পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দেশজুড়ে চলছে চিকিৎসা নৈরাজ্য। স্বাস্থসেবা নিয়ে চলছে রসিকতা। তাই বেজায় চটেছেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সব বিভাগে শিগগিরই শুদ্ধি চালানো হবে বলে সাফ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, অপরাধ যার যার নিজস্ব বিষয়। সরকার এতে কাউকে ছাড় দেবে না। দ্রæতই স্বাস্থ্য বিভাগের সব ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে।
দেশের হাসপাতালের যা অবস্থা তাতে এমন শুদ্ধি অভিযান জরুরি হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরে ঘুষ-দুর্নীতি আর অনিয়মের বিষয়টি এখন ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। তৃতীয় শ্রেণির এক কর্মচারীর ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়ায় রয়েছে অর্ধডজন অত্যাধুনিক বাড়ি ও প্লট। এ ছাড়া নামে-বেনামে রয়েছে শত শত কোটি টাকা। এমন সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর কারণে স্বাস্থ্য খাত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সেবা বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
সরকারি হাসপাতালে এটা নেই-সেটা নেই। দুর্গন্ধ আর নোংরা পরিবেশ। বাথরুমের মেঝে ও টয়লেট অপরিষ্কার। সরকারি হাসপাতালজুড়ে কুকুর-বিড়াল ঘোরাফেরা করে। নোংরা টয়লেটের সঙ্গে রাখা হয় রোগীদের। বিছানা আর টেবিলের ওপর অবাধেই ঘুরে বেড়ায় তেলাপোকা। বিছানায় ছারপোকা গিজগিজ করে। জরুরি বিভাগের মেঝেতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ, গজ, ব্যান্ডেজ পড়ে থাকে যত্রতত্র। উপর্যুপরি দালাল চক্র, ডাক্তার কর্মচারীদের হয়রানি, অবহেলা এ যেন রোগীদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পত্রিকার পাতা খুললেই কোনো না কোনো হাসপাতালের এমন চিত্র চোখে পড়ে। প্রকাশিত সংবাদগুলোর প্রতিপাদ্য বিষয় একই থাকে। রোগীরা সেবা পাচ্ছে না। হাসপাতালে ডাক্তার থাকে না। চিকিৎসাসেবা না পেয়েই মানুষকে বাড়ি ফিরতে হয়।
সিন্ডিকেটে জিম্মি হয়ে আছে স্বাস্থ্য খাত। এখানে দুর্নীতি-অনিয়ম বেড়েই চলছে। নির্মাণ, সরবরাহ, কেনাকাটা, নিয়োগ, বদলি- সবক্ষেত্রেই চলে ঘুষ লেনদেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন হিসাবরক্ষক আবজাল মিয়াও সিন্ডিকেটের কল্যাণে শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। ভুয়া টেন্ডারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বাজেট বিভাগের সহকারী পরিচালক ডা. আনিসুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পত্রিকার খবরে জানা যায়, বিশ্বখ্যাত জাপান ব্র্যান্ড ক্যাননের অথরাইজেশন লেটার জালিয়াতি করে ৮০ কোটি টাকার মেডিকেল যন্ত্রপাতি সরবরাহের টেন্ডার বাগানোর চেষ্টা চালাচ্ছে স্বাস্থ্য খাতের একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। এই চক্রের অন্যতম হোতা এএসএল নামে একটি প্রতিষ্ঠান জাপানি ক্যাননের ভুয়া অথরাইজেশন লেটার দিয়ে এমআরআই ও সিটি স্ক্যান মেশিনসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য টেন্ডার দাখিল করেছে। স্বাস্থ্যখাতের বেহাল পরিস্থিতি নিয়ে টিআইবির অনুসন্ধানেও নানা চিত্র উঠে এসেছে।
টিআইবি এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের স্বাস্থ্য খাতের নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতি সর্বত্রই অনিয়ম-দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। এ ছাড়া যে কোনো টেন্ডার বা ছোটখাটো যে কোনো কাজের জন্যও গুনতে হয় ঘুষ। এক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয় ভুক্তভোগীদের। স্বাস্থ্য অধিদফতর, সিভিল সার্জন কার্যালয় ও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীরা এ অর্থ নিয়ে থাকেন। এ ছাড়া বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে চিকিৎসকরা ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কমিশন নিয়ে থাকেন। আর দালালরা নিয়ে থাকে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, এ খাতে অ্যাডহক চিকিৎসক ও তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে ১ থেকে ৬৫ লাখ টাকা, বদলির ক্ষেত্রে ১০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা এবং পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেন হয়। এসব ঘুষ লেনদেনের সঙ্গে মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সিভিল সার্জন কার্যালয়সহ স্বাস্থ্য খাতের প্রতিটি বিভাগের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। পত্রিকায় আরও জানলাম, হাসপাতাল থেকে শুরু করে ডায়াগনস্টিক সেন্টার সর্বত্রই দালালদের উৎপাত। হাসপাতালে ভর্তি করতে দালাল, ওয়ার্ডে বেড পাওয়া নিশ্চিত করতে দালাল, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেও দালালদের সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। পঙ্গু ও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে রোগীর জন্য ট্রলি ব্যবহার করতেও গুনতে হয় টাকা। রোগীদের জন্য বরাদ্দ থাকা ট্রলি নিয়ন্ত্রণে রেখে মিটফোর্ড হাসপাতালেও বাড়তি টাকা কামায় বহিরাগতরা। নানা কারণে ঢাকার প্রায় সব সরকারি বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্রসহ সারাদেশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জামাদির সুযোগ-সুবিধা রোগীদের ভাগ্যে জুটছে না। ফলে ন‚্যনতম রক্ত পরীক্ষা থেকে শুরু করে ক্যান্সার নির্ণয় পর্যন্ত যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রোগীরা বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে।
ডাক্তাররা দিন দিন কেমন যেন নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছেন। হরেদরে মানুষ মরছে দায়িত্ব অবহেলায় আর চিকিৎসার অভাবে। দালাল চক্র ঘিরে আছে হাসপাতালগুলো। ডাক্তাররা মেতে উঠেছেন কমিশন বাণিজ্যে। সরকারি হাসপাতালের এমন অনিয়মে রোগীদের সেবা পাওয়া যেন দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিকিৎসক, কর্মচারী ও দালালদের সমন্বয়ে হাসপাতালগুলোতে তৈরি হয়েছে একাধিক সিন্ডিকেট। হাসপাতালে ওষুধ-পথ্যসহ অপারেশন সামগ্রীর কৃত্রিম সঙ্কট এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে করে রোগীরা চিকিৎসক, কর্মচারী ও দালালদের মাধ্যমে হাসপাতালের আশপাশে তাদেরই নিয়ন্ত্রণে থাকা ক্লিনিকে গিয়ে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হয়। গরিব রোগীদের জন্য সরকারিভাবে স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা দিতে আসা এসব হাসপাতাল এখন রয়েছে কর্মচারী ও দালাল চক্রের নিয়ন্ত্রণে। তারা যেভাবে চাইবে সেভাবেই হচ্ছে সব।
প্রায় ক্ষেত্রেই ডাক্তাররা দায়িত্ব যথাযথ পালন করেন না। অনেকেই উদাসীনতার পরিচয় দিচ্ছেন। ডাক্তাররা বড্ড বেশি বাণিজ্যিক হয়ে পড়েছেন। রোগী, রোগীর আত্মীয় স্বজনকে উপেক্ষা করেছেন। একজন রোগী ডাক্তারের কাছে নেহায়েতই একজন রোগী, তবে রোগীর পরিবারের কাছে তিনি একটি দালানের মজবুদ খিলানের সমতুল্য। হায়াত-মউত মানুষের সাথে সাথে অন্যান্য সৃষ্টির জন্য নির্ধারিত। তবু সে মৃত্যু যদি কারো অবহেলা, তাচ্ছিল্য ও উপেক্ষার কারণে হয়, তাহলে তার অপরাধ খুনের অপরাধের চাইতে কোনো অংশে কম নয়। বেশির ভাগ ডাক্তার, তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ববোধ, যা মানবীয় গুণাবলীর সাথে সম্পৃক্ত, কতটুকু পালন করেন এই প্রশ্ন আজ সর্বত্র উঠেছে! ‘জীবে দয়া করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’ একথাগুলো হাল আমলের ডাক্তারদে যেন অজানা। মানুষ হলো জীবের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। আল্লাহ বলেছেন, যে একজন মানুষ হত্যা করল, সে পুরো মানব জাতিকেই হত্যা করল। যে একজন মানুষকে বাঁচাল সে পুরো মানব জাতিকেই বাঁচাল। এই দুটি কথার মাঝখানেই ডাক্তারদের অবস্থান। সামান্য উদাসীনতাই তাদের জন্য ভয়ঙ্কর পরিণতি আসতে পারে, আবার সামান্য সহানুভ‚তিই তাদের জন্য আকাশসম মর্যাদা আসতে পারে। যাকে আল্লাহ বাছাই করেছেন তাকেই তিনি ডাক্তার বানিয়েছেন। আল্লাহ সৃষ্টির সেরা জীবের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ডাক্তারকে বিচরণ করার মহা সুযোগ করে দিয়েছেন। এটা কোনো ডাক্তারের অর্জিত বাহাদুরির নাম নয়, বরং সেটা আল্লাহর বিশেষ দয়া, যার মাধ্যমে ডাক্তারেরা জীবিকা নির্বাহ করবেন, সুষ্টির প্রতি মমত্ব দেখাবেন এবং পুণ্য অর্জন করবেন। আজ আমরা কী দেখছি? আমাদের ডাক্তার সাহেবরা কি তা করছেন? হাসপাতালের ডাক্তার-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলার এন্তার অভিযোগ। অবহেলার কারণে দাঁত তুলতে গিয়েও লাশ হচ্ছে মানুষ। খোদ মহানগরীতে সন্তান প্রসব করাতে গিয়ে এক ধাত্রী প্রসূতির নাড়িভুঁড়ি বের করে দিয়েছেন। এ ঘটনায় প্রস‚তির মৃত্যু ঘটে। হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে প্রসূতি মারা যাবার ঘটনাও ঘটছে।
এদিকে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধেও রয়েছে এন্তার অভিযোগ। বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোয় রোগীদের কাছ থেকে মাত্রাতিরিক্ত ফি আদায়ের পাগলা ঘোড়া থামানো যাচ্ছে না কোনোভাবেই। খেয়ালখুশি মতো বাড়ানো হচ্ছে সেবা ফি। বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোয় নিয়ন্ত্রণহীন ‘সেবাম‚ল্য’ আদায়ে রোগীদের জিম্মিসহ নানা মাত্রার হয়রানি-অত্যাচার ইংরেজ নীলকরদেরও হার মানাচ্ছে। সাধারণ রোগের জন্যও চিকিৎসকরা বিভিন্ন টেস্ট দিয়ে রোগীদের পাঠাচ্ছেন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সেখান থেকে তারা পান কমিশনের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। ডাক্তাররা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সরবরাহকৃত ¯িøপে টিক মার্ক দিয়ে দেন কোন কোন টেস্ট করাতে হবে। রোগী নিজের পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেই টেস্ট না করালে ডাক্তার ওই রিপোর্ট গ্রহণ করেন না। ডাক্তার তার নির্ধারিত সেন্টার থেকে আবার একই টেস্ট করিয়ে আনতে চাপ দেন। কমিশন নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল চিকিৎসা মেলে। এ সুযোগে কথিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো পরীক্ষার ফি বাবদ ইচ্ছামাফিক টাকা-পয়সা আদায়ের একচেটিয়া ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর কর্তৃক ক্লিনিক্যাল প্যাথলজির ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৮০ ও সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা, মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজিতে সর্বনিম্ন ১৫০ ও সর্বোচ্চ এক হাজার ৩০০ টাকা, বায়োকেমিস্ট্রিতে সর্বনিম্ন ১২০ টাকা ও সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা, হিস্ট্রোপ্যাথলজিতে সর্বনিম্ন ৫০০ ও সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ টাকা, ড্রাগ এবিউজে সব ধরনের পরীক্ষা সাড়ে ৫০০ টাকা, থেরাপিউটিক ড্রাগের ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা ও ভাইরোলজির ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ২০০ ও সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা ফি নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু এ মূল্য তালিকা মানে না কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারই। তাদের মনগড়া তালিকা অনুযায়ী টেস্টের টাকা পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছেন মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির রোগীরা। এসবের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের দায়িত্বশীল বিভাগটি অজ্ঞাত কারণে বরাবরই চরম উদাসীন।
দলবাজির কারণেও স্বাস্থ্যসেবা বিপর্যস্ত হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালসহ স্বাস্থ্য সেক্টরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫৫ হাজার ডাক্তারের মধ্যে আট হাজার ডাক্তার কোনোদিনই চিকিৎসাসেবা প্রদান করেন না। তাদের ধারেকাছে যেমন রোগীরা যেতে পারেন না, তেমনি এসব ডাক্তারও বসেন না নিজের কর্মস্থলে। দিন, সপ্তাহ, মাস নয়, বছরের পর বছর ধরে এসব দাপুটে ডাক্তার রাজনীতি, সংগঠন, দলাদলি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ছোটাছুটি করেন আন্দোলন, মিছিল, সমাবেশ নিয়ে। তারপরও তাদের চাকরি বহাল থাকে, বেতন-ভাতা পান এবং সবচেয়ে লোভনীয় পদগুলোতে পদায়ন-পদোন্নতিও জোটে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারীদের হাতেগোনা কয়েকটি সংগঠনের কাছে গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা রীতিমতো জিম্মি হয়ে পড়েছে। চিকিৎসাসেবা দেওয়ার মহানব্রত নিয়ে একদিন যারা ডাক্তারি পেশায় নিয়োজিত হয়েছিলেন, তারা এখন দলাদলি, মিছিল-সমাবেশ, রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সার্বক্ষণিক সক্রিয় থাকছেন। বিপুলসংখ্যক চিকিৎসকের কাছে দিন দিন পেশাদারিত্বটা গৌণ হয়েছে। নেতৃত্বই হয়ে উঠেছে তাদের মুখ্য-লোভনীয় আদর্শ! রাতারাতি সুবিধা হাতিয়ে নেওয়ার ধান্ধাবাজিতে লিপ্ত মহলটি চিকিৎসাসেবা দেওয়া দূরের কথা বরং নানা ক‚টকৌশলে স্বাস্থ্য সেক্টরকেই ভঙ্গুর করে দিচ্ছে।
সরকারি প্রতিটি হাসপাতালে হাসপাতালে ওষুধ-পথ্যসহ অপারেশন সামগ্রীর কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়। রোগীর জন্য বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহের নিয়ম থাকলেও নামমাত্র ২/১টি ট্যাবলেট ছাড়া তেমন কোন ওষুধ দেয়া হয় না তাদের। রোগীদের একটি সিরিঞ্জ পর্যন্ত বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনতে হচ্ছে। বিনামূল্যের শয্যা বেচাকেনা এখন ওপেন সিক্রেট। পত্রিকাগুলো ছেপেছে হাসপাতালে রোগী দেখতে গেলেও প্রতি গেটে নাকি জনপ্রতি দিতে হয় ১০ থেকে ৫০ টাকা। টাকা ছাড়া কোন কাজই হয় না হাসপাতালগুলোতে। বরাদ্দকৃত অর্থের ওষুধ কিংবা সার্জিক্যাল আইটেম রোগীদের ভাগ্যে তেমন জোটে না। তাদের সিরিঞ্জ থেকে শুরু করে সুতা পর্যন্ত প্রয়োজনীয় ৯০ ভাগ ওষুধ হাসপাতালের বাইরে থেকে কিনতে হয়। তাদের জন্য বরাদ্দ ওষুধ তাহলে কোথায় যায়?
একশ্রেণির টাউট ও দালাল চক্র সর্বক্ষণ হাসপাতালে গেটে ওঁৎ পেতে থাকে। দ‚র-দ‚রান্ত থেকে আসা রোগীরা হাসপাতালে এলেই দালালচক্র তাদের ওপর হামলে পড়ে। এই চক্রের হাতে প্রায় জিম্মি হয়ে পড়েছে রোগীরা। হাসপাতালকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই দালাল চক্রের সঙ্গে রয়েছে হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী ও শহরের ক্লিনিকগুলোর সম্পর্ক। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কোন রোগী আসলেই শুরু হয়ে যায় দালাল চক্রের আনাগোনা। দালাল চক্রের পাশাপাশি হাসপাতালে পেশাদার রক্তদাতারাও সক্রিয়। বেশিরভাগ রক্তদাতাই মাদকাসক্ত। পেশাদার এসব রক্তদাতার রক্ত মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতি ব্যাগ রক্ত তারা ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি করে। পেশাদার রক্তদাতা ছাড়াও হাসপাতাল এলাকার বিভিন্ন ওষুধের দোকান ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এমনকি খাবারের হোটেলেও রক্ত পাওয়া যায়।
মূলত ডাক্তারদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা, অনিয়মের কারণেই হাসপাতালগুলোর এ দুরবস্থা। রোগীরা যথাযথ সেবা পায় না। বিনে চিকিৎসায় রোগী মারে। সত্যিই আমাদের ডাক্তারগণ দিন দিন নির্মম হয়ে যাচ্ছেন। আমাদের সব ডাক্তার নির্মম তা বলবো না। তবে দয়ালু নন এমন ডাক্তার বের করতে গেলে রীতিমতো কেলক্যুলেটরের প্রয়োজন পড়বে। পরোপকারী ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ মানুষ, দয়া মনুষ্যত্বের ভ‚ষণ ইত্যাদি কথাগুলো ডাক্তারদের ইন্টার্নিশিপের আগে পড়ানোটা খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে। বিদ্যা অর্জনের আগে মানুষকে বিনয়ী হতে হবে তাও শিখিয়ে দিতে হবে ডাক্তাদের। সর্বোপরি তাদের হাতে সুঁচ-সুতা, কাঁচি ইত্যাদি তুলে দেবার আগে জনগণের গাঁটের খরচে একটি প্রশিক্ষণ কোর্স বাধ্যতাম‚লক করা জরুরি বলে মনে করছি। সে কোর্সে কেবলই মানবীয় গুণাবলী অর্জনের বিবিধ অনুশীলনী থাকবে। ফলে এসব ডাক্তার যখন রোগীদের সেবা করার সুযোগ পাবে, তখন তাদের হৃদয়ে অবহেলার জায়গায় সহানুভ‚তি জেগে উঠবে। তবেই মানুষ উপকৃত হবে।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।