার সাংবাদিক জীবনের শিক্ষণীয় ও পাথেয় হয়ে থাকবে। টকশো করতে গিয়েও আলোচনার বিষয়বস্তুর ধরন-ধারন, কথা বলার শৈল্পিক দিক, সমস্যাসমূহের উপস্থাপন কৌশল ইত্যাকার দিকগুলোর অনেক কিছু তাঁর মতো জ্ঞানী মানুষের কাছ থেকে আমি শিখেছি। একটা নির্দিষ্ট আদর্শের ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী মানুষ হলেও অপর আদর্শের প্রতি তাঁকে কখনোই কটাক্ষ করতে দেখিনি। সবাইকে সমভাবে শ্রদ্ধা, সম্মান করতেন, অপরের মনঃকষ্টের কারণ হতেন না এই মানুষটি। সাংবাদিকতাকে জ্ঞান চর্চা ও জ্ঞান অন্বেষণের ক্ষেত্র মনে করতেন তিনি। আসলে সংবেদনশীল ও সৃষ্টিশীল মানুষগুলোই সাধারণত এরকম হয়ে থাকে এবং এটাই চিরাচরিত নিয়ম। তাই তাঁর এই হঠাৎ চির বিদায় নেয়া আমাদেরকে অনেককিছু থেকে বঞ্চিত করলো। তিনি বেঁচে থাকলে আমরা তাঁর কাছ থেকে আরো মার্জিত, পরিশীলিত, উন্নত, সৎচিন্তা ও কর্মের সন্ধান পেতাম। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে আদর্শিক কারণে নানা ধরনের চাপের মধ্যে তাঁকে বসবাস করতে হয়েছে। কিন্তু তিনি কখনোই হতোদ্যম হননি, ভেঙ্গে পড়েননি। তারপরও তাঁর এই অকস্মাৎ মৃত্যু আমাদের চরমভাবে ব্যথিত, দুঃখভারাক্রান্ত করলেও তাঁর সৃষ্টিশীল কাজ আমাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করবে। তাঁর কর্ম-আদর্শ, একনিষ্ঠ জ্ঞানচর্চা ও গবেষণাধর্মী লেখনী তাঁকে আমাদের মাঝে অনেকদিন বাঁচিয়ে রাখবে- সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
লেখক: চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।