Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শ্বেতাঙ্গ গণহত্যা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বিশ্বব্যাপী বিষ ছড়াচ্ছে

খুনি ব্রেন্টন ট্যারান্টকে গ্রেফতার করার মুহূর্ত

দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট | প্রকাশের সময় : ১৮ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে গণহত্যা চালানো খুনি দাবি করেছে যে সে সেই বিশ্বাসের লাখ লাখ অনুসারীদের একজন। আর ওই বিশ্বাস তাকে ৪৯ জন মুসলিম হত্যার জন্য উৎসাহিত করেছে। এই খুনি কান্ডজ্ঞানহীন শ্বেতাঙ্গ গণহত্যা ষড়যন্ত্র তত্তে বিশ্বাসী যে বিশ্বব্যাপী বিষ ছড়াচ্ছে।
এই খুনি ব্রেন্টন ট্যারান্ট বলেছে, শুধু অ্যান্ডার্স ব্রেইভিকের নাইটস টেম্পলার গ্রুপ তার পরিকল্পনা জানত। তবে সে বহু জাতীয়তাবাদী গ্রুপকে তার ইশতেহার প্রদান করেছে। আরো অনেকের সাথে মতবিনিময় করেছে। সে বলেছে যে দু’বছর আগে ২০১৭ সালের গোড়ার দিকে পশ্চিম ইউরোপ ভ্রমণের সময় সে একটা হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
নিরাপত্তা সূত্র বলেছে, ট্যারান্ট তার এ ভ্রমণের সময় হয়ত চরম ডানপন্থীদের সাথে সাক্ষাত করেছিল। সে সময়টি ইসলামিক স্টেট উৎসাহিত সন্ত্রাসী হামলার কারণে বর্ধিত উত্তেজনা ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সাথে সম্পর্কিত ছিল। ব্রেন্টন তার ইশতেহার ৮ চ্যানেল মেসেজ বোর্ডে পোস্ট করে অজ্ঞাতনামা ব্যবহারকারীদের কাছে আবেদন করেছিল যেন তার মেসেজ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া হয়। তারা তা করেছিল। ৮ চ্যানেল হচ্ছে চরম বর্ণবাদ, যৌনতা ও সহিংস মন্তব্যের জন্য কুখ্যাত একটি অসংশোধিত টিভি চ্যানেল বোর্ড।
তবে তার ১৬ হাজার শব্দের ইশতেহারে নতুন কিছু ছিল না। সে যে ধারণা, মতাদর্শ ও আচরণের কথা বলেছে তা বহুদিন ধরেই চরম ডানপন্থী গ্রুপগুলো ও তাদের নেতারা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপে ছড়িয়ে চলেছেন। ট্যারান্টের সন্ত্রাসী হামলার মূলে রয়েছে শ্বেতাঙ্গ গণহত্যা ষড়যন্ত্র তত্ত¡। এতে বলা হয়েছে যে পশ্চিমা দেশগুলোতে শ্বেতাঙ্গদের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে অশ্বতাঙ্গরা। সে তার ইশতেহারে তত্তে¡র মূল হিসেবে ১৪টি শব্দ ব্যবহার করেছে। তার অস্ত্রগুলোতে অন্যদের নাম ও তার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করা স্লোগানের সাথে এ সংখ্যাটি লিখেছে।
‘আমরা অবশ্যই আমাদের জনগণের অস্তিত্ব ও সাদা শিশুদের ভবিষ্যত নিশ্চিত করব’ এ প্রবাদটি যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল অ্যাকশন নিও নাজি গ্রুপসহ বিশ্বব্যাপী চরম ডানপন্থী সন্ত্রাসীদের দ্বারা গৃহীত হয়েছে। শ্বেতাঙ্গ গণহত্যা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব-র অন্য প্রবক্তাদের মধ্যে রয়েছেন সাংবাদিক কেটি হপকিন্স, ইনফোওয়ারস-এর অ্যালেক্স জোনস, প্রাউড বয়েজ-এর প্রতিষ্ঠাতা গ্যাভিন ম্যাকইনস ও কানাডার ইউটিউবার লরেন সাউদার্ন।
২০১৬ সালে ‘হোয়াইটজেনোসাইড টিএম’ নামক একটি বর্ণবাদী ও সেমেটিক বিরোধী গ্রুপের পোস্টের রিটুইটের সময় এ তত্তে¡র প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। প্যান-ইউরোপীয় এথনো-ন্যাশনালিস্ট গ্রুপ জেনারেশন আইডেন্টিটি কর্তৃক ‘মহা প্রতিস্থাপন তত্ত্ব’ নামে একই তত্তে¡র একটি বিকল্প বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ে। ট্যারান্ট কর্তৃক এটা তার ইশতেহারের শিরোনাম হিসেবে গৃহীত হয়। জেনারেশন আইডেন্টিটির যুক্তরাজ্য শাখা ২০১৭ সালে চালু হয়। তারা সদস্যদের ফ্রান্সে দীক্ষাদান শিবিরগুলোতে পাঠাতে থাকে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হিংসাত্মক প্রচারণা ও বিক্ষোভ প্রদর্শন চলে।
ব্রিটেনে বাস্তব জীবনের সদস্যপদ কম থাকলেও অনলাইনে ইসলাম বিরোধী অ্যাক্টিভিস্ট টমি রবিনসনের মত উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিসহ সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এর সদস্যদের সম্প্রতি ম্যাঞ্চেস্টারে রবিনসনপন্থী বিক্ষোভে ব্যানার হাতে এবং ডিসেম্বরে রবিনসন ও ইউকিপ নেতৃত্বাধীন ব্রেক্সিট ‘বিট্রেয়াল’ মিছিলের প্রচারপত্র বিতরণ করতে দেখা যায়। টুইটারে তাদের প্রধান একাউন্টটি বন্ধ হওয়ার আগে জেনারেশন আইডেন্টিটি ব্রিটিশ নগর ও শহরগুলোতে অশ্বেতাঙ্গদের স্বেতাঙ্গের স্থলাভিষিক্ত করার প্রমাণবিহীন তথ্য যথেচ্ছভাবে পোস্ট করে।
বহু চরমপন্থী গ্রুপ জন্মহার পরিসংখ্যান ব্যবহার করে দাবি করে যে ইউরোপে সাদারা হুমকির সম্মুখীন। কিন্তু সাদা জাতিগত বিষয় তারা এড়িয়ে যায়। গবেষণায় বলা হয়েছে যে উচ্চ জন্মহার নতুন অভিবাসী পরিবারগুলোর সাংস্কৃতিক ও আর্থ-সামাজিক বিষয় এবং সময়ের ব্যবধানে স্থানীয় জনগণের সাথে একীভ‚ত হওয়ার সাথে সম্পর্কিত। সাদা মানুষের বিলুপ্ত হওয়ার পথে বা তাদের সংখ্যাকে ছাপিয়ে যাওয়ার কোনো সমন্বিত চেষ্টার কোনো প্রমাণ মেলেনি।
অথচ ট্যারান্টের ইশতেহারে বারবার এ ভিত্তিহীন বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। ইশতেহারে অশ্বেতাঙ্গ ও মুসলিম ‘হামলাকারীদের’ হত্যা করা এবং অধিক সন্তান নেয়ার জন্য সাদাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। ট্যারান্ট দাবি করেছে যে ব্রেইভিকের সাথে তার সংক্ষিপ্ত যোগাযোগ ছিল। ব্রেইভিকের নিজের ইশতেহার ডেমোক্র্যাট দলের সদস্য ও সাংবাদিকদের হত্যার ষড়যন্ত্রকারী একজন মার্কিন কোস্টগার্ডসহ হামলাকারী ও ষড়যন্ত্রকারীদের উৎসাহিত করেছিল।
সে দাবি করে যে সে তখন নিজেদের নাইটস টেম্পলার নামে পরিচয় দেয়া ব্রেইভিকের অনুসারীদের তার হামলার পরিকল্পনা জানায় ও তাদের সমর্থন পায়। কিন্তু ব্রেইভিকের সাথে তার যোগাযোগ সম্ভব ছিল কিনা তা এখনো পরিষ্কার নয়। ২০১১ সালে নরওয়েতে গণহত্যা চালিয়ে ব্রেইভিক ৭৭ জনকে হত্যা করে। ব্রেন্টন বলেছে, অন্য যাদের দ্বারা উৎসাহিত হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন ব্রিটিশ ফ্যাসিস্ট নেতা অসওয়াল্ড মোসলে, চরম ডানপন্থী সন্ত্রাসী ফিনসবারি পার্কে হামলাকারী সন্ত্রাসী ড্যারেন অসবর্ন, সুইডেনে স্কুলে হামলাকারী অ্যান্টন লুন্ডিন পিটারসন, ইটালির অভিবাসী ঘাতক লুকা ট্রেইনি ও চার্লসস্টোন চার্চের ঘাতক ডিলান রুফ।
ট্যারান্ট নিজেকে নাজি বলে স্বীকার করেনি। তবে সে যে ফ্যাসিস্ট তা বলেছে। সে ওডিন ক্রস ও ব্ল্যাক সানসহ নব্য-নাৎসি নিদর্শন ব্যবহার করে। তার ইশতেহারেও তা রয়েছে। সে তার হত্যাকান্ডের ভিডিও প্রচারের জন্য ৮ চ্যানেলকে ব্যবহার করার পর ফেবুকেও তা পোস্ট করে। ইন্টারনেট গবেষণা গ্রুপ বেলিংক্যাট-এর রবার্ট ইভান্স সতর্ক করে বলেন যে ব্রেন্টনের ইশতেহারটি মিথ্যা বা ব্যঙ্গপূর্ণ রূপে গণ্য হতে ও উস্কানিদানকারী বিষয় হতে পারে।
ট্যারান্ট উৎসাহের উৎস হিসেবে যাদের নাম করেছে তাদের মধ্যে মার্কিন ডানপন্থী ছাত্রগ্রুপ টার্নিং পয়েন্ট-এর ক্যানডেস ওয়েনসের নামও আছে। ইভান্স বলেন, এটা বিভ্রান্ত করার জন্যও হতে পারে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওয়েনসের প্রশংসা করেছেন। গত সপ্তাহে ওয়েনস যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে টার্নিং পয়েন্টের নতুন শাখাগুলো পরিদর্শন করার সময় এমপি জ্যাকব রিস-মগ ও স্টিভ বেকারেরর সাথে ছবি তোলেন।
ওয়েনস ব্রেনটনকে উৎসাহিত করার কথা অস্বীকার করেন। তবে সমালোচকরা তার ২০১৮ সালের একটি টুইট-এর কথা বলেছেন যাতে লেখা হয়েছে, যদি ফ্রান্স কোনো বিষয়ে আত্মরক্ষার জন্য সৈনাবাহিনী তৈরি করতে চায় এটা হবে তার জনগণের জন্মহার হ্রাস করা। সব লক্ষণ থেকে দেখা ইঙ্গিত মিলছে যে ৪০ বছরের মধ্যে এটি এক মুসলিম প্রধান দেশ হবে। ইমানয়েল ম্যাক্রোঁ, আগে আপনার সংস্কৃতি রক্ষা করুন।
ট্যারান্টের হামলা ও ইশতেহার খুব সতর্কতার সাথে সমন্বয় করা যাতে অনলাইন ও অফলাইনে বিরোধ সৃষ্টি করা যায়। সে আশা করেছিল যে এই বিরোধ গৃহযুদ্ধের সৃষ্টি করবে। ইভান্স লিখেছেন, হামলার পর এক ঘণ্টার বেশি সময় পেরনোর আগেই ব্রেন্টনের পদাংক অনুসরণ করার জন্য তার সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।



 

Show all comments
  • Md Akther Uzzaman ১৮ মার্চ, ২০১৯, ১:০৯ এএম says : 0
    একজন জঙ্গি এতগুলো মানুষকে হত্যা করে চলে গেল।আর সে দেশের পুলিশ বসে বসে মুলা চাবাইলো।এরা বলে এদের দেশ নিরাপদ
    Total Reply(0) Reply
  • Muhammad Shafiuddin ১৮ মার্চ, ২০১৯, ১:২৩ এএম says : 0
    লোকটার কাছে এতো গুলো অত্যাধুনিক অস্ত্র থাকার পরও, তাকে জীবিত ধড়েছে নিউজিল্যান্ড পুলিশ, আর বাংলাদেশে খেলনা পিস্তলওয়ালা বিমান ছিনতাইকারীও তুমুল যুদ্ধের পর মৃত অবস্থায় ধড়া পড়ে
    Total Reply(0) Reply
  • Ahmed Tushar ১৮ মার্চ, ২০১৯, ১:২৪ এএম says : 0
    সঠিক বিচারটা বোধহয় আমরা পাবো না। পাকিস্তানের মতো নিউজিল্যান্ডে সব ধরনের আন্তজাতিক ম্যাচ নিষিদ্ধ করা হোক।
    Total Reply(0) Reply
  • Shimul Kanti Debnath ১৮ মার্চ, ২০১৯, ১:২৫ এএম says : 0
    তার কোন ফাঁসি হবে না বড় জোর দশ বছরের জেল কারণ নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া ফাঁসি দেওয়ার রেওয়াজ নাই।।
    Total Reply(0) Reply
  • Ayub Khan ১৮ মার্চ, ২০১৯, ১:২৬ এএম says : 0
    সাদা চামড়ার সমাজে এমন কালো মন মানসিকতার মানুষ বাসকরে ভাবতেই অবাক লাগে।
    Total Reply(0) Reply
  • Harunur Rashid ১৮ মার্চ, ২০১৯, ৯:৪৩ এএম says : 0
    এই হামলা প্রমাণ করে মুসলমানরা জঙ্গি নয়।জঙ্গি হলো ইহুদি খ্রিস্টানরা ।আমি ঐ জঙ্গির ফাঁসি চাই।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: খুনি

১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ