পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
হঠাৎ করেই গুলির শব্দে ফুটবল খেলা ছেড়ে দিয়ে পালানো, কেমন একটা থমথমে যেন ভাব। কিছু বুঝতাম না। তাকিয়ে থাকতাম বড়দের দিকে। আব্বা, গফুর দুলাভাই, দিলদার ভাই,রেন্টু ভাই, জান মোহাম্মদ (জানু কাকা) এরকম দু’চারটা নাম শুধু মনে পড়ে। তারা আব্বার খুব ভক্ত ছিলো এবং আব্বার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আব্বার পাশাপাশি থাকতো। তাছাড়া তারা আমাদের পরিবারে খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলো।আম্মার কাছে তারা চাচি বা ভাবি বলে যে কোন আবদার করতো। তারা মুজাহিদ বাহিনীতে যোগ দিয়ে ট্রেনিং দেয়া শুরু করলো। মনে পড়ে একদিন সন্ধ্যার পর একটা গুলির শব্দ। চারিদিকে কেমন একটা আতংক ছড়িয়ে গেল। পরে জানা গেল দিলদার ভাইয়ের রাইফেল থেকে অসতর্কবশতঃ একটা গুলি হঠাৎ করে বেরিয়ে গেছে, কেউ হতাহত হয়নি। কখন কি হয় এরকম একটা আতংক বড়দের মধ্যে সবসময় লেগে থাকত।
চারিদিকে হতাশা আর আতঙ্ক। এর মধ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো “ এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা”। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষন সবার রক্তের শিরায় উপশিরায় বিদ্যুৎ গতিতে জাগিয়ে তুলতে পাকিস্তানী হানাদারদের হাত থেকে এদেশের সাড়ে ৭ কোটি বাঙ্গালীকে বাঁচাতে হবে, দেশকে স্বাধীন করতে হবে। এই ধারাবাহিকতায় রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা মুজাহিদ বাহিনীর যে দলটি গড়ে উঠেছিলো, সে দলটি শপথ নিলো পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করে দেশকে স্বাধীনতার অগ্রযাত্রায় শরিক হওয়ার। কোন এক গোপন সূত্র থেকে জানা গেল-রেলবাজার ইপিআর ক্যাম্পে কিছু অস্ত্র আসবে। অস্ত্রগুলো এসে পৌঁছালে মুজাহিদদের সেই অস্ত্রগুলো সরবরাহ করা হবে। আব্বার নেতৃত্বে মুজাহিদরা রেল বাজার ইপিআর ক্যাম্পে জড়ো হয়। সবার মধ্যে একটা উত্তেজনা। এই চলে আসবে অস্ত্র, এভাবে ৩ দিন পার হয়ে গেল। মুজাহিদদের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা, কখন আসবে অস্ত্র আর কখন ঝাপিয়ে পড়বে সম্মুখ যুদ্ধে। ৪ দিন পর অস্ত্র এসেছিলো (পরে জানা যায় চাপাইনবাবগঞ্জ থানায় অস্ত্র ভান্ডার ভেঙ্গে এই অস্ত্রগুলো আনা হয়েছিলো)। মুজাহিদ বাহিনীর দল এই অস্ত্র নিয়ে রাজশাহীকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে রাজশাহীর দিকে রওনা হয়ে যায়। উদ্দেশ্য পাকিস্তানী বাহিনীকে কোনভাবেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের দিকে ঢুকতে দেয়া হবেনা। মুক্তিযোদ্ধারা মেইন রোডের পাশ দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। রাজাবাড়ী পার হয়ে চাপালের কাছে গিয়ে রাত্রি নেমে আসে। দলটি তখন খুবই ক্ষুধার্ত। গ্রামের লোকজন খবর পেয়ে চুপি চুপি এসে খাবার দিয়েছিলো। আব্বা যখন কথাগুলো বলছিলো তখন গফুর দুলাভাই আব্বাকে আরো একটি ঘটনা মনে করিয়ে দিলো। সবার খাওয়া শেষে একজন বৃদ্ধ মানুষ চাপাল থেকে ১০ মাইল দূর প্রেমতলী থেকে খাবার নিয়ে এসেছিলো। যখন শুনলো যোদ্ধাদের খাওয়া হয়ে গেছে এখন আর খাওয়া যাবেনা, তখন লোকটি কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো “বাবা তোমরা না খেতে পারলেও এই খাবারগুলোতে একটু হাত বুলিয়ে দাও যাতে শান্তিতে বাড়ি ফিরে যেতে পারি।”সেই রাত্রে একটু বিশ্রাম নেয়ার সময় কয়েকটি টর্চের আলো আর খটখট শব্দে কিছু লোক মেইন রোড দিয়ে এগিয়ে আসছে। এরা পাকিস্তানি বাহিনী নিশ্চিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ফায়ার শুরু করলে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আবার পেছন ফিরে রাজশাহীর দিকে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা আবার রাজশাহী ক্যান্টেম্যান্ট ও রেডিও সেন্টারের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে একগ্রুপ ক্যান্টেনমেন্টের দিকে অন্য গ্রুপ রেডিও সেন্টারের দিকে এগিয়ে যায়। আব্বা, গফুর দুলাভাইসহ একটি দল রেডিও সেন্টারের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। তাদের উদ্দেশ্য হলো- রাজশাহী রেডিও সেন্টার দখল করে পাকিস্তানী বাহিনীকে প্রতিহত করা হবে বলে ঘোষনা দেয়া। সেই সময় রেডিওতে চাকুরী করতেন আমার হবি মামা (প্রমতলী বাড়ি)। রেডিও সেন্টারে সেই সময় অনেক বিহারীও চাকুরী করতো। হবি মামার সাথে আব্বা যোগাযোগ করলে হবি মামা সহযোগিতা করতে রাজি হয়ে যান। আব্বা, গফুর দুলাভাইসহ কয়েকজন সন্ধ্যা বেলায় রেডিও সেন্টারে ঢুকে কার্যক্রম শুরু করতে যাবে এমন এক মুহুর্তে পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে এই সংবাদ পৌঁছে যায়। ফলে পাকিস্তানী বাহিনী রেডিও সেন্টার ঘেরাও করে ফেললে তারা কোন রকম পালিয়ে গেলেও, যে সমস্ত বিহারীরা রেডিওতে চাকুরী করত তারা পাকিস্তানী বাহিনীকে হবি মামার সহযোগিতার বিষয়টি জানিয়ে দেয়। সে রাতের পর হবি মামা আর কোনদিন বাড়িতে ফিরে আসেনি। অর্থাৎ তাকে সেদিনই হত্যা করা হয়েছিলো।
সেদিন রাত্রে অনেক ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিলো। দরজা জানালাগুলো বৃষ্টির ঝাপটার সাথে জোরে জোরে শব্দ হচ্ছিলো। আম্মার কান্নার শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আম্মার কান্না দেখে কিছু না বুঝে আমিও কাঁদতে লাগলাম। হঠাৎ করেই বাড়ির মেইন গেটে একটা বিকট শব্দ হলে আম্মা দৌড় দিল মেইন গেইটের দিকে আমিও পেছন পেছন দৌড়ালাম।
আম্মা গেইট খুলতেই দেখলাম আব্বা নিচে পড়ে আছে গোঁ গোঁ শব্দ করছে কোন কথা বলতে পারছেনা। আম্মা-আমি জোরে জোরে কাঁদতে লাগলাম। গফুর ভাই আব্বাকে ধরে উঠানোর চেষ্টা করছে। সেদিন রাজশাহী রেডিও সেন্টার থেকে পালিয়ে মাঠের ভিতর ভিতর রাজাবাড়ী বসন্তপুর হয়ে ৩০ কি.মি পথ ঝড় বৃষ্টির মধ্যে অস্ত্র, খাঁকি পোষাক ফেলে পালিয়ে এসেছিলো। তখন গফুর ভাইয়ের বয়স কম বলে তাকে ঝড়-বৃষ্টি বা ৩০ কি.মি. পথ পালিয়ে এসেও একেবারে ঘায়েল হয়ে যায়নি। কিন্তু আব্বার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আম্মা, গফুর ভাই আব্বাকে গরম পানি ও গরম দুধ খাওয়ালে একটু চেতনা ফিরে আসে। সে রাত্রিতেই আব্বাকে ভারত পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। শুনেছি ১৫-২০ দিন আব্বা কোন কথা বলতে পারেনি। আব্বা খবর পাঠালো আমরা ভারত চলে যাবো। সে প্রেক্ষিতে আম্মা চার ভাইবোনসহ মহানন্দা নদীর ওপারে ছয়রশিতে মুসলিম ফুপার বাড়িতে উঠলাম ভারত চলে যাব বলে। এরিই মধ্যে মোঃ মনজুর রহমান আমার ছোট চাচা এসে আম্মাকে খবর দিলো- ভারত চলে গেলে জমি-জমা বেহাত হয়ে যাবে। আম্মা চিন্তায় পড়ে গেল। আপাততঃ ভারত যাওয়া বাতিল করে ছয়রশিতেই থাকতে লাগলাম। একদিন আমাকে আমার ছোট চাচা গোদাগাড়ির বাড়িতে নিয়ে এসেছিলো। আমার মনে আছে সেদিন রাত্রে এরফান ভাই (বর্তমানে আড়ানি স্কুলের শিক্ষক) কোত্থেকে একটা হাঁস ধরে নিয়ে এসে রান্না করছিলো। পরদিন সকাল বেলায় হঠাৎ ঠা ঠা গুলির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। এরফান ভাই বলল পাঞ্চাবীরা গুলি করতে করতে আসছে। শোনামাত্রই আমি কাউকে কিছু না বলে বাড়ির পেছন দিয়ে দৌঁড়াতে থাকলাম। আমার মনে হচ্ছিল (ঠিক কিনা জানিনা আতংক হতে পারে) গুলির শব্দগুলো কানের পাশ দিয়ে যেয়ে বাঁশ ঝাড়ের গায়ে লাগছিলো। আমি ফটিক ভাইয়ের জমির উপর দিয়ে হাটপাড়া হয়ে সোজা মহানন্দা নদীর পাড়ে চলে গেলাম। হাজার হাজার মানুষ মহানন্দা নদী পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। যে নৌকাগুলো আছে তিল ধারনের ঠাই নাই। আমার বয়স তখন ৫/৬ বছর। ঐ বয়সে ঠেলাঠেলি করে নৌকায় ওঠার মত বয়স আমার ছিলনা। মহানন্দার পাড়ে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করছি এমন সময় জলিল ভাই (কমিশনার বিপ্লবের বাবা) আমাকে দেখে বললো “কিরে মনি তুই এখানে কিভাবে।” আমি বললাম “আাম্মা ছয়রশিতে আছে, আমি যাব।” এতভিড় জলিল ভাই অনেক চেষ্টা করেও কোন নৌকাতে ওঠাতে পারলোনা।
হঠাৎ দেখলাম একলোক একটা বাঁশের কঞ্চির বোঝা নিয়ে ভেসে যাচ্ছিলো মহানন্দার ওপারে যাবে বলে। আমার মনে পড়ে মহানন্দার নদীর এপার ওপার খুব বেশী দূর ছিলোনা। জলিল ভাই আমাকে ঐ কঞ্চির বোঝার উপর বসিয়ে দিলো। এরিই মধ্যে ওপারে যাওয়ার জন্য একজন মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্রসহ ঐ কঞ্চির বোঝার উপর চেপে বসলো। কঞ্চির বোঝাটি কেমন টলমল করতে লাগলো। অস্ত্রের ঘসা আমার গায়ে লাগছে, আমি ব্যাথা পাচ্ছি। তারপরও আমি খুব শক্ত করে কঞ্চির বোঝাটি ধরে রেখেছি। যে লোকটি কঞ্চির বোঝা ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিলো, সে লোকটি বোঝাটি ঠেলে নিতে পারছিলোনা। ফলে কঞ্চির বোঝাটি আস্তে আস্তে পদ্মা নদীর দিকে চলে যাচ্ছিল। পদ্মা নদীতে চলে গেলে কি হবে সেটা আমার ধারনা ছিলোনা তবে চারদিক থেকে চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। “কঞ্চির বোঝাটি ধরো ধরো।” পদ্মা নদীতে বোঝাটি চলে গেলে কি হতো সেটা আল্লাহই জানতেন। তবে এরই মধ্যে একটা নৌকা থেকে নৌকার মাঝি একটা দড়ি ছুড়ে মারলো, যে লোকটি বোঝাটি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল তার দিকে। ঐ লোকটি তাড়াতাড়ি করে দড়িটি কঞ্চির বোঝার সাথে বেঁধে দিলে কঞ্চির বোঝাটি ঐ নৌকার সাথে সাথে মহানন্দার ওপারে ভিড়লো। মহানন্দার ওপারে একলোক কঞ্চির বোঝা থেকে নামানোর সময় আমাকে একটা থাপ্পর দিয়ে বললো- তুই কঞ্চির বোঝায় উঠছিস কেন? আমি আবার কাঁদতে কাঁদতে ছয়রশিতে যেয়ে দেখি আম্মা ভীষন কান্নাকাটি করছে। এদিকে না বলে চলে আসায় আমাকে আমার ছোট চাচা এদিক ওদিক খোঁজাখুজির পর না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছয়রশিতে এসে হাজির। এখানে আমাকে দেখে ছোট চাচা বকা দিলো, না বলে চলে আসার জন্য।
আমার বাবা মোঃ আবদুর রাজ্জাক। তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বলবোনা তবে তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বললাম না এজন্য যে, এখন কে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, আর কে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা এটা নিয়ে একটা বিতর্ক শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার প্রতিযোগিতা। যাইহোক আমার বাবা ৭নং সেক্টরে মেজর গিয়াসের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন রাজশাহী জেলাসহ এবং গোদাগাড়ী থানার বিভিন্ন জায়গায় তার নেতৃত্বে বিভিন্ন অপারেশনের গল্প আমি তাঁর কাছ থেকে শুনেছি। এখন লিখতে বসে খুব আফসোস হচ্ছে এজন্য যে, আব্বা বেঁচে থাকতে যদি মুক্তিযুদ্ধের তাঁর অভিজ্ঞতার আরও কিছু শুনে নিতাম তাহলে এখন আমি এখন অনেক কিছু লিখতে পারতাম তাহলে লেখাটা হতো আরও সমৃদ্ধ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ১৯৯৫ সাল অর্থাৎ তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি গোদাগাড়ী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের কমান্ডার ছিলেন। তিনি ছিলেন গোদাগাড়ী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের প্রতিষ্ঠাতা কমান্ডার। তাঁর দেয়া মাটিতে বর্তমানে গোদাগাড়ী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অফিসটি অবস্থিত।
ব্যবস্থাপক, জনসংযোগ বিভাগ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।