পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী চার দশকের মধ্যে আমাদের দেশের ভুগর্ভস্থ পানির পরিমাণ ভয়ঙ্করভাবে কমে যাবে। যার ফলে পানির সঙ্কট দেখা দেবে। এমনিতেই এ দেশে সেচ সিক্ত জমির পরিমাণ খুবই কম। তদুপরি পানি সঙ্কটের ফলে তা আরও কমে যাবে এবং স্বাভাবিকভাবে এর কুপ্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে না খাদ্যশস্যের উৎপাদনও। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বার বার এ ব্যাপারে সতর্কবার্তা দিয়ে আসছেন।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত সমীক্ষক দল বলেছেন, আগামী ৪০ বছরে ভূগর্ভস্থ পানির সঞ্চয় প্রায় ৩৮ শতাংশ হ্রাস পাবে। একদিকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যেমন কমে যাবে, অন্যদিকে বর্ষা ঋতুর সময় সীমাও কমে আসবে। বর্ষা ছাড়া অন্য ঋতুতে বৃষ্টি প্রায় হবেই না। দীর্ঘদিন ধরে অল্প অল্প বৃষ্টিপাত না হয়ে, কম সময়ে বেশি বৃষ্টিপাত হবে। ফলে বৃষ্টির পানি নদী-নালা-খাল বাহিত হয়ে সাগরে বয়ে যাবে। সচ্ছিদ্র মাটি সে পানিকে যথেষ্ট পরিমাণে শুষে নেওয়ার সময় পাবে না। কমে যাবে মাটির নিচে পানির সঞ্চয়, নেমে যাবে পানিস্তর। অন্যদিকে ভূমিক্ষয় বাড়বে। বিজ্ঞানী পাচৌরি সবচেয়ে ভয়াবহ যে তথ্যটি দিয়েছেন তা হল, পরিবেশগত তাপমাত্রা ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে হিমবাহ গলে শেষ হয়ে যাবে। বড় বড় নদীগুলোতে পানিপ্রবাহ কমে যাবে। তাপমাত্রা হেরফেরের ফলে খাদ্যশস্যের উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। খাদ্যশস্যের মজুত ভান্ডারে টান পড়বে।
অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত এক দৈনিক পত্রিকার সংবাদে বলা হয়েছে, ২০৮০ সালের মধ্যে বিশ্বের ১১০ কোটি থেকে ৩২০ কোটি মানুষ পানির চরম অভাবের মুখে গিয়ে দাঁড়াবে। পাশাপাশি সে সময়ের মধ্যে কম করেও ২০ থেকে ৬০ কোটি লোক ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হবে। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি বর্তমানে যেভাবে ঘটছে তার পরিমাণ ২০৮০ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি পেলে হিমবাহ তথা তুষারাঞ্চলের অবক্ষয় ঘটবে। ফলে বাড়বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। লক্ষ লক্ষ মানুষের ঘর-বাড়ি ভেসে সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যাবে। এমনকি বিশ্বের জৈব সম্পদের বৃহত্তম ভান্ডার হিসেবে পরিচিত অস্ট্রেলিয়ার উপকূলবর্তী গ্রেট বেরিয়ার রিফেরও অবলুপ্তি ঘটবে। উলেখ্য, জার্মানীর পটসডামে ‘ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টার ফর জিওসায়েন্স’র বিজ্ঞানীরা বলেছেন, পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির পরিণামে ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ সমগ্র বিশ্বকে গ্রাস করবে এবং এর ফলে ধ্বংস হতে পারে মানব সভ্যতা। জার্মানির বিজ্ঞানীরা এ ক্ষেত্রে অতীত ইতিহাসের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেন, মেক্সিকোর মায়া চীনের তাং বংশের সময়কালীন সভ্যতা মোহেনজোদাড়ো এবং সিন্ধু সভ্যতা প্রাকৃতিক কারণেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সংবাদটিতে অস্ট্রেলিয়ার প্রসঙ্গে জানানো হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রেট বেরিয়ার রিফের অবলুপ্তির পাশাপাশি প্রবাল প্রাচীর ধ্বংস হয়ে সাগরের পানি অধিক অ¤যুক্ত হয়ে পড়বে। প্রবাল কীট ও উদ্ভিদ জাতীয় জৈব সম্পদ ধ্বংসের ফলে সাদা চুনাপাথরের কঙ্কালের প্রাচীরে পরিণত হবে বিশ্বের এ জৈব সম্পদের বৃহত্তম ভান্ডারটি।
একটি ছোট্ট ঘটনার উলেখ করা যায়, বেশ কয়েক বছর আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার পরিবেশ পরিচালনার কৌশল নিরূপণের একটি কার্যসহায়িকা স্থির করে দিতে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রায় ১৪ কোটি টাকা সহায়তা হিসেবে বরাদ্দ করা হয়। এ প্রসঙ্গে উলেখ করা প্রয়োজন, পৃথিবীর কম উন্নত বিভিন্ন দেশের স্বার্থে সহায়তা হিসেবে বরাদ্দ করা বাধ্যতামূলক। আন্তর্জাতিক এ বাধ্যবাধকতার কারণে ব্রিটিশ সরকার এ টাকা সাহায্য হিসাবে বরাদ্দ করে। তাতে দেখা যায়, মোট যে টাকা বরাদ্দ করা হয় তা ঐ দেশের গাসগো শহরের একটি কোম্পানির পক্ষ থেকে এমন সব মানুষকে সে দেশে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ হিসাবে পাঠানো হয় যাদের মধ্যে কেউ কেউ ঐ দেশের বিদ্যালয়ে ভূগোল, পরিবেশ বিজ্ঞান বা জৈব বিজ্ঞানের শিক্ষক-শিক্ষিকা মাত্র। অথচ প্রতিদিন যে হারে তাদের দৈনিক ভাতা দেয়া হয়, তা পৃথিবীর প্রথম শ্রেণীর বিশেষজ্ঞরা যা পেয়ে থাকেন তারই সমান। এছাড়া দেশের সবচেয়ে বিলাসবহুল হোটেল এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে চলাফেরার জন্য এদের জন্য রাজকীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দের ব্যবস্থা করা হয়।
এক তথ্যে জানা যায়, গত বছরের জুলাই মাসে এক ফোটা বৃষ্টি হয়নি গোটা কাশ্মীর উপত্যকায়। গুলমার্গ, পহেলগাঁওয়ে গরম জামা পরতে হয়নি কারো। পহেলগাঁওয়ে লিভার নদীর তীরে পড়েছিল বিশাল বিশাল বরফের চাঁই। কিন্তু এত গরমে নদীতে বরফের চাদর কেন? উত্তরে সেনাবাহিনীর এক মেজর জানিয়েছিলেন, ‘নদীর পানি জমে এ বরফ হয়নি। পাহাড়ে হিমবাহ গলে যাচ্ছে। সেই হিমবাহ থেকে বরফের চাদর নেমে এসেছে নিচে।’ জুলাই মাসের প্রচন্ড গরমের পরে শীত যে এমন প্রবল হবে তা কেউ ভাবেনওনি। শীতে সেরা তুষারপাত দেখল কাশ্মীরবাসী। সমুদ্রের তীরে করাচী বা বোম্বাইতে শীত তেমন পড়ে না। কলকাতা বা ঢাকার মতোও নয়। বৃষ্টিপাতের নিরিখে করাচী বা মুম্বাইয়ের স্থান ছিল ঢাকা, কলকাতার অনেকটা নিচে। কিন্তু সেই মুম্বাই বা করাচী একসময় বৃষ্টিপাতে ছাড়িয়ে গেল ঢাকা, কলকাতাকে। ২০০৫ সালের ২৭ জুলাই মুম্বাইতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ পৌঁছে গিয়েছিল ৯৪.৪ সেন্টিমিটারে। বাণিজ্য নগরীর তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল ৮.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
বৃষ্টি ও তাপমাত্রার পূর্বাভাস দিতে হিমশিম খেয়েছে আবহাওয়া দফতর। আবহাওয়া পরিবর্তন নিয়ে যে আন্তঃরাষ্ট্রীয় গবেষণা সংস্থা তৈরি হয়েছে তাদের সদস্যরা দফায় দফায় বৈঠক করে আবহাওয়ার এ পরিবর্তনের কারণ খোঁজার চেষ্টা চালিয়েছেন। কেন খুঁজেছেন তারা? কারণ এর সঙ্গে পানি সঙ্কটের সম্পর্ক রয়েছে। সম্পর্ক রয়েছে পানিস্তরের। আইপিসি’র ২০০৭ এ প্রকাশিত সূত্র মতে, (১) পানির স্তর নামার ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে এশিয়া অঞ্চলে তীব্র পানিসঙ্কট দেখা দিবে। (২) বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের উপকূলবর্তী এলাকায় সমুদ্র পানির তাপমাত্রা বাড়বে। (৩) ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, কলেরার জীবাণু আরো সক্রিয় হবে। (৪) তিব্বতে অন্তত চার কিলোমিটার হিমবাহ নিশ্চিহ্ন হবে। (৫) সমুদ্রের পানিস্তর বেড়ে ম্যানগ্রোভ অরণ্য তলিয়ে যাবে। (৬) ত্রিশ বছরে এশিয়ার ৩০ শতাংশ প্রবাল প্রাচীর নষ্ট হবে। (৭) বিপর্যয় ঘটবে সমুদ্র তলের টেকটনিক পেটে।
অনেকে উদ্যোগী হয়েছেন সীমিত পানিকে চাষের কাজে ব্যবহার করার নিত্যনতুন পদ্ধতির বিষয়ে। এ রকম একটি পদ্ধতি হল ‘গ্রীণ হাউস’ প্রযুক্তি। ভারত সরকারের কৃষি মন্ত্রকের অধীন ‘ন্যাশনাল কমিটি অন পাস্টিকালচার অ্যাপিকেশন ইন হর্টিকালচার’-এর আর্থিক সাহায্যে খড়গপুর আইআইটি এর ‘প্রিসিশন ফার্মিং ডেভেলপমেন্ট সেন্টার’ এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু গবেষণা নয়, এ প্রযুক্তির কার্যকারিতার বাস্তব রূপটি আইআইটি’র কৃষি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগের গবেষকরা প্রমাণ করেছেন ইতিমধ্যেই।
এ ব্যাপারে আইআইটি’র কৃষি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান গবেষক ড. কে এন তেওয়ারি জানিয়েছেন, ‘গ্রীন হাউস’ হল কোনো কাঠামোর উপর স্বচ্ছ পদার্থ আচ্ছাদিত একটি বিশেষ ঘর। এখানে আংশিক অথবা সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ফসলের চাষ সম্ভব। তাঁর দাবি, এ প্রযুক্তিতে অল্প জায়গায় চরমভাবাপন্ন জলবায়ু ও বেশি বৃষ্টিপাতপ্রবণ অঞ্চলে চাষ সম্ভবপর হয়েছে। পাস্টিকের তৈরি ঘর মূলত গাছকে তীব্র ঝড়, প্রবল শিলাবৃষ্টি, তুষারপাত, অত্যধিক তাপমাত্রা, পোকা-মাকড় ও বালুর আক্রমণ থেকে প্রতিহত করে। এ প্রযুক্তির সুবিধা হল-ভিতরে আলো, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নিয়ন্ত্রিত পরিবর্তনের ফলে গাছের বৃদ্ধি ও ফলন খুব ভাল হয়। পাস্টিক ঘরের ছাদ ডিম্বাকৃতি হওয়ার ফলে ভিতরে সর্বোচ্চ আলো প্রবেশ করতে পারে। পানিও কম লাগে। এছাড়া এ পদ্ধতিতে মৌসুমের পূর্বে সবজি উৎপাদন করে সর্বোচ্চ পরিমাণে ফসল ফলানো যায় । বীজ থেকে ফুল, ফল ও সবজির চারা খুব কম সময়ের মধ্যে তৈরি করা যায় । ‘গ্রীন হাউস’ এর ব্যাপারে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল বিশেষ করে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বর্ধমান, হুগলির অনেক কৃষক আইআইটি’র সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।
পরিবেশের যে বিপন্নতা তার সমার্থক হল মানুষের বিপন্নতা। আমাদের এ বিপন্নতা কোনো বিদেশি সাহায্য অথবা সরকারি বদান্যতা রোধ করতে পারবেনা। আমাদের দেশের পরিবেশকে বাঁচাতে পারে আমাদের মধ্যে অর্জিত সচেতনতা। ‘এ ক্ষেত্রে আমরা এ যাবৎকালে যে সমস্ত ‘সাকসেস স্টোরি’ অর্জন করতে পেরেছি তা হোক আমাদের বেঁচে থাকার অভিযানের পাথেয়, অনুপ্রেরণা। মনে রাখতে হবে, পরিবেশ রক্ষার জন্য যে সচেতনতার কথা বলছি তা যেন শোগানধর্মী অভিযানে পরিণত না হয়। এ সচেতনতাকে বাস্তবায়িত করতে পারে ছোট ছোট বাস্তব কর্মসূচি নির্দেশিত বলিষ্ঠ কিছু কার্যক্রমকে-যাকে পরিভাষায় বলা যেতে পারে ‘অ্যাকশন ওরিয়েন্টেড প্যান্স’। নিজেকে দিয়ে শুরু করতে হবে। নিজে পানি অপচয় না করে পরিবারের আরও দু’জন সদস্যকে সচেতন করতে পারার মাধ্যমে প্রাথমিক কাজটি শুরু করা যায়।
আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যে, এসব পদ্ধতি অবলম্বন করলে পানির প্রচুর সাশ্রয় হবে। সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে পাশাপাশি সরকারকে এ বিশাল সমস্যা সমাধানে আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে। সমস্যা আছে, থাকবে তার সমাধানও আছে। বসে থাকলে হবে না। দীর্ঘদিন আগে এডমন্ড হিলারী বলেছিলেন, পরিবেশজনিত সমস্যা আসলে একটি সামাজিক সমস্যা, এ সমস্যা সৃষ্টির কারণ ও শিকার দুই-ই মানুষ। আর মানুষই পারে এ সমস্যা সমাধান করতে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।