পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
রাষ্ট্রের সমস্ত কাজ শাসন বিভাগকে করতে হলেও মূল দায়টি থাকে আইন বিভাগের উপর। বাংলাদেশের মতো দারিদ্র্যের সাথে সর্বদা যুদ্ধরত দেশগুলিতে আইনসভার প্রভাব ব্যাপক ও বিস্তৃত। বাংলাদেশের আইনসভা তথা জাতীয় সংসদ দেশটির সমস্ত বিষয়াবলীকে নিয়ন্ত্রণ করে। আইনসভার সদস্যগণ সেকারণেই ব্যাপক প্রভাবশালী। তা সত্ত্বেও দেশটির সংসদ সদস্যগণকে উচ্চতর দক্ষতা ও যোগ্যতার অধিকারী না হলেও চলে! বাংলাদেশের আইনসভার সদস্য হতে হলে আজ শিক্ষাগত যোগ্যতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, প্রশাসনিক দক্ষতার চেয়ে ব্যবসায়িক, ক্রীড়া, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক ও শক্তি প্রয়োগের দক্ষতার পরিচয়টিকে বড় করে দেখা হচ্ছে! সেকারণেই রাষ্ট্রটির প্রতিটি সংগঠনের সদস্যদের চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকে যেকোন উপায়ে রাজনৈতিক আকাক্সক্ষাকে চরিতার্থ করা। মেধা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে কেউ রাজনীতিতে প্রবেশ করতেই পারেন, তাতে দেশটি তার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেটি চলছে তা হলো, যেকোন মূল্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা চাই-ই চাই। বৈধ-অবৈধ, সত্য-মিথ্যার বাচবিচার রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের কাছে মূল্যহীন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সম্ভব সবটুকু প্রয়োগ করে সকলেই যেন রাজনৈতিক ক্ষমতার মসনদে বসতে চাইছেন। এতে আইন বিভাগের প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থা নষ্ট হচ্ছে। আবার ক্ষমতালিপ্সুদের এই অভিলাসের কাছে রাষ্ট্রের প্রতিটি সংস্থা এবং তার জনশক্তি যেভাবে অসহায় আত্মসমর্পণ করছে তাতে রাষ্ট্রের সবগুলো প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ। সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত হওয়া স্থানীয় থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচনগুলো এই বিষয়াবলীকে সামনে নিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ‘ভূমিধস’ বিজয় অর্জন করেছে ক্ষমতায় থাকা বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ। এই বিজয়ে ৮০ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে বলে নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে দশ কোটি ভোটারের মধ্যে সাড়ে আট কোটির মতো ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে। এত বিপুল সংখ্যক মানুষ ক্ষমতাসীন দলকে কেন এভাবে সমর্থন করলো? শুধুই কি জনগণ ভোট দিয়েছে নাকি রাষ্ট্রীয় সংগঠনগুলোরও কোনো কৃতিত্ব(!) এখানে রয়েছে? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হলে কিছু তথ্য অনিবার্যভাবেই বেরিয়ে আসে।
নির্বাচনকে সামনে নিয়ে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেশকশন, গ্লোবাল নেটওয়ার্ক অফ ডমেস্টিক ইলেকশন মনিটরসসহ আন্তর্জাতিক ১৬ টি সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে ‘অগণতান্ত্রিক নির্বাচনী পরিবেশের বিরুদ্ধে’, শিরোনামের বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, ‘নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর থেকে সুশীল সমাজ, বিরোধী দল ও গণমাধ্যমের ওপর বাংলাদেশ সরকার খড়গহস্ত হয়েছে।’ এর মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সীমিত হয়ে আসছে ও নির্বাচনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এই প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৮ তারিখে নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দের পর বিরোধী দলের গাড়িবহরে হামলা হয়েছে ৩০ বার, ১৫৯টি নির্বাচনী আসনে ২০৭টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৪৩ জন প্রার্থীর ওপর হামলায় ১৩ জন গুরুতর আহত হয়েছে। বিরোধী দলের ১৭ জন প্রার্থী গ্রেপ্তার ও ২৩টি আসনে আদালতের নির্দেশে বিএনপি প্রার্থীশূন্য হয়েছে।
নির্বাচন নিয়ে প্রধান বিরোধী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বারবার অভিযোগ করে আসছিল যে, তাদের উপর সীমাহীন দমন-নীপীড়ন চলছে। এক বিবৃতিতে তথ্য-প্রমাণসহ ফ্রন্টের প্রধান দল বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী উল্লেখ করেন, ৮ নভেম্বর, ২০১৮ তারিখ তফসিল ঘোষণার পর থেকে ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮ ভোর পর্যন্ত মোট গ্রেপ্তার ১১ হাজার ৫০৬ জন, গায়েবি ও মিথ্যা মামলার সংখ্যা ৯৫৭টি। নির্বাচনের দুইদিন আগে এক দিনে বিভিন্ন জেলায় বানোয়াট মামলা দায়ের হয়েছে ৫৯টি এবং গ্রেপ্তার হয়েছে ১ হাজার ১৭৭ জন।
এসমস্ত অভিযোগের সত্যতা মেলে নির্বাচন কমিশনার মাহাবুব তালুকদারের বক্তব্যে। তিনি নির্বাচনী মাঠের বর্ণনা দিতে গিয়ে মিডিয়ার সামনে উল্লেখ করেন, ‘আমি মোটেও মনে করি না নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলে কিছু আছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কথাটা এখন একটা অর্থহীন কথায় পর্যবসিত হয়েছে।’ নির্বাচন কমিশনের এহেন কর্মকান্ডে বাংলাদেশের জনগণের কাছে এমনকি সমগ্র বিশ্বে প্রতিষ্ঠানটির পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে বা উঠেছে, বলাই বাহুল্য।
বাংলাদেশের শাসন বিভাগের অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ। এই সংগঠনটি দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। সেকারণে এর সদস্যবৃন্দকে বলা হয়ে থাকে জনগণের বন্ধু। কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান কর্মকান্ডকে কোনো মতেই জনগণের বন্ধুত্বের নিদর্শন বলে স্বীকৃতি দেয়া যায় না। আজ বাংলাদেশ পুলিশ জনগণের নিরাপত্তা নয়, দায়িত্ব নিয়েছে সরকারের ক্ষমতা রক্ষার ও অবৈধ পন্থায় নিজেদের আখের গোছানোর। এই বাহিনীর সদস্যগণ একদিকে সরকারি সমর্থক কারো অন্যায় দেখতে পান না, অন্যদিকে বিরোধী পক্ষের কেউ ‘নাশকতা’র চিন্তা (পরিকল্পনা) করলেও গায়েবি শক্তির বদৌলতে বুঝতে পারেন!
সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমকে বলা হয় কোনো রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। বিশ্বব্যাপী তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের ফলে জনগণের প্রতি এই সেক্টরের দায়কে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু প্রচার মাধ্যমের লেজুড়বৃত্তি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের ভীতকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। বিটিভির একনায়কত্বের সময় থেকে, সরকার প্রচার মাধ্যমকে দখলে নিয়েছে। পরবর্তী সময়ে প্রচার মাধ্যমের বিপ্লব ঘটলে অগণিত সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার আবির্ভাব ঘটে। মানুষ নতুন করে আস্থার জায়গা খুঁজে পায়। বিধিবাম, এই সেক্টরটি অবতীর্ণ হয় চরম দলকানা ভূমিকায়। ড. কামাল হোসেন জাতীয় বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে রাজনৈতিক আলোচনা না করতে একজন সাংবাদিকে ‘খামোশ’ বললে পরের দিনই সংবাদকর্মীরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানান। অথচ, জাতীয় নির্বাচনের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে স্বয়ং রিটার্নিং কর্মকর্তার দেয়া ভুল তথ্য (খুলনা-১ আসনে মোট ভোটারের চেয়ে ২২,৪১৯ ভোট বেশি হওয়া) প্রচার করার ‘অপরাধে’ সাংবাদিককে নির্যাতন ও গ্রেপ্তার করলেও সাংবাদিক মহল থেকে তেমন জোরালো প্রতিবাদ পাওয়া যায়নি। আজ ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলি বিভিন্ন রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে সংবাদ পরিবেশন করে। দর্শন ভিন্ন হলেও লক্ষ্য এক, এবং সেটি হচ্ছে রাজনৈতিক লিপ্সা ও অর্থনৈতিক প্রাপ্তি হাসিল। এভাবেই রাষ্ট্রের সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি প্রতিষ্ঠান স্বার্থের প্রয়োজনে নিজেদের বিকিয়ে দিয়ে জনগণকে শিকারে পরিনত করে চলেছে।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে দেশটির জনগণের কাছে হাসি-আনন্দের উপলক্ষ খুবই কম আসে। দেশটির স্বাধীনতা অর্জন, ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নোবেল পুরস্কার লাভ, ক্রিকেটে অসামাণ্য অর্জন, বিশ্বশান্তি রক্ষায় সামরিক বাহিনীর ভূমিকার মতো কয়েকটি সফলতা বাদে জাতির জন্য গর্ববোধের উপলক্ষ আসে না বললেই চলে। ক্ষণিকের জন্য হলেও স্বল্প ও পূর্ণদৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্র, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ক্রিড়াবিদগণের ক্রিড়াশৈলী উপভোগ তাদের হাসি ও বিনোদনের প্রধান উৎস। সেকারণে এই অঙ্গনের মানুষদের জনগণ অনেকটা অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে মনে করে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এই অনুকরণীয় মানুষগুলো দিনে দিনে রাজনীতির রঙে রঙিন হয়ে উঠেছেন। এই মানুষগুলো যখন রাজনৈতিক বক্তৃতার মঞ্চে এসে বলেন, আমাদের প্রচেষ্টা যদি আপনাদের সামান্য ভালোলাগার কারণ হয়, তবে ভোটটি এই প্রতীকে দেবেন তখন বাংলার এই হতভাগা মানুষগুলি আস্থা ভঙ্গের বেদনায় মুষড়ে পড়ে বৈকি।
মোটকথা, রাষ্ট্রের প্রতিটি সংগঠনের প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থার জায়গাটি ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য একদিনে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে রাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সামরিক সরকারগুলোর আমলে সে গতি আরো বৃদ্ধি পায় আর বর্তমান সময়ে তা চূড়ান্ত আকার ধারন করেছে। এই আস্থার সংকট একটি জাতির উন্নয়ন ও জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। জাতীয় নেতৃবৃন্দকে উদ্যোগ নিতে হবে জনগণের আস্থার জায়গাগুলো পুননির্মাণ করতে।
লেখক: লন্ডন প্রবাসী ও এমফিল গবেষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।