Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাপানে ভাড়ায় পাওয়া যাচ্ছে ‘বোন’

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২০ জানুয়ারি, ২০১৯, ৮:৫৮ পিএম

জাপান মানেই সুসজ্জিত ভবনে ভরা আলো–ঝলমল নগর আর কর্মব্যস্ত সবার ছুটে চলা। অথচ এই নগরেই গড়ে উঠেছে বিচিত্র পেশা—‘ভাড়াটে বোন’ সরবরাহ। অর্থের বিনিময়ে বোন হিসেবে কাজ করেন তারা।
‘ভাড়াটে বোন’ পেশা গড়ে উঠার যা জানা যায়, তা বেশ ভয়াবহ। অনেকটা আলোর নিচে অন্ধকারের মতো ঘটনা। হিকিকোমোরি নামের একটি সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে জাপানের তরুণ প্রজন্ম। এতে আক্রান্ত তরুণ-তরুণী সমাজ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেন। তারা ঘরবন্দী হয়ে যান। মা-বাবা বা আপনজনদের সঙ্গ এড়িয়ে চলেন। বরং কিছু জানতে চাইলে বিরক্ত হন, কখনো বা সহিংস আচরণ করেন। হিকিকোমোরিতে আক্রান্ত হতে পারেন যে–কেউ। তবে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। বয়সী অল্প কিছু মেয়ের মধ্যেও এমনটা দেখা যায়। হিকিকোমোরিতে আক্রান্ত সন্তান থাকাটা সমাজের চোখে লজ্জাজনক। তাই পরিবার তাদের কথা গোপন রাখে। কীভাবে এ থেকে মুক্তি পাবে, সেই চিন্তায় অস্থির থাকে। জাপানে তরুণ প্রজন্মের প্রায় পাঁচ লাখ এই সমস্যায় আক্রান্ত। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করা হয়।
বিবিসির সাংবাদিক কথা বলেন কেনতা নামের হিকিকোমোরিতে আক্রান্ত এক তরুণের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বিদ্যালয়ে আমি মেয়েদের সঙ্গে বেশি মিশতাম। এ জন্য সবাই আমাকে খ্যাপাত। বলত, তুমি ছেলে না মেয়ে? আমার ভীষণ খারাপ লাগত। আমি খুবই অসুখী বোধ করতাম। নিঃসঙ্গ বোধ করতাম। সারাক্ষণ কাঁদতাম। মা-বাবাকে দোষারোপ করতাম। নিজের ওপর রাগ হতো, সমাজের ওপর রাগ হতো। এমন পরিস্থিতি পর্যন্ত হয়েছে যে, বাবা-মা পুলিশ ডেকেছে। মুক্তি পেতে আমি ওষুধ খাচ্ছিলাম। আমি সারা রাত ভিডিও গেম খেলে, সারা দিন ঘুমাতাম।’
কেনতার মতো মানুষকে মুক্তি দিতে এগিয়ে এসেছে নিউ স্টার্ট নামের একটি সংগঠন। তারাই ভাড়ায় বোন সরবরাহ করার ধারণা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। তাদের এই উদ্যোগ যে কাজে লাগছে, সেই প্রমাণও মিলেছে। নিউ স্টার্টের হয়ে ভাড়ায় কাজ করেন, এমন এক বোন আয়াকো। এই বিশেষায়িত দলে আছেন তার মতো আরও অনেক নারী। হিকিকোমোরিতে আক্রান্ত তরুণদের সহায়তা করার জন্য এই তরুণীদের ভাড়ায় নেওয়া হয়। তাদের মূল কাজ ওই তরুণদের নিজের ঘরের বাইরে বের করে নিয়ে যাওয়া। সমাজে আবার মিশে যেতে সহায়তা করা।
তরুণেরা কেন হিকিকোমোরিতে আক্রান্ত হচ্ছেন, এর কোনো কারণ জানা যায়নি। এর কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা নেই। সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসাও নেই। তবে নিঃসঙ্গতা থেকে এমনটা হতে পারে ধরে নিয়েই কাজ শুরু করে নিউ স্টার্ট। চেষ্টা করে তরুণদের নতুন পথে নিয়ে যেতে, তাদের সামনে নতুন জগৎ মেলে ধরতে।
যে তরুণীরা হিকিকোমোরিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সারাতে কাজ করেন, তারা কেউই চিকিৎসাবিজ্ঞানে ডিগ্রিধারী নন। একেবারেই সাধারণ যোগ্যতার। তবে তাদের আয় শুনলে কপালে চোখ উঠে যেতে বাধ্য। মাসে এক লাখ ইয়েনের বেশি আয় তাদের। আয়াকো নামের ভাড়াটে বোন বললেন, ‘আমি কোনো কৌশল জানি না। আমি শুধু তাদের সঙ্গে তাদের মতো করে মেশার চেষ্টা করি।’ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি এ পেশায় আছেন। আয়াকোর সাহচর্যে বদলে যেতে শুরু করে কেনতা। ছয় মাস ধরে কেনতার ভাড়াটে বোন হিসেবে কাজ করছেন তিনি। কেনতা এখন বাড়ির বাইরে বের হন। কেনতা বলেন, ‘আমি আমার ভাড়ায় আনা বোনকে দেখে খুশি হই। গল্পগুজব করি। দুজনে মিলে বাইরে খাওয়াদাওয়া করতে যাই। তিনি আমাকে অনেক সাহায্য করেন। আমার নিজেকে আর একা মনে হয় না। ভালো লাগতে শুরু করে। তিনি আমাকে প্রেরণা দেন। নিজের ওপর বিশ্বাস ফিরে আসছে আমার।’
এভাবে ভাইবোনের মতো থাকতে থাকতে অনেক সময় উভয়ের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তবে সেটা সব সময় নয়। আয়াকোর ভাষ্য, তাঁদের সাহচর্য পেয়ে সবাই যে খুব খুশি হয় বা তাদের সঙ্গে প্রাণ খুলে মজা করে, এমনটা সব সময় হয় না। তবে কেনতার মতো অনেকেই তাদের ভালোভাবে মেনে নেন। কেনতাও বললেন, ‘আমি যখন আর তাকে দেখব না, তখন খুব খারাপ লাগবে। তবে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আনন্দও আমার মধ্যে তখন প্রবলভাবে কাজ করবে। আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ।’ আয়াকো জানালেন, তিনি রোগীদের সঙ্গে ভণিতা করেন না। কারণ, সেটা তারা বুঝে ফেলে। তার ভাষায়, ‘আমি যা, যেমন, সেটাই তাদের সামনে তুলে ধরি। সেভাবেই কাজ করি।’ তবে এ পেশায় টিকতে হলে ধৈর্যের বিকল্প নেই বলে মন্তব্য তার।
ঠিক কী কারণে হিকিকোমোরি হয়, তার কারণ বেশ জটিল। মনোবিজ্ঞানী তামাকি সাইতো বলেন, জাপানে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা ১০ হাজারের কম। অথচ হিকিকোমোরিতে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক লাখ। অনেকে ভাবেন, হিকিকোমোরিতে আক্রান্তরা অলস। আবার কেউ কেউ ভাবেন, তারা বিপজ্জনক কিংবা তারা ভয়াবহ অপরাধী হতে যাচ্ছে। আসলে বিষয়টা এমন না।
ভাড়ায় বোন সরবরাহের পাশাপাশি ভাড়ায় থাকার ব্যবস্থাও আছে নিউ স্টার্টের। আছে খণ্ডকালীন কাজের ব্যবস্থাও। তবে সেগুলো জনসেবামূলক কাজ। এখানে যারা আসেন, তারা ফোন ব্যবহার করতে পারেন না। ভিডিও গেম খেলা নিষিদ্ধ। শুধু টিভি দেখতে পারেন, তাও সবাই মিলে এক জায়গায় বসে। দেড় যুগের বেশি সময় ধরে এখানে প্রায় দুই হাজার লোক থেকেছেন। ৮০ শতাংশের বেশি এক বছরের মতো এখানে থেকে স্বাভাবিক হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। মিশে গেছেন মূল স্রোতে। সূত্র: বিবিসি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাপান


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ