পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ করে শুরু হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট দীর্ঘ। আজ প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখছি না। মুক্তিযুদ্ধের অনেক আঙ্গিক ছিল। তার মধ্যে প্রধানতম আঙ্গিক হলো রণাঙ্গন অর্থাৎ সরেজমিন অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করা। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে রণাঙ্গনের মুক্তিযুদ্ধের বা মুক্তিযোদ্ধাদের নিউক্লিয়াস ছিল বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলো। ১৯৭০ সালের মার্চকে স্থিত অবস্থায় চিন্তা করলে, ওই সময় যশোর সেনানিবাসে ছিল প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বা ফার্স্ট বেঙ্গল, জয়দেপুরে ছিল দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বা সেকেন্ড বেঙ্গল, রংপুর সেনানিবাসে ছিল তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বা থার্ড বেঙ্গল, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ছিল চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বা ফোর্থ বেঙ্গল এবং চট্টগ্রাম মহানগরের ষোলোশহরে ছিল অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বা এইটথ বেঙ্গল। যশোর এবং রংপুরে বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রথমে আক্রান্ত হয়। যুদ্ধ ও পাল্টা যুদ্ধের মধ্য দিয়েই তারা সেনানিবাস থেকে বের হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের পর্বটি বা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পর্বটি চট্টগ্রামের ষোলোশহরে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে, জয়দেবপুরে মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে ও কুমিল্লায় মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে, তুলনামূলকভাবে অধিকতর পরিকল্পিত ও অর্গানাইজড ছিল।
বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাইরেও তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে কর্মরত কয়েকজন বাঙালি অফিসারও রাইফেলসের বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে বিদ্রোহ করেছিলেন। যথা তৎকালীন ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, মেজর আবু উসমান চৌধুরী, মেজর নাজমুল হক প্রমুখের নাম প্রণিধানযোগ্য। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের এই পর্বটির প্রাক্কালের ঘটনাবলিকে তথা মুক্তিযুদ্ধের এই পর্বটির আলাপ-আলোচনা খুব কম করা হয়। আমার মূল্যায়ন সঠিকও হতে পারে, আবার নাও হতে পারে; কিন্তু আমার মূল্যায়নে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা ও রণাঙ্গনের যুদ্ধগুলোর মূল্যায়ন বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশে, অবহেলিত ও উপেক্ষিত; তথা মার্জিনালাইজড। এ জন্য আজকের কলামটি বিশেষভাবে লিখলাম; বর্তমান প্রজন্মের স্বার্থের প্রতি খেয়াল করে।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসটি বেশি উত্তাল ছিল। ৭ মার্চের পর উত্তাপ ও উদ্বেগ বেড়ে যায়। সেই সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরিরত কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালিরা এবং প্রত্যেক ব্যাটালিয়নের চারপাশের স্থানীয় জনগণের মধ্যে নিবিড় সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। দেশের জন্য যুদ্ধ করতে হবে এরূপ যৌথ আকাক্সক্ষা উভয় স¤প্রদায় অর্থাৎ বাঙালি সৈনিকেরা এবং বাঙালি জনগণের অন্তরে লালিত হচ্ছিল। এর একটি জ্বলন্ত ঐতিহাসিক উদাহরণ হচ্ছে ১৯ মার্চ ১৯৭১ জয়দেবপুরের ঘটনা।
১৯ মার্চের ঘটনায় স্থানীয় বাঙালি জনগণ প্রমাণ করেছিল, বাঙালির মনে স্বাধীনতার প্রজ্ব¡লিত শিখা অতি উজ্জ্বলভাবে জ্বলছিল। একই ঘটনা প্রমাণ করেছিল, বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালিরা বাঙালি জাতির চরম মুহূর্তে জাতির প্রতি অনুগত ছিল। ১৯ মার্চ থেকে নিয়ে ৭ দিন পর আসে ২৬ মার্চ তারিখটি। সেকেন্ড বেঙ্গলের যে দু’টি অংশ ময়মনসিংহ শহরে ও টাঙ্গাইল শহরে ছিল তারা ২৬ মার্চেই বিদ্রোহ করে। রাজেন্দ্রপুরে ও সমরাস্ত্র কারখানায় পাহারারত সৈনিকেরাসহ, জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদে অবস্থিত মূল অংশ, সেকেন্ড বেঙ্গলের উপ-অধিনায়ক মেজর কে এম সফিউল্লাহর আনুষ্ঠানিক নেতৃত্বে, ২৬ মার্চই বিদ্রোহ করলেও, ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের নিমিত্তে রাজপ্রাসাদ তথা জয়দেবপুর ত্যাগ করে। এই কলামে আমি ১৯ মার্চের ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এবং সে দিনের নায়ক ও মহানায়কদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করব।
১৯৬৮ সালে সেকেন্ড বেঙ্গল পুনরায় লাহোর থেকে বদলি হয়ে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা শহর থেকে অল্প উত্তরে অবস্থিত জয়দেবপুর নামক স্থানে আসে এবং রাজবাড়িতে আবাস নেয়। যেই গ্রামটির নাম জয়দেবপুর, সেটি ছিল পূর্ব বাংলার ইতিহাসের বিখ্যাত জমিদার বংশ ভাওয়াল রাজাদের রাজধানী এবং সেখানেই ছিল (এখনো আছে) ভাওয়াল রাজবাড়ী। আজকের এই সময়ে জয়দেবপুর নাম বা শব্দ বেশি পরিচিত নয়। এখন ওই স্থানটিকে গাজীপুর বলা হয়। কারণ, ১৯৮৫ সালে জন্ম নেয়া গাজীপুর জেলা সদর স্থাপন করা হয় ওই জয়দেবপুরেই। গত ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে ভাওয়াল রাজার রাজবাড়ীতে বা রাজপ্রাসাদে, গাজীপুর জেলার ডেপুটি কমিশনারের অফিস কার্যকর আছে। সেকেন্ড বেঙ্গলের কথায় ফিরে আসি। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৬ তারিখ, আমি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকুল থেকে কমিশন পাই। কমিশন পাওয়ার সময় সর্বোত্তম ক্যাডেট বিবেচিত হই, তথা প্রথম স্থান অধিকারকারী ছিলাম এবং কমান্ডার-ইন-চিফ’স কেইন বা সংক্ষেপে সিইনসি’স কেইন পুরস্কার লাভ করি।
নয় মাস প্রশিক্ষণ শেষে তথা শর্ট সার্ভিস কমিশনের ক্ষেত্রে এটাই ছিল পুরস্কার; দুই বছর প্রশিক্ষণ শেষে তথা নিয়মিত কমিশনের জন্য একই মূল্যের ও মানের পুরস্কারটির নাম ছিল সোর্ড অব অনার। সর্বোত্তম ক্যাডেটের জন্য প্রযোজ্য, ওই আমলে বিদ্যমান রেওয়াজ মোতাবেক, আমার ইচ্ছাতেই কর্তৃপক্ষ আমাকে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে পোস্টিং দেয়। ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭০ জয়দেবপুর রাজবাড়িতে অবস্থিত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করি এবং ব্যাটালিয়নের এডজুটেন্ট হিসেবে পেয়েছিলাম ওল্ড ফৌজিয়ান ক্যাপ্টেন এএসএম নাসিম, উপ-অধিনায়ক হিসেবে পেয়েছিলাম তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান এবং অধিনায়ক হিসেবে পেয়েছিলাম তৎকালীন (বাঙালি) লে. কর্নেল মাসুদুল হোসেইন খান। সাত দিন পর মেজর জিয়াউর রহমান, চট্টগ্রাম ষোলোশহরে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়কের দায়িত্ব নেয়ার জন্য চলে যান। তৎকালীন মেজর কে এম সফিউল্লাহ উপ-অধিনায়কের দায়িত্ব নেন। মেজর সফিউল্লাহ এবং মেজর জিয়াউর রহমান, পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকুলের ১২তম লং কোর্সের সদস্য ছিলেন এবং জিয়াউর রহমান মেধা তালিকায় জ্যেষ্ঠ ছিলেন, সফিউল্লাহ কনিষ্ঠ ছিলেন। আমি ওই ব্যাটালিয়নের কনিষ্ঠতম অফিসার ছিলাম, আমার র্যাঙ্ক ছিল সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট এবং ২৬ মার্চ ১৯৭১ স্থিতাবস্থায় সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে আমার চাকরি ছিল ৬ মাস ২০ দিন মাত্র।
সব অফিসারের কথা না বললেও একটি ব্যতিক্রমী তথ্য উল্লেখ করতেই হবে। সেকেন্ড বেঙ্গল মূল সেনানিবাস থেকে অনেক দূরে জয়দেবপুরে অবস্থান করার কারণে, ব্যাটালিয়নে একজন আর্মি মেডিক্যাল কোরের অফিসার তথা ডাক্তার নিয়োজিত ছিলেন। ওই সময় ওই ডাক্তার ছিলেন লেফটেন্যান্ট মোক্তার কামাল চৌধুরী। আমার বাড়ি যেমন ছিল চট্টগ্রাম জেলায়, মোক্তার কামালের বাড়িও ছিল চট্টগ্রাম জেলায়। মোক্তার কামাল পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে প্রসিদ্ধ অর্থোপেডিক সার্জন হয়েছিলেন এবং কর্নেল র্যাঙ্কে স্বাভাবিক অবসরে যান। ময়মনসিংহে অবস্থিত সেকেন্ড বেঙ্গলের অংশ বা ‘সি’ (চার্লি) কোম্পানির সাথে ছিলেন তৎকালীন মেজর নুরুল ইসলাম (শিশু) ও সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট এম এ মান্নান, উভয়েই বাঙালি।
টাঙ্গাইলে অবস্থিত সেকেন্ড বেঙ্গলের অংশ বা ‘এ’ (আলফা) কোম্পানির সাথে ছিলেন তৎকালীন (পাকিস্তানি) মেজর কাজেম কামাল খান ও (বাঙালি) সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান। জয়দেবপুরে ও পাঁচ মাইল দূরের গাজীপুরে উপস্থিতদের মধ্যে ছিলেন (বাঙালি) মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী, (বাঙালি) ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আজিজুর রহমান, (বাঙালি) ক্যাপ্টেন ইজাজ আহমেদ চৌধুরী, (বাঙালি) সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম এবং পাকিস্তানি তিনজন অফিসার।
সেকেন্ড বেঙ্গলের আবাসস্থল জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদে হলেও, চতুর্দিকে ছিল বাঙালি গ্রাম। স্থানীয় জনগণের সামনে সেকেন্ড বেঙ্গলের অফিসার ও সৈনিকদের সুসম্পর্ক ছিল। এই তথ্যটি গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭০ এর ডিসেম্বরে পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বা জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ফলাফলে দেখা গিয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয় পায়। গড়পড়তায় বা দেশব্যাপী হিসাবে বা কেন্দ্রীয় সরকারের হিসেবে পাকিস্তানব্যাপী সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ অঘোষিত সিদ্ধান্ত নেয়, আওয়ামী লীগকে তথা বাঙালিকে পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসতে দেবে না। এরূপ পরিস্থিতিতে দেশে এবং সেনাবাহিনীতে উত্তেজনা বা উদ্বেগ বিরাজ করছিল।
পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়নগুলোর ওপর বিশেষ দৃষ্টি রাখা শুরু করে। জয়দেবপুরে অবস্থিত সেকেন্ড বেঙ্গলকে শক্তিহীন করার লক্ষ্যে, একাধিক অজুহাতে বিভক্ত করে ফেলে। একটি কোম্পানিকে মোতায়েন করা হয় ময়মনসিংহ শহরে। একটি কোম্পানিকে মোতায়েন করা হয় টাঙ্গাইল শহরে। একটি কোম্পানির বৃহদংশকে মোতায়েন করা হয় জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদ থেকে অল্প দূরে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র সমরাস্ত্র উৎপাদনকারী বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিজ এবং জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদ থেকে আনুমানিক ৮ মাইল দূরে অবস্থিত রাজেন্দ্রপুর নামক ক্ষুদ্র সেনানিবাসে গোলাবারুদ রক্ষণাগারে। ব্যাটালিয়নের অবশিষ্ট অংশ জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদেই ছিল। আমি জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদেই ছিলাম।
ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদুল হাসান খান জয়দেবপুরেই ছিলেন। তিন সপ্তাহ টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ ইত্যাদি এলাকায় অবস্থান করলেও, ঠিক এই সময়টায় (১৮-১৯ মার্চ ১৯৭১) ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর কে এম সফিউল্লাহ, ঘটনাক্রমে জয়দেবপুরে উপস্থিত ছিলেন। তার পরবর্তী জ্যেষ্ঠ বাঙালি অফিসার ছিলেন মেজর মইনুল। ১৯৬৮-এর শেষ থেকে ক্যাপ্টেন র্যাঙ্কে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মোতায়েনরত ১৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার এডিসি বা ব্যক্তিগত স্টাফ অফিসার ছিলেন। অক্টোবর ১৯৭০ সালে, তিনি বদলি হয়ে পুনরায় তার নিজের ব্যাটালিয়নে ফিরে আসেন এবং অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই মেজর র্যাঙ্কে যথাযথভাবে প্রমোশন পান। তিনি ছিলেন ব্যাটালিয়নে কনিষ্ঠতম মেজর (এবং বাঙালি মেজর)। অপর পক্ষে আমি ছিলাম কনিষ্ঠতম অফিসার (এবং বাঙালি অফিসার)।
কনিষ্ঠতম অফিসার হিসেবে, সেনাবাহিনীর তথা পদাতিক বাহিনীর তথা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের রেওয়াজ বা ঐতিহ্য মোতাবেক, আমি ‘সি’ কোম্পানিতে যুগপৎ প্লাটুন কমান্ডার ও কোম্পানি-অফিসার হিসেবে ক্ষুদ্র দায়িত্বে ছিলাম এবং অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে, ব্যাটালিয়নের অধিনায়কের সাথে, রেওয়াজ মোতাবেক ‘ইনটেলিজেন্স অফিসার’ হিসেবে দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত ছিলাম। জ্যেষ্ঠ এবং কনিষ্ঠ অফিসারদের মধ্যে সম্পর্কের মাপকাঠি বোঝানোর জন্য একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ওই সময় অর্থাৎ ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদুলের চাকরি ছিল ১৯ বছরের বেশি, উপ-অধিনায়ক মেজর সফিউল্লাহর চাকরি ছিল ১৫ বছরের বেশি আর কনিষ্ঠতম অফিসার ইবরাহিমের চাকরি সাড়ে ছয় মাস এবং বয়স ২১ বছর।
এখন ওই সময়ের ইতিহাসের উল্লেখ করি। ১৯৭০ সালের মার্চ মাস উত্তাল ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীতেই, বাঙালি ও অ-বাঙালিদের মধ্যে অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছিল। ওই সময় সেকেন্ড বেঙ্গলের কাছে কিছু অতিরিক্ত অস্ত্র বৈধভাবেই ছিল। মার্চ মাসের আগে ওই অতিরিক্ত অস্ত্রগুলো ফেরত জমা দেয়ার কথা ছিল এবং তার জন্য সেকেন্ড বেঙ্গল অফিসিয়াল প্রসিডিউর ফলো করা শুরু করে। কিন্তু, সময় ও সুযোগের অভাবে জমাদানের কর্মটি হয়ে উঠছিল না। জয়দেবপুর থেকে ঢাকা সেনানিবাস পর্যন্ত সড়ক পথ রাজনৈতিকভাবে উত্তাল হতো; বহু বাধা-বিপত্তি হতো। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর, সেকেন্ড বেঙ্গলের বাঙালি অফিসাররা গোপন সিদ্ধান্ত নিলেন, ওই অতিরিক্ত অস্ত্র আর জমা দেয়া হবে না।
কারণ, অতি নিকট ভবিষ্যতে এগুলো প্রয়োজন হতে পারে। অপরপক্ষে, মার্চ মাসের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে, ঢাকায় অবস্থিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়, ওই অতিরিক্ত অস্ত্র জয়দেবপুর থেকে ঢাকায় ফেরত আনতেই হবে। ওই একই কর্তৃপক্ষ এটাও সিদ্ধান্ত নেয়, যদি সম্ভব হয় সেকেন্ড বেঙ্গলের সব অস্ত্রই কব্জা করে ফেলতে হবে যেন সেকেন্ড বেঙ্গল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনোরকম বিদ্রোহ করলেও, অস্ত্রের অভাবে সেই বিদ্রোহ কার্যকর করতে না পারে। এই দুটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নিমিত্তে একাধিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। তবে আজকে শুধু একটি পদক্ষেপের বর্ণনা এখানে করছি। ওই পদক্ষেপটি আজকের কলামের অন্যতম প্রতিপাদ্য। পাঠক এটা ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চের ঘটনা, তথা ১৯ মার্চ ১৯৭১-এর পাকিস্তানি অভিযান এবং তার বিরুদ্ধে যুগপৎ জয়দেবপুরের বাঙালি জনগণ ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের প্রতিরোধ এবং সেকেন্ড বেঙ্গলের বিদ্রোহ। ১৯ মার্চ ১৯৭১ সকালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে, ৫৭ পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার, ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাবের নেতৃত্বে কম-বেশি ৭০ জন অফিসার ও সৈনিক সংবলিত একটি দল জয়দেবপুরের উদ্দেশে রওনা দেয়। আনুষ্ঠানিকভাবে, এই সফরের কারণ ব্যাখ্যা করা হলো এই বলে যে, জয়দেবপুরে সেকেন্ড বেঙ্গল কেমন আছে এটা দেখা! ওই সেনাদল সকাল সাড়ে ১০টা-১১টার দিকে রাজপ্রাসাদে এসে পৌঁছে। স্থানীয় দেশপ্রেমিক বাঙালি জনগণ সব কিছুই অনুসরণ করছিলেন। তারা অনুধাবন করলেন যে, সেকেন্ড বেঙ্গলকে নিরস্ত্র করা হবে। স্থানীয় জনগণ সিদ্ধান্ত নিলেন যে, এটা কোনোমতেই হতে দেয়া যাবে না।
স্থানীয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে এবং নেতৃত্বে জয়দেবপুর বাজারে কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়ে গেল। স্থানীয় জয়দেবপুর রেলস্টেশনে দন্ডায়মান থাকা মালগাড়ির দু’টি বগি টেনে এনে জয়দেবপুর বাজারের কাছে লেভেল ক্রসিংয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো যেন রাজবাড়ী থেকে কেউ বাজারের দিকে যেতে না পারে বা বাজারের দিক থেকে কেউ রাজবাড়ীর দিকে আসতে না পারে। ব্রিগেডিয়ার আরবাবের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানি সেনাদল জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদে এসে সেকেন্ড বেঙ্গলের অফিসার ও সৈনিকদের যুদ্ধংদেহী সাজসজ্জা দেখে, অফিসার ও সৈনিকদের কথাবার্তা শুনে এবং তাদের চেহারায় ফুটে ওঠা অভিব্যক্তি অনুভব করে সিদ্ধান্ত নেয়, আজ আর সেকেন্ড বেঙ্গলকে নিরস্ত্র করা যাবে না! আজ তাদের অস্ত্র কব্জা করা যাবে না! আরবারের নেতৃত্বাধীন সেনা দল সিদ্ধান্ত নেয়, ইজ্জতের সাথে নিজেরা ফিরে যেতে পারলেই যথেষ্ট। আরবাবের দল ফেরত যাওয়ার পথে জয়দেবপুর বাজারের কাছে লেভেল ক্রসিংয়ে অবশ্যম্ভাবীভাবেই বাধাপ্রাপ্ত হলো। ব্রিগেডিয়ার আরবাব, সেকেন্ড বেঙ্গলের অধিনায়ক কর্নেল মাসুদুলকে হুকুম দিলেন যে, যেকোনো নিয়মে, প্রয়োজনে গুলি করে, উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সরিয়ে, লেভেল ক্রসিং থেকে মালগাড়ির বগি সরিয়ে, আরবাবের সেনাদলকে ফেরত যাওয়ার পথ নির্বিঘ্ন করা হোক।
অধিনায়ক যেখানেই দন্ডায়মান ছিলেন, আমি তার থেকে অল্প দূরেই তথা সম্মানজনক দূরত্বে ঘুরঘুর করতাম; এটিই ছিল রেওয়াজ; অর্থাৎ অধিনায়কের যেকোনো হুকুম বা ইশারা তামিলের জন্য সবচেয়ে নিকটে মওজুদ বা প্রাপ্য অফিসারই হতেন ব্যাটালিয়নের ইন্টেলিজেন্স অফিসার এবং আমিই ছিলাম ইন্টেলিজেন্স অফিসার। আনুষ্ঠানিকভাবে (আলবৎ উপরস্থ ব্রিগেডিয়ারকে দেখানোর জন্য) কর্নেল মাসুদুল হুকুম দিলেন সেকেন্ড বেঙ্গলের ‘ডি’ বা ডেল্টা কোম্পানির অধিনায়ক মেজর মইনুল হোসেনকে। এটা ছিল একটা চরম স্পর্শকাতর পরীক্ষা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি কর্নেল, বাঙালি মেজর তথা অফিসারেরা, বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিক, পাকিস্তানি বা পাঞ্জাবি সিনিয়রদের নির্দেশে জয়দেবপুরের বাঙালি জনতার ওপর গোলাগুলি চালায় কি না, এটাই ছিল দেখার বিষয়। ওইরূপ উদ্বেগসঙ্কুল পরিস্থিতিতে মেজর মইনুল হোসেন ও তার সঙ্গী অফিসারেরা ও জ্যেষ্ঠ সৈনিকেরা অনেক কৌশলগত পদক্ষেপ নেন।
পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে বুঝ দেয়ার জন্য, জনগণকে লক্ষ্য করে গুলি না ছুড়ে, বরং গাছের আগায় ও কচুরিপানা লক্ষ্য করে অল্প গোলাবর্ষণ করা হয়। অপরপক্ষে স্থানীয় হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতাও কঠিন পরীক্ষার সামনে ছিল। তারা চাচ্ছিল পাকিস্তানি বা পাঞ্জাবি সেনাদলকে আক্রমণ করতে বা পর্যুদস্ত করতে। কিন্তু পাকিস্তানি বা পাঞ্জাবি সেনাদল এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাদল রেললাইনের একই দিকে হওয়ায়, বিক্ষুব্ধ জনগণের পক্ষেও সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। জনগণ তাদের কাছে যেকোনো নিয়মেই রাখা বা পাওয়া স্থানীয় বন্দুক এবং একটি মারাত্মক ঘটনার মাধ্যমে পাওয়া পাঁচটি চাইনিজ রাইফেলের দু-একটি ব্যবহার করে। স্থানীয় জনতা পাকিস্তানি বা পাঞ্জাবি সেনাদেরকে লক্ষ্য করে গোলাগুলি করে। বাঙালি মেজর মইনুলকে ব্রিগেডিয়ার আরবাব, কর্নেল মাসুদুলের সামনেই অনেক ধমকা-ধমকি করে এবং শাস্তির ভয় দেখায় এই মর্মে যে, ‘কী গোলাগুলি করলা যে এখনও ১০টা লোকও মরে নাই?’
মেজর মইনুলও মোটামুটিভাবে কৌশলগত কথার ইশারায় জানিয়ে দিলেন যে, নিরস্ত্র বাঙালি জনতার ওপর গোলাগুলি করা যাবে না; আমরা বাঙালিদের ওপর হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করব না। ব্রিগেডিয়ার আরবাব অফিসারদের গ্রেফতার করার ভয় দেখালেন এবং অধিনায়কের ও অফিসারদের কোর্ট মার্শাল করার ভয় দেখালেন, ব্যাটালিয়ন ভেঙে দেয়ার ভয় দেখালেন; কিন্তু মেজর মইনুল অধিনায়কের সামনেই অর্থাৎ অধিনায়কের মৌন সম্মতিতে, ব্রিগেডিয়ারের কথা অগ্রাহ্য করলেন। যখন ব্রিগেডিয়ার ধমকা-ধমকি করছিলেন, তখন সব বাঙালি অফিসার চেহারায় ও অভিব্যক্তিতে আরো বিদ্রোহী হয়ে উঠছিলেন; সেকেন্ড বেঙ্গলের বাঙালি সৈনিকেরা অবস্থা আঁচ করতে পেরে, পাকিস্তানিদের ওপর রাগান্বিত ও উত্তেজিত হচ্ছিলেন। এরূপ প্রেক্ষাপটে, বিদ্যমান পরিস্থিতি যেন আরো অবনতি না হয়, তাই সেকেন্ড বেঙ্গলের জ্যেষ্ঠ অফিসাররা এবং স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতারা উদ্যোগ নিলেন পাকিস্তানিদের আড়াল রেখে।
সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের মধ্যে অনেকেই এখনও জীবিত আছেন এবং তাদের মধ্যে দু’জন অতি সুপরিচিত যথা একজন হলেন বর্তমানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এবং অপরজন বর্তমান মন্ত্রিসভায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তৃতীয়জন (জনাব আবদুল মোত্তালিব চৌধুরী) এখন জীবিত নেই। তিনি ছিলেন শ্রমিকনেতা ও সংগঠক আবদুল মোত্তালিব চৌধুরী। এই তিনজন সাত দিন পরেও সেকেন্ড বেঙ্গলকে সাহায্য করেছিলেন। সংগ্রাম পরিষদের পৃষ্ঠপোষক ও শুভাকাক্সক্ষীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শিক্ষানুরাগী প্রভাবশালী সামাজিক নেতা কাজী আজিম উদ্দীন।
প্রায় দুই ঘণ্টার অধিক সময়ের খন্ড যুদ্ধের পর, বিক্ষুব্ধ জনতা সম্মত হয়েছিল মালগাড়ির খালি বগিগুলো সরিয়ে নিতে। ফলে ঢাকা সেনানিবাস থেকে সকালে আসা সেনাদল ঢাকা ফেরত যাওয়ার জন্য রওনা দেয়। যাওয়ার পথে তারা বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনরত বাঙালিদের ওপর গোলাগুলি করে এবং অনেক মানুষ নিহত হয়। ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব, সেকেন্ড বেঙ্গলের অধিনায়ক কর্নেল মাসুদুলকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন এবং ঢাকা চলে আসতে হুকুম করেন। উপরে উপরে বা আনুষ্ঠানিকভাবে যেই অজুহাতই দেয়া হোক না কেন, আসল কারণ ছিল ওইটা, যেটা ওই সময়ে প্রকাশ করা হচ্ছিল না যথা পাকিস্তানিদের মূল্যায়নে সেকেন্ড বেঙ্গল মনেপ্রাণে বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছে এবং তাদের অধিনায়ককে অপসারণ করলে তাদের সক্ষমতা কমে যাবে। ২৩ মার্চ কর্নেল মাসুদুল চলে যান এবং পাঞ্জাব রেজিমেন্টে কর্মরত জনৈক বাঙালি লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাকিবকে সেকেন্ড বেঙ্গলের নতুন অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। ১৯ মার্চ বিকেলি ব্রিগেডিয়ার আরবাব অনেক কঠোর ও অশোভন ভাষায় সেকেন্ড বেঙ্গলকে ধমকাধমকি করে যান।
স্বীকার করতেই হবে যে, ৪৮ বছর আগের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যেই রাজনৈতিক ও সামরিক সঙ্কট জয়দেবপুরে সৃষ্টি হয়েছিল, তথা একটি দুই-তিন ঘণ্টার অধিককালের খন্ড যুদ্ধের বর্ণনা, শুধু একটি কলামের মধ্যে দেয়া কঠিন কাজ; কোনো-না-কোনো কথা বাদ থেকেই যেতে পারে অথবা কোনো-না-কোনো আঙ্গিক যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে উল্লেখ না-ও হতে পারে। এই সীমাবদ্ধতা অনিচ্ছাকৃত। ওই দিনের তথা ওই সময়ের কনিষ্ঠতম অফিসার হওয়ার সুবাদে ব্যাটালিয়নের সদর দফতরে ‘ইনটেলিজেন্স অফিসার’ হিসেবে দায়িত্ব পালনের অজুহাতে, ম্যাপ বা মানচিত্র ও ওয়ারল্যাস সেট ইত্যাদি হাতে নিয়ে সর্বদাই অধিনায়ক কর্নেল মাসুদুলের কাছাকাছি সরেজমিন অবস্থান করতে হতো বিধায় বা অবস্থান করার সুযোগ পাওয়ায়, আমি ওই দুপুর ও বিকেলের ঘটনাপ্রবাহ নিজ চোখে দেখা এবং নিজের হৃদয় দিয়ে অনুভব করার সুযোগ পেয়েছিলাম। বিদ্রোহী বাঙালি অফিসারদের মধ্যে আমি ছিলাম কনিষ্ঠতম।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।