শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
মেঘনা নদীর তীর। পুরান বাজারের ঠিক পশ্চিমে মেঘনা আর উত্তরে ডাকাতিয়া নদী। সারা বছর ছলছল করে বয়ে চলে নদীর পানি। উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে। বর্ষা এলে দুকূল উপচে ওঠে পানি। মাঠ ঘাট ডুবিয়ে দেয়৷ কখনো কখনো বাড়ি-ঘরে ঢুকে পড়ে৷
এই নদীর পশ্চিম পাড়ে খানিকটা দূরে আমাদের বাড়ি। এরই পাশে সাদিয়াদের বাড়ি। ঠিক আমাদের বাড়ির সম্মুখে। মেঘনা নদীর পূর্ব দক্ষিণে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। পৌষ-মাঘ মাসে নদীর দুপাড়ে দুটি ইরি ধানের সবুজ মাঠের দিকে তাকালে মন পাখি উড়ে যায়। উপরে নীলাকাশ৷ নিচে সবুজের বিপুল বিস্তার। যেন সবুজ সমুদ্র। সে সবুজ দেখতে কী যে ভালো লাগে! আমি আর সাদিয়া কখনো মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে ভাবি। আহ আমরা যদি পাখি হতাম! তাহলে এই মাঠের সবুজের উপর দিয়ে বাতাসে সারাদিন ডানা মেলে উড়ে বেড়াতাম। আকাশের ঐ অথই নীল আর মাঠের অনন্ত ঘন সবুজ গায়ে মেখে নিতাম। ইশ! কতই না ভালো লাগতো।
প্রকৃতির প্রতি মায়া ছিল আমাদের দুজনের বেশ৷ গাছগাছালি, নদী-বন্দর, পাহাড়-পর্বত আর আকাশ নিয়ে কবিতা লেখা হত নিয়মিত৷ আবৃত্তিতে আমরা ছিলাম সবার নয়ন কেড়ে নেয়ার মত। ক্লাসে কিংবা স্কুলের যেকোনো অনুষ্ঠানে আমাদের ডাক ছিলো দেখার মত। সবার মুখে একটাই নাম আহমদ আর সাদিয়ার মুখে কিছু শুনতে চাই। আমরাও নিঃস্বার্থভাবে সাবার মাঝে আনন্দ ঢেলে দিতাম, সর্বস্ব বিলিয়ে। তাই আমরা দুজন ছিলাম সবার মধ্যমণি। আমাদের দুজনের জুটি সবার মনে ঈর্ষা জন্মাতো বরাবরের মতই।
রাতে মেঘনা নদী আরেক রূপ ধারণ করে৷ আকাশে অসংখ্য জ্বলজ্বল করা তারায় মেলায় মায়ের ডাগর মুখের মতো শুভ্র চাঁদ হেসে ওঠে৷ ধবল জোছনায় আকাশ মাঠ আর গ্রাম একাকার হয়ে যায়। বর্ষার সময় নদীতে অনেক নৌকা চলে। এপার-ওপার ঘাটে নৌকোর টানাটানি লেগে যায়। কেউ হাট-বাজারে যায় আসে। কেউ আত্মীয় বাড়ি যায় আসে৷ কেউ নৌকোয় মাছ ধরে৷ গোসল করে৷ সাতার কাটে। ঘাটে ঘাটে নরনারী। ছেলে মেয়ে। ডাকাডাকি। কোলাহল।
সেদিন আমি আর সাদিয়া হাটছিলাম আনমনে, সহসা আমাদের দৃষ্টি আজাদ মাঝির দিকে৷ আমার চোখে বিন্দু বিন্দু পানি এসে পড়েছিল সে সময়টায়। তাদের দুঃখ আর কষ্টের কথা প্রায়শই আমি আর সাদিয়া ভাবতাম। স্কুলে যাওয়ার পথে আব্বু যা টাকা দিত, আমি আর সাদিয়া সবগুলো সেই আজাদ মাঝিকে দিয়ে দিতাম। নিজেদের মাঝে কেমন যেন একধরনের তৃপ্তি অনুভব করতাম। যাকে স্বর্গীয় তৃপ্তিও বলা যেতে পারে।
আজাদ মাঝি খেয়া পারাপার করে। আজাদ মাঝিকে সবাই আজাদ বলেই ডাকে৷ বর্ষাকালে দুকূলে লোকজনের দারুণ ভিড় হয়। হাঁকাহাঁকি শুরু হয়ে যায়। আজাদ মাঝির দাম বেড়ে যায়৷ দুপাড় থেকে ডাক পড়ে: ‹আজাদ তাড়াতাড়ি করে নাও ভিড়াও----।›
আজাদ মাঝির ভাঙ্গা নাও৷ সবসময় তলা দিয়ে ঝিরঝির করে পানি ওঠে৷ কতক্ষণ পানি না সেঁচলে নাও আধা ডোবা হয়ে যায়৷ আজাদ মাঝির কচি ছেলে রাহি। সে সারাক্ষণ পানি সেঁচে। একটু বসে জিরোবারও সময় পায় না।
নদীর তীরেই আজাদ মাঝির বাড়ি৷ বাড়ি মানে পাতায় ছাওয়া একটা ছোট্ট ঘর৷ ঘরের সামনে একটা লাউয়ের জাংলা৷ পেছনে কয়টা ভেন্না গাছ।
আজাদ মাঝির বউ ছমাস আগে মারা গেছে জ্বরে৷ ঘরে দশ বছরের মেয়ে পারুল। আজাদ মাঝির পরিবারে এখন তিনটি প্রাণী। পারুল, রাহি আর আজাদ মাঝি নিজে৷
বর্ষাকালে আজাদ মাঝিকে হাড় ভাঙ্গা খাটুনি খাটতে হয়। একটা ছেঁড়া ময়লা লুঙ্গি কোমরে জড়িয়ে মাথায় গামছা বেঁধে নাও যায় আজাদ৷ কোনো কোনো সময় যাত্রীদের ডাকাডাকিতে দুপুরের খাবারও খাওয়ার সময় পায় না। খোয়া বন্ধ হলে সে অভাবে পড়ে৷ তখন বাঁশের কাজ করে৷ কূলো বানায়, খাঁচি বানায়। এদিকে পারুল দুটো ছাগল পালে৷ দুমুঠো খেয়ে তাদের দিন চলে যায়৷ খাবার না থাকলে উপোস থাকে। আজাদ কাউকেই তাদের দুঃখের কথা কয় না৷ বলে লাভ কি! কেউই তো ধার-কর্জ দেয় না। সবাই জানে ধার-কর্জ দিলে সে কোনোদিন শোধ করতে পারবে না। তাই আজাদও কারো কাছে হাত পাতে না।
সমাজে তো কম মানুষ নেই। আজাদ মাঝির বউ মারা গেল মাত্র দুদিনের জ্বরে৷ জ্বর কঠিন ছিল না। রাহিকে নিয়ে খেয়া বাইতে গিয়েছিল আজাদ৷ পারুল ছাগল নিয়ে মাঠে। সে বিকেলে বাড়ি এসে দেখে মা মারা গেছে৷ হয়তো একটু খাবার জন্য কত ছটফট করেছে৷ মৃত্যুর আগে হয়তো তাদের কত ডেকেছে--
=পারুল, কই গেলি! পানি দে----পারুল, আমার রাহি কই? তর বাপ কই? ওদের ডাইকা আন....
কে ডেকে আনবে কাকে? কে দেবে পানি। কেউ তো কাছে ছিল না। আজাদ মাঝি সারাদিন নাও বায়। সে তার বউয়ের মুখে মরনকালে এক ফোঁটা পানি দিবে কিভাবে? যে রাহি সারাদিন নায়ের পানি সেঁচে ফেলে সেও তার মায়ের মুখে এক ফোঁটা পানি দিতে পারেনি। কত দুঃখ ও শোক যে ওদের বুকে, তা আলাহ ছাড়া দুনিয়ার আর কেউ বুঝে না।
পারুল বিকেলে ছাগল নিয়ে বাড়ি এসে মাকে মরা দেখে দৌড়ে গিয়ে বাপের কাছে কেঁদে কেঁদে খবর দেয়৷ পারুলের কান্না এপার-ওপারের যাত্রীরা সবাই শুনে কেউ একটু উহু-আহাও করলো না। কেউ রাহি আর পারুলকে স্বান্তনাও দিলো না। আজাদ দৌড়ে বাড়ি গেল। রাহিও কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি গেল৷ দুপারের লোকজন বলে উঠলো---
= আজাদের বউ মরে বিপদে ফেললো৷ এখন আমাদের পারাপার করবে কে?
আজাদ ঘরে গিয়ে দেখে তার বউ মরে একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে আছে। শরীরে জ্বর বালাই নাই৷ ক্ষুধার যন্ত্রণা নেই। সারা জীবন সে সব দুঃখ কষ্ট হজম করেছে। ছেঁড়া কাপড় তালি দিয়ে পরেছে। নতুন কাপড়ের দাবী করেনি কোনোদিন৷ কখনো কারো প্রতি অভিযোগ করেনি। এখনো অভিযোগহীন শান্ত নীরব সেই মুখ।
আজাদ মাঝি এই সমাজের একজন মানুষ। তা সে যত ছোট, তুচ্ছই হোক। চারদিকে কত মানুষের আনাগোনা। কিন্তু কেউ স্বান্তনা বা সহানুভূতি দেখাতে এলো না। নিজের বুকের কষ্ট চেপে রেখে আজাদ ছেলেকে বোঝায়---
= কান্দিস নারে পোলা৷ কানলে তো তোর মায় আর ফিরা আইবো না। পারুলকে বুঝায়---
= বেটি, কান্দিস না। কাইন্দা কি করবি! যে গেছে হে আর ফিরা আইবো না। কাইন্দা কাইন্দা আর দুঃখ্যু বাড়াইস না৷ অই পথে সকলেরই যাইতে হইবো......
পারুল আর রাহি বোঝে, বাবা মিছা কতা কয়নি। কেঁদে আর মাকে পাওয়া যাবে না। শুধুই দুঃখ বাড়বে৷ তাই আর কাঁদে না। প্রতিদিনের মত কাজের রুটিন মতো আজাদ মাঝি নদীতে খেয়া বায়। রাহি ভাঙ্গা নায়ের পানি সেঁচে। পারুল সকালে ছাগল নিয়ে মাঠে যায়। আজাদ মাঝি যে রাতে ছেলে মেয়ে নিয়ে দুমুঠো খেতে পারে, শরীরটা ভালো থাকে। তারপর ছেলেমেয়ের পাশে শুয়ে গান গায়:
নদীরে রে রে
জীবন ভইরা বাইলাম নাও
তোর কূল কিনারা পাইলাম না
নদীরে রে রে.....
জীবন ভইরা দেখলাম শুধু
কিছু বুঝলাম না
ভবের বাজারে আইসা ভবের
কোনো ভাব বুঝলাম না
নদীরে রে রে.........
আমি আর সাদিয়া প্রতিদিন কূলে দাঁড়িয়ে আজাদ মাঝিকে দেখি আর ভাবি। ওদের দুঃখকষ্ট মনের মধ্যখানে লাগে। মাঝেমাঝে আমাদের পুরোটা সময় ওদের ভাবনায় কেটে যায়। আমার আর সাদিয়ার সেই ভাবনাগুলো স্মৃতিপটে বারবার নাড়া দিয়ে ওঠে। ভেসে আসে আজাদ মাঝি, পারুল আর রাহির বৈচিত্র্যময় দুঃখে ভরা জীবন সংসার। তার কোমরে পেঁচানো ছেঁড়া লুঙ্গি। মাথায় একখণ্ড তেনা। এদিকে রাহি পরনে হাফপ্যান্ট। উদন গতর। ওরা গ্রীষ্মকালে রোদে পোড়ে। ঘরমে ঘামে। বর্ষা-বৃষ্টিতে ভিজে নাও বায়। পানি সেঁচে। লোকজন পারাপার করে...
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।