পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ বই। বই পড়ে মানুষ তার জ্ঞান এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়েই এই পৃথিবীকে এতখানি উন্নত করেছে। বই মানুষের জীবনের চেতনা শক্তি। আর এই চেতনাকে জাগিয়ে রাখতে প্রয়োজন গ্রন্থাগার। ড. ওসমান গণী বলেছিলেন, আজ আমাদের হাসপাতালের থেকেও বড় বেশি প্রয়োজন গ্রন্থাগারের। আসলে বাঙালির জাতীয় চরিত্রকে মনুষ্যত্বে উন্নত করতে হলে প্রয়োজন চেতনার। আর এই চেতনার আগুন ধারণ করে আছে গ্রন্থ এবং গ্রন্থাগার। ওসমান গণী প্রায় সত্তর বছর আগে গ্রন্থাগারের অসীম প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন তা আজও সমান প্রাসঙ্গিক। বাঙালি তাঁর এই পরামর্শ গ্রহণ করেছিল বলেই হয়ত বই তার প্রাণের সম্পদ হয়ে গেছে। ঢাকার নীলক্ষেত বিখ্যাত হয়ে আছে বইপাড়া নামে। সেখানে সারাবছর বইয়ের বাজার। আর ২১-এর বইমেলা তো এখন বাঙালির জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া প্রতিটি জেলায় এবং শহরে বড় আকারে বইমেলা করে এই গ্রন্থপাঠে উৎসাহ প্রদান বই প্রেমীদের কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বাংলাদেশে গ্রন্থমেলা, গ্রন্থ প্রকাশনা ইত্যাদি বিষয় বাঙালির ঐতিহ্যকে আজও লালন করে চলেছে।
চিন্তাবিদরা বলে থাকেন, পাড়ায় পাড়ায় পাঠাগার বা লাইব্রেরি স্থাপন করা হোক, তাতে আমাদের চারিত্রিক উন্নতি হবে, তৈরি হবে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ। কিন্তু একথা শুনবে কে আর কার্যকর করবে কারা? কথায় আছে, প্রয়োজন থেকেই মানুষ তার জীবনযাত্রার নতুন পন্থা আবিষ্কার করেছে। আমাদের জীবনে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তাই আমরা অনুভব করতে পারলাম না তো পূরণ করা তো দূর অস্ত। পাড়ায় পাড়ায় নতুন করে গ্রন্থাগার স্থাপন করাতো দূরের কথা, শহরেই একটি ভালো লাইব্রেরিও আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারি না। বই আছে তো পাঠক নেই- পাঠক আছে তো বই নেই। এই হচ্ছে আমাদের বর্তমান অবস্থা।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যপূর্ণ গ্রন্থাগারসমূহের সম্পদ প্রায় বিনষ্ট হয়ে গেছে। বিভিন্ন গ্রন্থাগারের অর্ধেক দুর্লভ গ্রন্থ আজ আর পাঠযোগ্য অবস্থায় নেই। জেলা গ্রন্থাগারসমূহের অবস্থা আরও করুণ। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে জেলা গ্রন্থাগারসমূহের সংস্কার হলেও গ্রন্থাগারের ভাগে তার উন্নতির জন্য সামান্য পয়সাও খরচ করা হয় না। কেন এই বৈষম্য? এ কি উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়? গ্রন্থাগারের প্রয়োজন কি তাহলে সরকার এবং দেশের তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের কাছে ফুরিয়ে গেল? কোনোভাবেই কি আমরা ফিরিয়ে আনতে পারি না পুরনো দিনেরই সেই পাঠাভ্যাস। গ্রন্থাগার ভবনের উন্নতির জন্য তাকে ভেঙে আধুনিক ব্যবস্থায় সাজানো প্রয়োজন।
দেশে যত স্কুল-কলেজের গ্রন্থাগার রয়েছে সেগুলোও যদি বই কেনা এবং গ্রন্থাগার চর্চায় উৎসাহ দেখাতো তাহলে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে গ্রন্থাগারের প্রয়োজন জেগে উঠত। কিন্তু সরকারি স্কুলের যা চিত্র তাতে আমার ধারণা গত কুড়ি বছরের মধ্যে কোনো সরকারি বিদ্যালয় নতুন কোনো বই কেনেনি। ছাত্রজীবনে আমরাও স্কুলের গ্রন্থাগার ব্যবহার করতে পারিনি। বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগার নেই, কোনো কোনো স্কুল বা কলেজে থাকলেও গ্রন্থাগারিক নেই। আবার গ্রন্থাগার থাকলেও মাকড়সার জাল আর ধূলা-বালুর জন্য গ্রন্থাগারে প্রবেশ করা কঠিন হয়ে পড়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব গ্রন্থাগারে ২/৩ বছর পর খুলা হয়। দেখা যায়, অনেক বই পোকা-মাকড়ে খেয়ে নষ্ট করে ফেলছে।
কিছুদিন আগেও সিলেটে কোনো একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম। তালাবদ্ধ গ্রন্থাগার দেখে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করলাম। বইয়ের সংখ্যা খুবই কম দেখে কারণ জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বলেন, আমরা যে বই কিনব তা রাখব কোথায়, আর পাঠকই বা কই? গ্রন্থাগারিক নেই, রক্ষণাবেক্ষণ করবে কে? তার ওপর সরকারি সাহায্যও নাকি পাওয়া যায় না। একজন প্রধান শিক্ষকের মুখে এ কথা শুনে আমি বিস্মিত হই! কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান থেকে ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করলে সরকার বাধ্য হবে গ্রন্থাগারের জন্য অর্থ সাহায্য প্রদান করতে। এ ব্যাপারে সরকার বা শিক্ষামন্ত্রীর কার্পণ্য আমরা লক্ষ করি না। তারাতো এসব ব্যাপারে উদার। তাছাড়া এখানে আরেকটি কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগারের জন্য বই কেনা হয় না, অথচ প্রতিবছর ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে লাইব্রেরির জন্য ফি নেয়া হয়। তাহলে আদায়কৃত এ টাকা কোন খাতে ব্যয় করা হয়। সরকারের ওপর নির্ভর না করেও তো অনেক টাকার বই বছরে কেনা যায়। তাহলে লাইব্রেরির জন্য বই কেনা হচ্ছে না, এই অব্যবহৃত টাকার হিসাব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ কি দিতে পারবেন? কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতি তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনোভাবের ফলেই স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লাইব্রেরি ব্যবস্থা আজ ভেঙে পড়েছে। ছোটবেলাতে যদি ছাত্রদের মধ্যে লাইব্রেরি ব্যবহার করা, বই পড়ার মনোভাব গড়ে না ওঠে তাহলে বড় হলে তাদের কাছ থেকে বই কেনার কথা আমরা আশা করতে পারব কি?
আমরা যদি আগামীদিনের জন্য সুস্থ পরিবেশ মেধা এবং মননের বিকাশে বই এবং গ্রন্থাগারের প্রয়োজনকে অনুভব করে উপযুক্ত ব্যবস্থা এবং প্রতিকারের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে প্রস্তুত হই, তাহলে তা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে। বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির দিনেও গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা বিন্দুমাত্র কমেনি বরং অনেক বেশি বেড়ে গেছে। এই তথ্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এক একটি শহরে গ্রন্থাগারকে কেন্দ্র করে ইনফরমেশন সেন্টার গড়ে উঠতে পারে। পড়াশোনায় নতুন দিগন্ত খুলতে পারে। শিক্ষা এবং সামাজিক ক্ষেত্রে সুস্থ পরিবেশ গড়ে উঠতে পারে গ্রন্থাগার স্থাপন এবং বই পাঠের অভ্যাস গড়ার মাধ্যমে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।