পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’ নামের বইটি সারা বিশ্বে পরিচিত। এটি একটি সংকলন গ্রন্থ। বইটির সংক্ষিপ্ত নাম ‘গিনেস বুক’। গিনেস বুক পৃথিবীর যাবতীয় বিষয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ খতিয়ান। এতে বিভিন্ন ধরনের অসংখ্য রেকর্ডের বিবরণ রয়েছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা মানুষ কে, সবচেয়ে বেঁটেই বা কে, কোন প্রাণি সবচেয়ে দ্রুত দৌড়াতে পারে, কোন পাখি সবচেয়ে বড়, কোনটি সবচেয়ে ছোট-এসব প্রশ্নের জবাব মিলবে এই বইতে। অর্থাৎ পৃথিবীতে যত খুঁটিনাটি রেকর্ড রয়েছে, তার সবকিছুর হদিস পাওয়া যায় এ বই থেকে। পৃথিবীতে যাবতীয় ঘটনা ও বিষয়ের সাম্প্রতিকতম রেকর্ডগুলো নিয়ে প্রতি বছর বইটির নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৯৫৫ সালের ২৭ আগস্ট এ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়।
গিনেস বুক গ্রন্থটির শুরু হয়েছিল ১৯৫১ সালের ১০ নভেম্বর। স্যার হিউজ বিভের নামে এক আইরিশ ওইদিন আয়ারল্যান্ডের ওয়েক্সফোর্ড জঙ্গলে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। তিনি গোল্ডেন রোভার নামে একটি পাখির খোঁজ চালাচ্ছিলেন। কিন্তু সারা বন ঘুরেও এ পাখির দেখা পেলেন না। বাড়ি ফিরে বন্ধুদের সঙ্গে এ পাখি নিয়ে তিনি আলোচনায় বসলেন। এটি ইউরোপের দ্রুততম পাখি কিনা তা নিয়ে এক পর্যায়ে তর্ক বেঁধে গেল। কিন্তু সঠিক তথ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হলো না।
১৯৫৪ সালের আগস্ট মাস। এবারে বিতর্ক হলো গ্রাউস পাখি গোল্ডেন রোভারের চেয়ে দ্রুতগামী কিনা। কিন্তু এবারেও যথারীতি কোনো মীমাংসা হলো না। কেননা, এসব তথ্য জানার জন্য সে সময় রেকর্ডের ওপর কোনো বই ছিল না। এ ঘটনা থেকে স্যার হিউস অনুভব করলেন, এমন একটি বই দরকার, যার মধ্যে এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে। ওই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর স্যার হিউস, নরিস এবং রস হুটিয়ান এমন বই প্রকাশের ব্যাপারে আলোচনা করেন।
নরিস এবং রস হুটিয়ান সে সময় একটি এজেন্সি চালাতেন। এজেন্সির কাজ ছিল নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহে রাখা। গিনেস বুকের তথ্য সংগ্রহের জন্য এ দু’জনের সহায়তায় স্যার হিউস একটি দফতর চালু করলেন। শুরু হলো গিনেস বুকের জন্য তথ্য সংগ্রহের কাজ। ১৯৫৫ সালের ২৭ আগস্ট ১৯৮ পৃষ্ঠার প্রথম গিনেস বুক প্রকাশিত হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে যায় অভিনব এ রেকর্ড সংকলনটি। সে বছর ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের আগে এ বইটির কাটতি ছিল সবচেয়ে বেশি।
১৯৫৬ সালে গিনেস বুকের মার্কিন সংস্করণ প্রথম প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৬২ সালে ফরাসি এবং ১৯৬৩ সালে বইটির র্জামান সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৪০টি ভাষায় গিনেস বুক প্রকাশিত হয়। জ্ঞানের ভান্ডার বিশ্বকোষ বিশ্বজগতের জ্ঞান- বিজ্ঞানের তথ্য সংবলিত বই হল বিশ্বকোষ। ইংরেজি এনসাইক্লোপিডিয়া শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘এনক্লাইক্লোপেইডিয়া’ থেকে এসেছে। যার অর্থ বিদ্যাশিক্ষা চক্র বা পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভের সামগ্রিক ব্যবস্থা। অভিধানের মতোই বিশকোষে ব্যবহৃত নিবন্ধগুলো বর্ণনানুক্রমিকভাবে সাজানো থাকে। তাই বলে বিশ্বকোষ আর অভিধান এক নয়। অভিধানে শব্দার্থ, ব্যুৎপত্তি প্রভৃতির বর্ণনা থাকে। অন্যদিকে, বিশ্বকোষে ব্যবহৃত নিবন্ধগুলো প্রবন্ধকারে উল্লেখ থাকে।
পৃথিবীর সব উন্নত ভাষারই বিশ্বকোষ লেখা হয়েছে। যেমন বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ফারসি ইত্যাদি ভাষার বিশ্বকোষ। বিশ্বকোষ দু’ধরনের হয়ে থাকে। সাধারণ বিশ্বকোষ এবং বিশেষ বিশ্বকোষ। জ্ঞানের সমস্ত শাখার যাবতীয় পরিচয় যে গ্রন্থে সংক্ষেপে দেওয়া থাকে তাকে বলে সাধারণ বিশ্বকোষ এবং কোনও এক বা একাদিক একই জাতীয় শাখায় বিস্তারিত পরিচয় যে গ্রন্থে লিপিবদ্ধ থাকে তাকে বিশেষ বিশ্বকোষ বলা হয়। বিশ্বকোষের প্রচলন কবে এবং কীভাবে হল, সে প্রশ্নের সঠিক জবাব পাওয়া কঠিন। আজ থেকে প্রায় ৩ হাজার বছর আগেও বিশ্বকোষ তৈরি হয়েছিল বলে জানা যায়। প্রাচীন গ্রিসে প্লেটোর দুই শিষ্য স্পিউস্পিসে ও অ্যারিস্টেস্টল এবং রোমের পন্ডিত মার্কাস টেরন্টিয়াস ভ্যারো বিশ্বকোষ রচনা করেন বলে জানা যায়। প্লিনি দি এলভার (২৩-৭০)-এর সুবৃহৎ ৩৭ খন্ডে লেখা ন্যাচারাল হিস্ট্রিকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্বকোষ বলা হয়।
এই গ্রন্থে ওই সময়ে গ্রিকদের কয়েকশো গ্রন্থাকারে লেখা থেকে সংগৃহীত বহু তথ্য এবং কাহিনী ছিল। আধুনিক বিশ্বকোষ সংকলনের ইতিহাস শুরু হয় উনিশ শতকে। অর্থাৎ মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পর।
ইংরেজি ভাষার প্রথম বর্ণনানুক্রমিক রচনা করেন জন হ্যারিস (১৬৬৭-১৭১৯)। তাঁকে আধুনিক বিশ্বকোষ রচয়িতার জনক বলা হয়। বাংলা ভাষায় কয়েকটি সাধারণ ও বিশেষ বিশ্বকোষ প্রকাশিত হয়েছে। বাঙালি পন্ডিতরা উনিশ শতকের দিকে এধরনের বই লেখার দিকে উৎসাহী হন।
উইলিয়াম কেরির পুত্র ফেলিকস কেরিকে বাংলা ভাষার প্রথম বিশ্বকোষ লেখক বলা হয়। তিনি এনসাই ক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার অনুসরণে বিদ্যাহারাবলী নামে বিশকোষের দু’টি খন্ড প্রকাশ করেন। প্রথম খন্ড ১৮১৯ সালে এবং দ্বিতীয় খন্ড ১৮২১ সালে প্রকাশিত হয়। বর্ণনানুক্রমিক পদ্ধতিতে রচিত প্রথম বাংলা বিশ্বকোষ হচ্ছে ভারকোষ। ১২৮৯ থেকে ১২৯৯ বঙ্গাব্দের মধ্যে ৩ খন্ডে এটি প্রকাশিত হয়। বাংলা ভাষার এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বড় আকারের বিশ্বকোষ হচ্ছে নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত ‘বিশ্বকোষ’ নামের বইটি। ১২৯৩ থেকে ১৩১৮ বঙ্গোব্দের মধ্যে ২২ খন্ডে এটি প্রকিিশত হয়। এরপরও আরও বেশ কিছু সাধারণ এবং বিশেষ বিশ্বকোষ প্রকাশিত হয়েছে।যেমন, ডিকশনারি শব্দের সঙ্গে আমরা প্রায় সবাই কম-বেশি পরিচিত। পৃথিবীতে সারা বছর যত বই বিক্রি হয় তার একটা বিরাট অংশ হল ডিকশনারি। ইংরেজি ডিকশনারি শব্দটির ল্যাটিন শব্দ ‘ডিকশনারিম’ থেকে এসেছে। যার অর্থ শব্দভান্ডার। ইংরেজি এই শব্দটি বাংলা ভাষার ‘অভিধান’ নামে সুপরিচিত। এটি হল কোনো ভাষার শব্দসমূহের বর্ণানুক্রমিক তালিকা। পৃথিবীতে নানা ভষার অভিধান আছে।
ডিকশনারির প্রচলন কবে হলো, এ প্রশ্নের সঠিক জবাব পাওয়া কঠিন হলেও ধারণা হলো- যখন থেকে মানব সভ্যতার সূচনা হয়েছিল তখন থেকেই অভিধান লেখার সূত্রপাত। মজার কথা হচ্ছে, যখন কাগজ ও ছাপাখানা আবিষ্ক্রত হওয়া দূরে থাক, ধ্বনিলিপির উদ্ভব পর্যন্ত হয়নি, সে সময়েও অভিধান তৈরি হয়েছিল। প্রাচীন সভ্যতার সূতিকাগার অ্যাসিরীয় ও ব্যাবিলনের কাদা-মাটির ফলকে বিশ্বের প্রথম অভিধান লিপিবদ্ধ হয়। এটি খ্রিস্টের জন্মের প্রায় হাজার বছর আগের কথা। তারপর অভিধান রচনার প্রচেষ্টা চালান গ্রিক পন্ডিতরা এবং পরে রোমান পন্ডিতগণ। আর আধুনিক অভিধান সংকলনের ইতিহাস শুরু হয় উনিশ শতকে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পর।
বাংলা ভাষার প্রথম অভিধান হচ্ছে পর্তুগিজ এবং পর্তুগিজ ম্যানুয়েল-দ্য-অ্যাসসস্পাসাঁও রচিত বাংলা-পর্তুগিজ এবং পর্তুগিজ-বাংলা শব্দকোষটি। এই শব্দকোষটি পর্তুগিজ উচ্চারণ রীতি অনুযায়ী ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগালের রাজধানী লিসবন শহর থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলা অক্ষরে মুদ্রিত প্রথম অভিধান হচ্ছে হেনরি পিটস করস্টার রচিত ইংরেজি-বাংলা অভিধানটি। এটি দুই খন্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। একটি ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে এবং অপরটি ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ‘ফেরি অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড’ নামের ছাপাখানা থেকে।
অভিধান একভাষী, দ্বিভাষী এবং কখনও কখনও বহুভাষী হতে পারে। পৃথিবীর সকল সভ্য ভাষারই একভাষী এবং দ্বিভাষী অভিধান রয়েছে।
বহুভাষী অভিধানের সংখ্যা খুবই কম। বাংলা ভাষারও একভাষী, দ্বিভাষী অভিধান রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ ও ভারত থেকে বাংলা এবং ইংরেজি ভাষার বহু একভাষী এবং দ্বিভাষী অভিধান প্রকাশিত হয়েছে। ইংরেজি ‘অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি-কে পৃথিবীর সেরা অভিধান বলা হয়। বৃহৎ ১৩টি খন্ডেপ্রকাশিত এই অভিধানটি প্রকাশ করেছে ‘অক্সফোর্ড ইউনির্ভাসিটি’। বহুভাষী অভিধানের দৃষ্টান্ত হচ্ছে H.L.Dvesey-Gi 21 Language Dictonary|। পৃধিবীর সব ভষারই অভিধানের সংখ্যা নগন্য নয়। একই ভাষার ভিন ভিন্ন সংকলন বা প্রতিষ্ঠান ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামায় ছোট, বড়, মাঝারি আকারে অভিধান সংকলন করে থাকে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।