চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির সূচনাতেই বৈচিত্রসহ ভাষা সৃষ্টি করেন ও মানবজাতিকে ভাষা শিক্ষাদানের মাধ্যমে অন্যান্য জাতির উপর মর্যাদা প্রদানের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্বদান করেন। মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হলো ভাষা। ভাষার মাধ্যমেই মানুষ প্রতিক‚লতাকে জয় করে মানবতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। ভাষা প্রবাহিত হয়ে চলে মানুষের মুখে মুখে- মানুষেরই প্রয়োজনে। আবার কোন কারণে ভাষা যখন মানুষের প্রয়োজন পূরণে ব্যর্থ হয়েছে, তখনই তার ব্যবহার হ্রাস পেয়েছে। এভাবে সংস্কৃত, গ্রীক, ল্যাটিন ভাষা আজ ইতিহাসের যাদুঘরে স্থান করে নিয়েছ। তবে বর্তমান পৃথিবীতে ছয় হাজারের বেশি ভাষা রয়েছে। এর মাঝে ১১ টি সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা হলো চীনা, ইংরেজী, হিন্দি, স্পেনীয়, আরবি, পর্তুগিজ, রুশ, বাংলা, জাপানি, জার্মানি ও ফরাসি। বিভিন্ন জাতি ভাষা শিক্ষা ও তার সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে নিজেদের মর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি মানবাজাতির কল্যাণে এগিয়ে যাচ্ছে। আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে আসমান-যমিন, দিবা-রাত্রি, মানুষ ও জীব-জন্তুর ন্যায় ‘ভাষা’ সৃষ্টিরও উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “দয়াময় আল্লাহ, শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন। সৃষ্টি করেছেন মানুষ। শিক্ষা দিয়েছেন ভাষা” (৫৫: ১-৪)। আল্লাহ তাআলা অন্যস্থানে ইরশাদ করেন, “তার আরও এক নিদর্শন হচ্ছে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য নির্দশনাবলী রয়েছে” (৩০: ২২)। আল্লাহ তাআলা আদি পিতা হযরত আদম আ. কে সৃষ্টি করার পর পরই তাকে ভাষাসহ বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান শিক্ষাদানের মাধ্যমে ফিরিশতা ও জ্বানী জাতির উপর সম্মান ও মহত্ত্ব দান করেন। আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “আর আল্লাহ তাআলা শিখালেন আদমকে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীর নাম। তারপর সে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীকে ফেরেশেতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। অতঃপর বললেন, আমাকে এগুলোর নাম বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক”(২:৩১)।
আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রত্যেক সৃষ্টিজীবের জন্য ভাষা নির্ধারণ করেছেন এবং তার শুদ্ধ চর্চার মাধ্যমে মর্যাদা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করেছেন। কেননা প্রত্যেক ভাষাই মহান রাব্বুল আলামিনের অন্যতম নির্দশন। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে প্রত্যেক ভাষাভাষীর নিকট তাদের নিজ নিজ ভাষায় প্রতিনিধি প্রেরণ করেছেন। যেন তারা স্বজাতির ডাকতে পারেন তাদের সৃষ্টিকর্তার দিকে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে,“আমি সব রাসূলকেই তাঁেদর স্বজাতির ভাষাভাষীর নিকট প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে (আমার বাণী) স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারে”(১৪:৪)। আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক জাতির স্বীয় মাতৃভাষাকে যথাযথ মর্যাদা প্রদান করে নিজ নিজ জাতির নিজস্ব ভাষায় আসমানি কিতাবগুলো নাযিল করেছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, প্রধান প্রধান চারটি আসমানি কিতাবের মধ্যে হযরত মূসা আ. এর প্রতি ‘তাওরাত’ হিব্রু ভাষায়, হযরত ঈসা আ. এর প্রতি ‘ঈঞ্জিল’ সুরিয়ানি ভাষায়, হযরত দাউদ আ. এর ‘যাবুর’ ইউনানি ভাষায় এবং শেষ নাবী হযরত মুহাম্মদ সা. এর প্রতি ‘কুরআন’ আরবি ভাষায় নাজিল করা হয়।
আল্লাহ তাআলা হযরত সুলায়মান আ. কে অন্যান্য প্রাণীর ভাষা শিক্ষাদানের মাধ্যমে মানবজাতির মর্যাদা বৃদ্ধি ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি খেচর-ভূচর সবকিছুরিই ভাষা বুঝতে পারতেন। এটা ছিল তাঁর প্রতি মহান আল্লাহর প্রকাশ্য অনুগ্রহ। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,“সুলাইমান দাঊদের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। বলেছিলেন, হে লোকসকল, আমাকে উড়ন্ত পক্ষীকুলের ভাষা শিক্ষা দেয়া হয়েছে এবং আমাকে সবকিছু দেয়া হয়েছে। নিশ্চয় এটা সুস্পষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব”(২৭: ১৬)। কেননা আল্লাহ তাআলা মানব জাতির পাশাপাশি অন্যান্য সৃষ্ট জীবকেও ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষের ন্যায় আকাশের ফেরেস্তা, জীন ও অন্যান্য সৃষ্টি এবং উড়ন্ত বিহঙ্গপাল সকলেই তাদের নিজ নিজ ভাষা ও অভিব্যক্তির মাধ্যমে নিরন্তনভাবে আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা প্রকাশ করে মর্যাদা বৃদ্ধি করছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন: “তুমি কি দেখনা যে, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যারা আছে, তারা এবং উড়ন্ত পক্ষীকুল তাদের পাখা বিস্তর করতঃ আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষনা করে? প্রত্যেকেই তার যোগ্য এবাদত এবং পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা ও পদ্ধতি জানে” (২৪:৪১)। অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “সপ্ত আকাশ ও পৃথিবী এবং এগুলোর মধ্যে যা কিছু আছে সমস্ত কিছুই তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। এবং এমন কিছু নেই যা তার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না। কিন্তু তাদের পবিত্রতা, মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না। নিশ্চয় তিনি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ”(১৭:৪৪)।
আল্লাহ তাআলা এক একটি জাতি গোষ্ঠি কে তাদের ভৌগলিক ভিন্নতার কারণে বিশেষ বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী করেছেন, সে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করতে হলে তাদের ভাষা জানা প্রয়োজন। আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুন “বায়তুল হিকমা” নামক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আল-কুরআন ও হাদিসের জ্ঞান আহরণের পাশাপাশি অন্যান্য জাতি গোষ্ঠির গবেষণাগুলোও নিজস্ব ভাষায় অনুবাদের ব্যবস্থা করেন, আর এর দ্বারা মুসলিম মনীষীগণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অবদান রেখে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বর্তমান যুগকে বলা হয়ে থাকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ, এ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগও বিভিন্ন ধরণের ভাষার প্রয়োগ হচ্ছে। যেমন কম্পিউটার পরিচালিত হয়ে থাকে প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ দ্বারা। যে জাতি এ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভাষা রপ্ত করে সঠিকভাবে তাদের ব্যবহার করছে, সে জাতিই উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করছে এবং অন্যান্য জাতি গোষ্ঠির উপর মর্যাদা ও প্রভাব প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হচ্ছে।
আল্লাহ তাআলার অন্যতম সৃষ্টি ও নিদর্শন হচ্ছে বাংলা ভাষা, রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে ও ভাষার মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার জন্য বাঙালীজাতি ১৯৫২ সালে জীবন দিয়ে বিশে^র বুকে নজির স্থাপন করে। তাই আসুন বাংলা ভাষার শুদ্ধ চর্চা করি, শিক্ষার প্রতিটি স্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করি, অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠির লব্ধ জ্ঞান বাংলায় ভাষান্তর করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে সকল ভাষার উপর মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।