পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়ে গেছে প্রায় দু’ সপ্তাহ হল। কিন্তু এ নির্বাচন নিয়ে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে তার জের এখনও চলছে। সংবাদপত্র পাঠকদের মনে থাকার কথা, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বয়কট করেছিল নির্বাচন সম্পর্কে আওয়ামী লীগ অতীতে নির্বাচন পদ্ধতির প্রশ্নে বিএনপি সাথে আওয়ামী লীগ যে সমঝোতায় পৌছেছিল তা লংঘনের অভিযোগ এনে। দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় সে নির্বাচন বাস্তবে পরিণত হয় নির্বাচনী প্রহসনে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা তো দূরে থাক, শাসক দলের অনেক নেতা কর্মীও সে নির্বাচনে ভোট দিতে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার গরজ অনুভব করেননি। তারা জানতেন তাদের অনুপস্থিতিতেও তাদের ভোট দানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে দলের পক্ষ থেকে।
বাস্তবে হয়ও সেটাই। ভোট কেন্দ্রে বিরোধী দলের নেতা কর্মীদের বয়কট জনিত অনুপস্থিতির সুযোগে শাসক দলের অল্পসংখ্যক নেতাকর্মীরাই ইচ্ছা মাফিক শাসক দলের প্রার্থীদের পক্ষে প্রদত্ত ভোট সংখ্যা অকল্পনীয়ভাবে বাড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করেন আনুষ্ঠানিকতার নিরিখে। এতে শাসক দলের বিপুল ভোটে বিজয় লাভ সম্ভব হলেও দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পূর্ব-ঘোষিত বয়কটের কারণে শাসক দল আওয়ামী লীগ বিজয়ের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন থেকে বঞ্চিত থাকতে বাধ্য হয়। শুধু তাই নয়। দেশে সংসদীয় রাজনীতি প্রচলিত থাকায় জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতার পদ অলংকৃত করতে হয় প্রধান মন্ত্রীর উপদেষ্টা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টীর নেত্রী বেগম রওশন এরশাদকে।
এর ফলে সংসদীয় শাসন পদ্ধতির নীতি মাফিক সংসদে বিরোধী দলের নেতার প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হতে হয় বিএনপিকে। এই বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে কিনা জানা যায় না, একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করে বিএনপি। হয়ত বিএনপির বিশ^াস ছিল দশম সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েও দেশ বিদেশে কোথাও আওয়ামী লীগ সে বিজয়ের বাস্তব স্বীকৃতি পায়নি বলে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণে আওয়ামী লীগ আন্তরিক আগ্রহী হবে। দেশের জনগণও দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের একঘেঁয়ে এক পেশে শাসনে অতীষ্ঠ হয়ে থাকবে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে এমন এক পরিবেশ বিরাজ করে যাতে বুঝা যায়, এ নির্বাচনে বিএনপির বিপুল বিজয় সম্ভব হবে।
তবে আওয়ামী লীগ দেশের প্রাচীনতম ও অভিজ্ঞতম রাজনৈতিক সংগঠন হওয়াতে বিএনপির এ সম্ভাব্য বিজয়কে পরাজয়ে রূপান্তরিত করতে যেসব ন্যায়-অন্যায় পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন অনুভব করেছে, তা নিতে সামান্যতম দ্বিধা বোধ করেনি। ফলে দেশবাসী যেখানে আশা করেছিল একাদশ সংসদ নির্বাচনে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বিপুল বিজয়, সেখানে আওয়ামী লীগের আগাম মাত্রাতিরিক্ত কর্মতৎপরতার কারণে জনগণ দেখতে পেয়েছে আওয়ামী লীগের অবিশ^াস্য বিপুল বিজয় এবং বিএনপির অবিশ^াস্য এমন পরাজয়, যার কারণে নির্বাচন কমিশনকে মেরুদÐহীন সংস্থা হিসাবে বিরাট দুর্নাম অর্জন করতে হয়েছে।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে এভাবে আওয়ামী লীগের অবিশ^াস্য বিপুল বিজয় লাভের পর আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে এ বিলম্বিত বোধোদয় ঘটেছে যে কাজটা বিরাট ভুল হয়ে গেছে। তারা একেকজন এক একেকভাবে তার প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আওয়ামী লীগ সমর্থিত ১৪-দলীয় জোটের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, শংকা আছে বড় জয়ে। সুতরাং এজয়ের আনন্দে কিছুতেই আত্মহারা হওয়া চলবে না। আওয়ামী লীগ নেত্রী তাদের এই অস্বাভাবিক জয়ের কারণ হিসাবে দেখাতে চেষ্টা করেছেন বিরোধী ঐক্যজোটের নির্বাচনী প্রচারের দায়িত্ব পালন করেন ড. কামালের মত একজন নির্বাচন অনভিজ্ঞ নেতা। এছাড়াও নির্বাচনের সময় বিএনপি সমর্থিত জোট দেখাতে পারেনি কে হবেন তাদের জোটের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। নির্বাচনের আগ দিয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে আটক করে রাখায় যে বিরোধী ঐক্যজোটের পক্ষে এ কাজটা সম্ভবপর হয়নি, এটা সবাই জানেন। সুতরাং তারা বিএনপির পরাজয়ের যেসব কারণ দেখান, দেখা যাবে, যেসব কাজের জন্যও দায়ী সরকার।
আসলে সরকারী নেতারা বিএনপি ও বিএনপির সমর্থিত ঐক্যজোটের পরাজয়ের জন্য যত কারণই দেখাক, বিএনপির পরাজয়ের মূল কারণ যে আওয়ামী লীগের বিএনপি-ভীতি এবং এই ভীতিজনিত বিভিন্ন ন্যায় অন্যায় কার্যক্রম, তা বুঝতে জনগণের একটুও বাকী নেই। অথচ আওয়ামী লীগের অবিশ্বাস্য বিপুল বিজয়ের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রবীণ নেতা মোহাম্মদ নাসিম যেখানে বলেছেন শংকা আছে বড় জয়ে, সেখানে প্রধান মন্ত্রী একাদশ সংসদ-নির্বাচনের পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে সংলাপের ডাক দিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতি। বিএনপি সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে এরকম কোন সংলাপে যাবে না তারা। তাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য বিএনপির সুস্পষ্ট জয়কে অন্যায়ভাবে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে, সুতরাং নতুন নির্বাচন ছাড়া তাদের পক্ষে সরকারী দলের সঙ্গে অন্য কোন আলোচনায় তারা যেতে পারে না। বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল বলেছেন নির্বাচন বাতিলের এজেন্ডা ছাড়া অন্য কোন এজেন্ডা নিয়েই সরকারের সঙ্গে বিএনপি আলোচনায় বসতে পারে না।
এদিকে ২১ জানুয়ারী নতুন মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকের কথা বলা হলেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী প্রথম বিদেশ সফরে যাচ্ছেন ভারতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর আমন্ত্রণে। এটা আওয়ামী সরকারের ভারত নির্ভরতার নতুন প্রমাণ হিসাবে মনে করেন অভিজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে অন্যায় পন্থায় অবিশ্বাস্য বিজয়ের পর পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন দলের প্রতি আওয়ামী লীগ যে সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়েছে এখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন সেখানে পরিস্থিতি নিয়ে সংলাপ হবে না, বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করা হবে। এর অর্থ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়কে অন্যান্য রাজনৈতিক দল যে মেনে নিতে পারছে না সে সম্বন্ধে আওয়ামী নেতাদের বিলম্বিত বোধোদয় হয়েছে।
একাদশ সংসদ নির্বাচন যেভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে এটা সুস্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগ দেশের প্রাচীনতম দল হলেও এবং তাদের এদেশের জনগণের মন-মানসিকতা জানা থাকলেও তারা ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থের কারণে নির্বাচনও গণতন্ত্রকে সঠিক মূল্য দানে আজও সাহস পাচ্ছেন না। প্রকৃত গণতন্ত্রে নিয়মিত ব্যবধানে অবাধ নির্বাচন একেবারেই অপরিহার্য। অথচ অবাধ নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগের বিজয় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তা হলে অবাধ নির্বাচনকে পাশ কাটিয়ে যে পন্থায় তাদের বিজয় নিশ্চিত হয়, সে ধরনের কোন বিজয়ের জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলেই সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কেবল মাত্র একটি সরকারী দল রেখে এদেশে একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল আওয়ামী লীগ। এরপর কিছু দু:খজনক ঘটনার মধ্যে দিয়ে এক দলীয় শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তে দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুন: প্রতিষ্ঠিত হলেও এক পর্যায়ে তদানীন্তন সেনা প্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একটি নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মারফৎ উৎখাত করে বসে তখন সারা দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে সেই ক্যুর প্রতি সমর্থন জানিয়ে বসেন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা। এর সম্ভাব্য কারণ এই ছিল যে, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি ছিল সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত হওয়া ঐ নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে।
এতে প্রমাণিত হয় আওয়ামী লীগ দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল হলেও এর নেতৃত্বে বর্তমানে যারা অধিষ্ঠিত রয়েছেন তারা এখন আর গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আস্থা রাখতে পারছেন না। তারা তাদের গোষ্ঠী-স্বার্থে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যে জলাঞ্জলি দিয়ে জেনারেল এরশাদের মত সামরিক নেতার সঙ্গে হাত মিলিয়ে একটি নির্বাচিত সরকারের উৎখাতে সহযোগিতা করতেও এক পায়ে খাড়া থাকতে পারেন। এটা দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলের জন্য চরম লজ্জার কথা। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের জানা থাকার কথা, বাংলাদেশের ইতিহাসে একদা এমন এক সময় এসেছিল, যখন দেশে নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে সকল জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হত। এ ব্যবস্থার প্রস্তাবক ছিলেন স্বয়ং আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকাকালীন সময়ে বেগম খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রীত্বের আমলে। ঐ প্রথা চালু থাকাকালে দেশে বেশ কয়েকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে পালাক্রমে পরপর শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া প্রধান মন্ত্রী নির্বাচিত হন।
পরবর্তীকালে কিছু রাজনীতিকের অতিরিক্ত ক্ষমতা সুধাক্ষুকারণে এই সুন্দর ব্যবস্থার পরিবর্তে দেশে শেখ হাসিনার প্রধান মন্ত্রীত্বের আমলে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান চালু হয় এবং নির্বাচনে দলীয় রাজনীতির কুপ্রভাব অনুপ্রবেশ করে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ফলাফল কত খারাপ হতে পারে তার জঘন্যতম দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে এতে কতরকম অন্যায় ও অনিয়ম হতে পারে তার চরম দৃষ্টান্ত দেখেছে বাংলাদেশের জনগণ। যেখানে জনগণের একচেটিয়া রায়কে ভোট ডাকাতির মাধ্যমে ছিনতাই করে বিএনপির নিশ্চিত বিজয়কে ছিনিয়ে নিয়ে আওয়ামী লীগের অবিশ্বাস্য বিজয়কে নিশ্চিত করা হয়।
এর ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, দেশের প্রাচীনতম দল আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের আস্থা হারিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ যদি অবাধ নির্বাচন হতে দিতো তাহলে এবার পরাজিত হলেও তারা পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হয়ে জনগণের আস্থা নিয়ে সৎ পথে ক্ষমতাসীন হতে পারতো। সেই কাম্য পথে না নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার জবরদস্তি ও অন্যায় পন্থা অবলম্বন করে বিএনপির নিশ্চিত জয়কে চালাকি ও জবরদস্তির মাধ্যমে ছিনিয়ে নিয়ে আওয়ামী লীগ যে জঘন্য পন্থা অবলম্বন করে অন্যের নিশ্চিত বিজয়কে যেভাবে ছিনিয়ে নিয়েছে, তাতে আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের আস্থা যেভাবে হারিয়ে গেছে তা পুনরুদ্ধার করা আওয়ামী লীগের পক্ষে শুধু কষ্টকর নয়, অসাধ্য হয়ে উঠেছে, তার মাশুল আওয়ামী লীগকে দিতে হবে বহু বহু দিন ধরে। একারণেই প্রধানমন্ত্রীর আহূত বিভিন্ন দলের সঙ্গে সংলাপকে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ঊর্ধ্বে কিছু বলতে সাহস পাননি দলীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কিন্তু এর পরও তারা কুল পাবেন কি? দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপি তো পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে নতুন নির্বাচন ছাড়া কোন বিষয়েই আর সরকারের ডাকে তারা সাড়া দিতে রাজী নন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।