Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ এখন মিডিয়ায়

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১২ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

বিশ্বজুড়ে ক্রমাগত পারমাণবিকসহ ভয়াবহ সব গণবিধ্বংসী অস্ত্রের উন্নয়ন কর্মকান্ড জোরালো হলেও সবই যেন করা হচ্ছে নিজ নিজ সুরক্ষার তাগিদে। বিভিন্ন মারণাস্ত্রের ধ্বংস-ক্ষমতার কারণেই সম্ভবত যুদ্ধের চেয়ে এখন যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলাই দেখা যায় বেশি। নয়া তথ্যপ্রযুক্তির যুগ আদতে যুদ্ধের ধ্যানধারণাই অনেকখানি পাল্টে দিয়েছে। বদলে গেছে যুদ্ধের হাতিয়ার, বদলে গেছে ময়দানও। অতীতের যে কোনও সময়ের চেয়ে ‘প্রচারণা’ এখন শক্তিশালী যুদ্ধাস্ত্র, যুদ্ধের সবথেকে বড় ময়দান সাইবার স্পেস। ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের ক্ষেতেও একই বাস্তবতা। দুই পক্ষের সামরিক উত্তেজনা আপাতভাবে খানিকটা প্রশসিত হয়ে আসলেও থামেনি ‘দাবি’ আর ‘পাল্টা দাবি’র যুদ্ধ। ভারতীয় বিমান অভিযানে জঙ্গি নিহত ও তাদের ঘাঁটি নিশ্চিহ্ন হওয়ার প্রশ্ন ছাড়াও পাল্টাপাল্টি বিমান হামলায় ভূপাতিত বিমানের সংখ্যা, হত্যার শিকার ব্যক্তির সংখ্যা নিয়ে মতভেদ দেখা দিয়েছে। পাকিস্তানে আটক হওয়া পাইলট অভিনন্দন বর্তমানের মুক্তির বিষয়েও দুই দেশে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়েছে। সঙ্গে পারস্পরিক আক্রমণ আর হুঙ্কার তো ছিলই। সবমিলে তথ্যমাধ্যমই হয়ে উঠেছে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ময়দান।
কাশ্মিরে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই মোহাম্মদের ১৪ ফেব্রুয়ারির (বৃহস্পতিবার) হামলার জেরে ২৬ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার) ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানের আকাশসীমায় ঢুকে বোমাবর্ষণ করে। ভারতের ভাষ্য, বিমান হামলার লক্ষ্য ছিল পুলওয়ামা হামলার দায় স্বীকার করা জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব বিজয় কেশব গোখলে অভিযানের পর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রতিরোধমূলক এই হামলার লক্ষ্য ছিল ‘জিহাদি’ ও জইশ ই মোহাম্মদের ‘সবচেয়ে বড় ট্রেনিং সেন্টার’ ধ্বংস করা। হামলায় ‘ফিদাইন তৎপরতায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বহু সংখ্যক জিহাদি ছাড়াও মারা গেছে জইশ-ই-মোহাম্মদের অন্যান্য জঙ্গি সদস্য, প্রশিক্ষক ও উচ্চ পর্যায়ের নেতা।’ভারত তাদের বিমান হামলায় নিহত জঙ্গিদের কোনও সুনির্দিষ্ট সংখ্যা প্রকাশ করেনি। তবে বেশ কয়েকটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে এই সংখ্যাকে ২শ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশ পর্যন্ত দাবি করেছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ থেকে শুরু করে সরকারের ঘনিষ্ঠ অন্যান্য কয়েকটি সূত্র নিহতের সংখ্যা আড়াইশ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
ভারতের এই দাবি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে দেশটির বিরোধী দলীয় নেতারা। তাদের আশঙ্কা, বিজেপি আসন্ন নির্বাচনে প্রচারণাগত সুবিধা পেতে নিহতের সংখ্যা বাড়িয়ে বলছে। এদিকে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ২৬ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় বিমান তার আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে, বালাকোটের কাছে ‘পেলোড’ ফেলেছে। কিন্তু এতে কোনও ধ্বংসের বা প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কুরেশি মন্তব্য করেছেন, ‘আরও একবার ভারত তার স্বার্থ উদ্ধারে জন্য বিপজ্জনক ও বানোয়াট দাবি উত্থাপন করেছে। বালাকোটের স্থানীয় বাসিন্দারা রাতের বেলা বিশাল বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন। কিন্তু তাদের ভাষ্য, এতে মাত্র একজন ব্যক্তি আহত হয়েছে। কোনও ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
বার্তা সংস্থা এএফপির সাংবাদিক সংশ্লিষ্ট স্থানে যাওয়ার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও স্থানীয়রা তাকে ভারতীয় বিমান হামলার যে স্থানটি দেখিয়েছে সেখানে শুধু একটি বড় গর্ত, দুইটি ভেঙে পড়া গাছ ও তিনটি মাটির বাড়ি দেখেছেন। বাড়িগুলোর একটির দেয়াল ভাঙা ছিল। এএফপি স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি, আশেপাশে জইশ-ই-মোহাম্মদের কোনও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে কি না। তবে কিছু স্থানীয় সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে, কাছেই একটি মাদ্রাসা আছে যা জইশ-ই-মোহাম্মদ পরিচালনা করে, যা অক্ষত আছে। আটলান্টিক কাউন্সিলের ‘ডিজিটাল ফরেনসিক রিসার্চ ল্যাবের’ পক্ষ থেকে বলা হয়েছে স্যাটেলাইটে পাওয়া ছবিতে শুধু বনভূমি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার চিহ্ন দেখা গেছে। আশেপাশের কোনও স্থাপনার ক্ষতি হওয়ার চিহ্ন পাওয়া যায়নি। পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে কয়েক ডজন ‘গাছ হত্যার’ অভিযোগ উত্থাপন করেছে। তাদের ভাষ্য, ভারত ‘প্রকৃতির ওপর সন্ত্রাস’ চালিয়েছে।
পাকিস্তানের আকাশসীমায় ঢুকে ভারতের বিমান হামলার পরদিন বুধবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) সকালে নিজেদের সীমানায় দুটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত ও অভিনন্দন বর্তমান নামের এক পাইলটকে আটক করে পাকিস্তান। ’৭১ পরবর্তী সময়ে প্রথমবারের মতো পাল্টাপাল্টি বিমান হামলায় দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে শুরু করে। বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমনে সদিচ্ছার প্রতীক হিসেবে আটক অভিনন্দনকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানান। শুক্রবার রাত নয়টার কিছু পরে ওই পাইলটকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে হস্তান্তর করে পাকিস্তান। তারা শুরু থেকেই বলছে, আটক পাইলট অভিনন্দনকে ফেরত দিয়ে তারা শান্তি প্রতিষ্ঠার বার্তা দিতে চায়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দাবি, শান্তির বার্তা পৌঁছে দিতে ‹অভিনন্দনকে প্রতীক হিসেবে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তবে ভারতের দাবি, জেনেভা কনভেনশনের ভয়ে পাকিস্তান বাধ্য হয়ে তাকে ফেরত দিতে সম্মত হয়েছে। এদিকে কূটনৈতিক সূত্রে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো খবর দেয়, সউদী আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ওই পাইলটকে ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসলামাবাদ।
কে কার কয়টি বিমান ধ্বংস করেছে, তা নিয়েও রয়েছে মতভিন্নতা। পাকিস্তানের দাবি, ২৬ ফেব্রুয়ারির ভারতীয় অভিযানের পর ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে বিমান হামলা চালিয়েছে তারা। সেখানে তাদের ধাওয়া করে ভারতীয় জঙ্গি বিমান। পাকিস্তান দাবি করে, ওই বিমানযুদ্ধে তারা ভারতের দুইটি বিমান ভূপাতিত করেছে, যাদের একটি পড়েছে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে ও অপরটি ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে। পাকিস্তান প্রথমে দুইজন ভারতীয় বৈমানিককে আটকের কথা বললেও পরে তারা জানায়, একজন ভারতীয় বৈমানিক তাদের হাতে আটক হয়েছে। সেসময় ভারতীয় বিমান বাহিনীর এয়ার ভাইস মার্শাল আরজিকে কাপুর বলেছিলেন, তাদের একটি বিমান ভূপাতিত হয়েছে, যার বৈমানিক পাকিস্তানের হাতে আটক রয়েছে। সংশ্লিষ্ট বৈমানিক অভিনন্দন বর্তমানকে গত পয়লা মার্চ মুক্তি দেয় পাকিস্তান। কাপুর দাবি করেছিলেন, ভারতীয় মিগ টোয়েন্টি ওয়ান জঙ্গি বিমানের হামলায় পাকিস্তানের একটি এফ সিক্সটিন বিমান ভূপাতিত হয়েছে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের ভেতর। কিন্তু পাকিস্তান এবার সেই ভারতীয় দাবিকে অস্বীকার করে।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি বিমান হামলার দাবি নাকচ করে দেয় দিল্লি।পাকিস্তানের দাবি, তারা ছয়টি লক্ষ্যবস্তুকে টার্গেট করে দিনের আলোতে ভারতের মধ্যে ঢুকেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেগুলোতে হামলা চালায়নি। বরং খালি স্থানে আঘাত হেনেছে। ভারত পাকিস্তানের এই দাবি অস্বীকার করে বলেছে, ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রতিরোধের কারণেই পাকিস্তানের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তবে এয়ার ভাইস মার্শাল কাপুর স্বীকার করেছেন, পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বোমা ভারতীয় সেনা স্থাপনার প্রাঙ্গণেই নিক্ষিপ্ত হয়েছে। তবে এতে সামরিক স্থাপনার কোনও ক্ষতি হয়নি।
কেবল হামলা নয়, হুমকিতেও যুদ্ধ-বাস্তবতা জারি রেখেছে দুই পক্ষ। পুলওয়ামার হামলার পরই নরেন্দ্র মোদি হুমকি দেন, পাকিস্তানে তিনি আক্রমণ করবেন। সে সময়ই পাল্টা হুমকি দিয়ে ইমরান খান এক ভিডিওবার্তায় বলেন, ‘যদি এই হুমকি সত্যি হয়ে থাকে তবে লিখে রাখুন, পাকিস্তান বসে থাকবে না, প্রতিহত করা হবে।’ তিনি বলেন, তেমনটা ঘটলে পাকিস্তানের সামনে আর কোনও পথ খোলা থাকবে না। ২৬ তারিখ পাকিস্তানের মাটিতে হামলার পর মোদি দেশের সেনাবাহিনীকে স্বাধীন পদক্ষেপ নেওয়ার এখতিয়ার দিয়ে তা সদর্পে ঘোষণা করেন। পাকিস্তানের তরফ থেকে দেওয়া হয় পরমাণু হামলার পরোক্ষ ইঙ্গিত। পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া সংস্থা এনএসসির বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের পর এক বিবৃতিতে ইমরান খান নেতৃত্বাধীন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ জানায়, পাকিস্তান জানান দিতে চায় যে তারা তাদের জনগণকে রক্ষা করতে সক্ষম। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সংলাপের কথা বারবার সামনে আনা হলেও এর সমান্তরালে বারবার বলা হয়েছে, তারাও ভারতকে উচিত শিক্ষা দিতে সক্ষম।
কানাডাভিত্তিক গ্লোবাল রিসার্চের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ২৮ ফেব্রুয়ারি নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনা বাড়তে দেখা গেছে। উভয় পক্ষই সীমান্তে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছে। মোতায়েন করেছে অতিরিক্ত সেনাবল ও সামরিক সরঞ্জাম। সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে পারমাণবিক বোমা সংশ্লিষ্ট বাহিনীকে। ওই বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এটা মনে রাখা জরুরি যে উভয় পক্ষের সরকার ও সংবাদমাধ্যমগুলো এই সংঘাতের তথ্য প্রচারের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে। হতাহতের সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানো, উত্তেজনা বৃদ্ধিতে বিরোধী পক্ষের দোষ সামনে নিয়ে আসা এবং নিজেদের পক্ষের হতাহতের সংখ্যা ও নিজেদের দায়-দায়িত্বের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটিয়েছে দুই পক্ষই। ওই বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত দুই পক্ষের দাবি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, উভয় দেশই উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্য পরস্পরকে দায়ী করার পাশাপাশি বড় বড় হুমকিও দিয়ে যাচ্ছে। তবে কেউই পূর্ণ মাত্রায় যুদ্ধ শুরু করতে ইচ্ছুক নয়। তাছাড়া কোনও পরাশক্তিও ঘটনাকে সেদিকে যেতে দিতে আগ্রহী নয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ