Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভয়ঙ্কর অপরাধে কিশোররা

হত্যা, ধর্ষণ ও অপহরণসহ গ্যাং পরিচালনা

আবদুল্লাহ আল মামুন | প্রকাশের সময় : ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০২ এএম

রাজধানীসহ সারাদেশেই ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর ও উঠতি বয়েসী তরুণরা। সময়ের সাথে সাথে অপরাধের ধরণ ও ভয়াবহতার মাত্রা উদ্বেগজনকহারে বেড়ে চলছে। এসব কিশোর-তরুণরা আগে ছোট-খাটো অপরাধে করলেও এখন হরহামেশা হত্যা ও ধর্ষণের মতো বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। কখনো তুচ্ছ ঘটনায় বাবা-মা ও সহপাঠী-বন্ধুদেরও খুন করতে দ্বিধা করছে না তারা। এর বাইরে এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন গ্যাংয়ের হয়ে আধিপত্য বিস্তারসহ ভাড়ায় খুনোখিুনিতে কিশোরদের জড়িত হওয়ার ঘটনা ঘটে চলছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের শিথিলতা, সন্তানকে সময় না দেয়া, সঙ্গদোষ, সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়, স্বল্প বয়সে স্মার্টফোনসহ উন্নত প্রযুক্তির নাগাল পাওয়া, প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত অর্থ পাওয়া, বাছ-বিচার ছাড়া সন্তানদের আবদার পূরণ, অপরাধ করেও শাস্তি না পাওয়াসহ যথাযথ পর্যবেক্ষণের অভাবে কিশোর ও উঠতি বয়সের তরুণরা ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর শ্যামপুরের মৃত্যুর পর এক নবজাতকের লাশ মাটি চাপা দেওয়া থেকে উঠিয়ে মাথা বিচ্ছিন্ন করেছে ৬ কিশোর-তরুণ। ঘটনার পর রুদ্র কুর্মী (১৮), সুভঙ্কর চন্দ্র রায় (১৫), বিপুল দাস (১৪), রণক দে (১৩) ও বিজয় দে (১৫) নামে পাঁচজনকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় শুভ (২২) নামে এক তরুণ পলাতক রয়েছে। শ্যামপুর থানার এসআই আমিরুল ইসলাম বলেন, তান্ত্রিক সাধনা করতে গিয়ে ওই কিশোর-তরুণরা নবজাতকটির লাশ তুলে মাথা বিচ্ছিন্ন করার মতো বর্বর কাজ করেছে বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে।
সিলেটের গোয়াইনঘাটে প্রেমিকাকে নিয়ে ঘুরতে গিয়ে চা বাগানের ভেতরে আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পরে তরুণ আবরাবুল হক (১৯)। বিষয়টি দেখে ফেলে স্থানীয়রা তাদেরকে আটক করে দু’জনের পরিবারকে ডেকে পাঠায়। পরে একই এলাকার সোয়াব আলী কালা মিয়াসহ কয়েকজন গিয়ে আবরাবুলের পরিবারকে ডেকে এনে। এ ঘটনায় আবরাবুলের পরিবার ছেলেকে শাসিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ আবরাবুল কালামিয়ার ওপরে প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এদিকে, কালামিয়াকে শায়েস্তা করাসহ উচিত শিক্ষা দিতে তার ৬ বছরের শিশু সন্তান সোহেলকে গলা কেটে হত্যা শেষে লাশ জঙ্গলে ফেলে দেয় আবরারুল। গত ৬ ফেব্রুয়ারি গোয়াইনঘাট উপজেলার ফেনাইকোনা এলাকায় এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। গত শুক্রবার সিলেটের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে শিশু সোহেলকে জবাই করে হত্যার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেয় সে। ঘাতক আবরাবুল গোয়াইনঘাটের ফেনাইকোনা গ্রামের নুর উদ্দিনের ছেলে।
অপরাধ ও আইন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞতরা বলেন, কিশোর ও উঠতি তরুণরা সাধারণত, চুরি, পকেটমার, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, অপহরণ, মাদক ব্যবসা, অবৈধ অস্ত্র বহন ও ব্যবহার, গাড়ি চুরি, হত্যাপ্রচেষ্টা ও বোমাবাজিসহ ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মতো বড় বড় অপরাধ করছে। এছাড়া জুনিয়র-সিনিয়র দ্ব›দ্ব ও আধিপত্য বিস্তার, কিশোর গ্যাং তৈরি ও এলাকাভিত্তিক ভাড়ায় ব্যবহার ছাড়াও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মদদে খুন-গুমসহ ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
কিশোর সন্ত্রাসীদের নিয়ে ২০১০ সালে একটি তালিকা তৈরি করে ঢাকা মহানগর পুলিশ। ওই তালিকায় রাজধানীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় সক্রিয় কিশোর সন্ত্রাসীদের ৫১৬ জনের নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিল। তালিকা অনুযায়ী ওয়ারী অঞ্চলে ১৪৪, মিরপুর অঞ্চলে ১০৬, মতিঝিল অঞ্চলে ৭৫, রমনা অঞ্চলে ৫১, লালবাগ অঞ্চলে ৩৬, তেজগাঁও অঞ্চলে ৪৬, গুলশান অঞ্চলে ৪৮ এবং উত্তরা অঞ্চলে ১০ কিশোর অপরাধীকে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
এদিকে, কিশোর অপরাধ নিয়ে ২০১৫ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কিশোর অপরাধীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। ওই গবেষণায় ১৯৯০ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত কিশোর অপরাধের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে- ১৯৯০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় কিশোর অপরাধের মোট মামলা ছিল ৩ হাজার ৫০১টি। কিন্তু পরবর্তী ১০ বছরে অর্থাৎ ২০০০ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত এ দশ বছরে মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৮৮২টি।
ওই গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ৮২টি হত্যা ও ৮৭টি নারী নির্যাতনের মামলা ছিল। যা ২০০১ থেকে ১০ সালে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১৩৮ ও ২২৪। বছর অনুসারে বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০১ সালে ঢাকায় কিশোর অপরাধের মামলা ছিল ৫১২টি। এর মধ্যে চুরির ঘটনায় ১৩৮, হত্যা মামলার ১৪ ও নারী নির্যাতনের ১৮টি। এর মধ্যে পরবর্তীতে বছরে একটি অপরাধ কমেছে তো অন্যটি বেড়েছে।
পরিসংখ্যান মতে, পাঁচ বছর পর ২০০৬ সালে মোট মামলা আনুপাতিকহারে তেমন বাড়েনি। ২০০৬ সালে মোট মামলা দাঁড়ায় ৫২৮টি। যার মধ্যে খুনের ১৫টি ও ২২টি ধর্ষণের। এ সময়ে চুরির মামলা কমে দাঁড়ায় ১১৩টিতে। এদিকে, ২০১২ সালে কিশোর অপরাধের মোট মামলা হয় ৪৮৫টি। এ সময়ে হত্যা ও নারী নির্যাতনের মামলা বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১৭ ও ৩৮টি। আর চুরির মামলা হয় ৮৫টি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শেখ তৌহীদুল ইসলাম বলেন, সাধারণত তিন কারণে কিশোররা অপরাধে জড়ায়। এর মধ্যে বস্তিবাসী ও নিম্ন আয়ের পরিবারের কিশোরেরা দারিদ্র্যের কারণে, মফস্বল থেকে বড় শহরে আসা কিশোরেরা সমাজে টিকে থাকার জন্য আর উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন- পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় সুস্থ পরিবেশ তৈরি করা গেলে কিশেরা ও তরুণদের অপরাধ প্রবণতা কমবে। তাদের মতে, শিশু বয়স থেকে সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশে বেড়ে উঠলে কিশোররা অপরাধ ও অসৎকাজে জড়াবে না। এছাড়া পরিবার তথা বাবা-মা ও অন্যান্য স্বজনদের সন্তানরা বিষয়ে খোঁজ খবর রাখতে হবে। স্কুল-কলেজের পড়াশুনার বাইরে শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহন বাড়াতে হবে। সমাজ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আ স ম আমানুল্লাহ বলেন, শুধু বিত্তবান শিশু-কিশোরদের প্রতি নজর রাখলে হবে না। তাদের পাশপাশি ছিন্নমূল শিশু-কিশোর ও তরুণদের অপরাধমুক্ত রাখতে পুনর্বাসণ এবং অপরাধে জড়িতদের যথাযথ কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করলে তাদের অপরাধমুক্ত রাখা সম্ভব হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কিশোর


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ