পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশবাসীর অভিজ্ঞতা সার্বিকভাবে সুখকর হলো না। আড়াই কোটি তরুণ ভোটার, যাদের এই নির্বাচনেই প্রথম ভোট দেয়ার কথা কিংবা যারা বয়োবৃদ্ধ ভোটার, যাদের অনেকের পক্ষেই হয়তো আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেয়া সম্ভব হবে না, তারা সবাই কি দেখল? তারা দেখল একটি একপেশে নির্বাচন, যেখানে বিরোধীদলের কোনো উপস্থিতিই লক্ষ্য করা গেল না। তাদের মূলত : মাঠছাড়া করেই হল এই নির্বাচন। ব্যালট পেপার ছিনতাই, ভোটকেন্দ্রে হামলা, ভোটকেন্দ্র দখল, নানা অনিয়ম, সংঘাত ও সহিংসতা, প্রাণহানি, বিরোধীদলের প্রার্থীদের এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে না দেয়া কিংবা বের করে দেয়া, প্রার্থীদের ভোট বর্জন- কী না হল এই নির্বাচনে? সুষ্ঠু নির্বাচন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে যা বোঝায় তা কি হয়েছে? সব দলের অংশগ্রহণই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নয়, সেইসঙ্গে ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিচায়ক। নির্বাচনের আগে বিরোধীদলের প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকদের ওপর যেভাবে হামলা, মামলা, ধরপাকড় হয়েছে, তাতে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, নির্বাচনটি একতরফাই হতে যাচ্ছে। এমন একটা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয় যাতে বিরোধীদলের সমর্থক ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে না পারে। অভিযোগ রয়েছে, ভোটের আগের রাত পর্যন্ত তাদের ভয়ভীতি দেখানো হয়, ভোট দিতে যেতে বারন করা হয়। পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিরোধীদলীয় বেশ কয়েকজন প্রার্থীকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। তাদের কর্মী ও এজেন্ট ছাড়াও দেশব্যাপী বিরোধীদলীয় কর্মী ও এজেন্টদের ব্যাপকভাবে গ্রেফতার করা হয়। এর ফলে দেখা গেছে, অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রে বিরোধীদলীয় কোনো এজেন্ট নেই কিংবা এজেন্ট দিতে পারেনি। ভয়ভীতির কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায়, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে ভোটারের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম ছিল। নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি করল? দেশব্যাপী নিরাপত্তার চাদর বিছিয়েও তারা নির্ভয় পরিবেশ নির্মাণ করতে পারল না, যাতে দলমত নির্বিশেষে সকল ভোটার ভোটকেন্দ্রে এসে তাদের রায় দিতে পারে।
নির্বাচনের পরিবেশ ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। বাস্তবে দেখা গেছে, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নির্মিত হয়নি, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত হয়নি। বরং বিরোধীদলের প্রচারণায় বাধা, প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকদের ওপর নির্বিচার হামলা, মামলা ও গ্রেফতারের কারণে পরিবেশের অবনতি ঘটেছে। ন্যূনতম লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডও গড়ে ওঠেনি। এমতাস্থায়, নির্বাচন কেমন হতে পারে, সেটা কারো আন্দাজের বাইরে ছিল না। তবু শেষ পর্যন্ত কী হয়, সেটা দেখার জন্য দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষক মহলসহ দেশবাসী অপেক্ষায় ছিল। এখন ভোটচিত্র দেখে নি:সন্দেহে তাদের হতাশ হতে হয়েছে। এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন্স (আনফ্রেল)সহ ১৬টি মানবাধিকার ও নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ভোটের আগের দিন এক বিবৃতিতে জানায়, নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনী পরিবেশের মধ্যে ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। দীর্ঘ বিবৃতিতে নির্বাচনের পরিবেশ, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সম্পর্কে বিভিন্ন বরাতে তথ্য-উপাত্ত উল্লেখ করে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা সহিসংতার পরিবেশ তৈরি করা, আইনকে হাতিয়ার বানিয়ে ফেলা, বিরোধীদলের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় এজেন্সিগুলোর ব্যবহার, নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিক‚লতা ও মিডিয়াকে ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে বাংলাদেশে কার্যকর একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে, যা জনগণের মুক্ত বাসনাকে অবজ্ঞা করার শামিল এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচনী নীতির খেলাপ। এ অবস্থায় আমরা আসন্ন নির্বাচনের বিশুদ্ধতা নিয়ে ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছি। এ নির্বাচনকে কোনো যুক্তিতেই সুষ্ঠু ও অবাধ হিসাবে বিবেচনা করা যায় না। বলাবাহুল্য, ভোটচিত্র তাদের সংশয়কে সত্য হিসেবে প্রতিভাত করেছে এবং বিবেচনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, এমন কথা বলাই কি সুযোগ সৃষ্টি হলো না?
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির তরফে নির্বাচন নিয়ে যে সব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, তা উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। একজন নির্বাচন কমিশনারও বলেছেন, তার কাছেও অসংখ্য অভিযোগ এসেছে; কিন্তু তার একার পক্ষে এ সবের প্রতিকার করা সম্ভব নয়। নির্বাচনের বিশুদ্ধতা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা নিসেন্দেহে দুঃখজনক। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণভিত্তিক ছিল না। ওই নির্বাচন ছিল একতরফা, জবাবদস্তিমূলক ও প্রশ্নবিদ্ধ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে সে রকম না হয়, সেটাই ছিল দেশি-বিদেশি সকল মহলের একান্ত প্রত্যাশা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং একাধিকবার বলেছেন, তিনি আর কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন দেখতে চান না। অথচ সে রকমই একটি নির্বাচন হয়ে গেলো। এ নির্বাচন নানা কারণেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত। এই প্রথম দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হলো এবং তাতে সবদল অংশগ্রহণ করল। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় না, এটাই আমাদের দেশের অভিজ্ঞতায় প্রতিষ্ঠিত সত্য। এই সত্য ভ্রান্ত প্রমাণ করার অর্থাৎ দলীয় সরকারের অধীনেও নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয়, সেটা দেখিয়ে দেয়ার এটাই ছিল সুযোগ। সে সুযোগ কাজে লাগানো গেল না। এর চেয়ে পরিতাপের আর কি হতে পারে! একটি প্রশ্নাতীত নির্বাচন করা গেল না, এটা জাতির জন্য চরম লজ্জার বিষয়। দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, এটা আরো একবার প্রমাণিত হল।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।