প্রতিশ্রুত ট্যাঙ্কের মাত্র এক চতুর্থাংশ ইউক্রেনকে দিচ্ছে পশ্চিমারা
ব্রিটেনের সানডে টাইমস রোববার জানিয়েছে, এপ্রিলের শুরুর মধ্যে ইউক্রেন পশ্চিম-প্রতিশ্রুত ট্যাঙ্কগুলোর এক চতুর্থাংশের কম পাবে। এতে
এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) সরবরাহের ফলে জ্বালানি খাতে যোগ হলো নতুন মাত্রা। মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি তেল-গ্যাস সমৃদ্ধ দেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে এলএনজি। দেশের অভ্যন্তরে ভূগর্ভস্থ গ্যাস ক্ষেত্রসমূহ থেকে উত্তোলিত প্রাকৃতিক গ্যাস এবং ইতোমধ্যে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া চট্টগ্রামের সাগরপ্রান্তিক একমাত্র গ্যাসক্ষেত্র ‘সাঙ্গু’র প্রাকৃতিক গ্যাসের দামের তুলনায় আমদানিকৃত এলএনজির মূল্য দ্বিগুণ তিনগুণ বেশি। এ কারণে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মহল উচ্চমূল্যের এলএনজিকে খুব একটা স্বস্তিদায়ক ও টেকসই সমাধান হিসেবে দেখছে না। তবে দেশে গ্যাসের তীব্র ঘাটতি এলএনজির সুবাদে কমে এসেছে। সেই অর্থে এলএনজি জ্বালানির যুগে বাংলাদেশের প্রবেশ তাৎপর্যপূর্ণ বটে।
বিগত ২৪ এপ্রিল আমেরিকান জ্বালানি কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির ভাসমান টার্মিনালযুক্ত জাহাজ ‘এক্সিলেন্স’ কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীর অদূরে বঙ্গোপসাগরে এসে পৌঁছায়। বেলজিয়ামের পতাকাবাহী বিশাল জাহাজটি কাতার থেকে প্রথম চালানে এক লাখ ৩৬ হাজার ৯শ’ ঘনমিটার বা ৬০ হাজার ৪৭ মেট্রিক টন এলএনজি নিয়ে বাংলাদেশে আসে। এরপর প্রায় ৪ মাস বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক, কারিগরি ও অবকাঠামোগত ত্রুটি-বিচ্যুতি, সাব-মেরিন পাইপলাইনে যান্ত্রিক গোলযোগসহ হরেক রকম জটিলতা কাটিয়ে অবশেষে বিগত ১৮ আগস্ট জাহাজের সঙ্গে যুক্ত রি-গ্যাসিফিকেশন স্টেশন থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রামে সরবরাহ শুরু করা হয়। এরফলে বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন বৃহদায়তন শিল্প-কারখানা, রফতানিমুখী শিল্প-প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন পর উৎপাদনের চাকা সচল হয়। সচল হয় গ্যাসচালিত একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। চট্টগ্রামের শতাধিক শিল্প, কল-কারখানায় ফিরে আসে প্রাণ। তাছাড়া আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাসের অভাবে দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ নিরসন হয় অনেকাংশে। বাণিজ্যিক খাতও সচল হয়ে উঠেছে।
গ্রিডলাইন স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হলে চট্টগ্রামের পর রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয় গত ২৮ নভেম্বর থেকে। এরফলে এলএনজির জোগান পেতে শুরু করেছে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশ এলাকা। মহেশখালী দ্বীপের মাতারবাড়ী সংলগ্ন সমুদ্র উপক‚লে এলএনজি স্টেশন ও রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট থেকে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম হয়ে জাতীয় গ্রিড পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাসের সরবরাহ ঢাকায় যাচ্ছে।
গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানির লি. (জিটিসিএল) সূত্রে জানা গেছে, এলএনজির উৎসের গ্যাস ঢাকায় সরবরাহ করা হবে দৈনিক ২০০ থেকে ২৩০ মিলিয়ন ঘনফুট। চট্টগ্রাম অঞ্চলে দেয়া হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। বর্তমানে দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে এলএনজি বাবদ। পরবর্তী সময়ে এলএনজি আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে বৃহত্তর চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় আরও বেশি পরিমাণে গ্যাসের জোগান দেয়া সম্ভব হবে।
ক্রমবর্ধমান গ্যাসের চাহিদা সামাল দিতে কাতার ছাড়াও বিভিন্ন দেশ থেকে পেট্রোবাংলা কর্তৃক এলএনজি আমদানির প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের কাছেও এলএনজি স্টেশন-টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জ্বালানি মন্ত্রণানয় আশা করছে, গ্যাসের চাহিদা পূরণ হলে দেশে বিশেষত চট্টগ্রাম ও ঢাকায় বিনিয়োগ, শিল্পায়ন ও রফতানিমুখী শিল্প-বাণিজ্যিক উৎপাদন আরো গতিশীল হবে। গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহ নিরবচ্ছিন্ন সচল রাখা এবং আবাসিক খাতে গ্যাসের চাহিদা পূরণে সহায়ক হবে। আবাসন খাতের মন্দাদশা কেটে যাবে। অবশ্য জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞ মহল দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ থেকে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে অবহেলায় হতাশা ব্যক্ত করে আসছেন। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের নিজস্ব পানিসীমার পরিধি বৃদ্ধি পাওয়া সত্তে¡ও সুবিশাল সমুদ্রসীমায় (অফশোর) নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের বিষয়ে সরকারের নির্লিপ্ততা এবং এ ব্যাপারে অদূরদর্শী নীতিকে দায়ী করেছেন। বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে মনোযোগী না হয়ে দুই-তিগুণ উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানির উদ্যোগটি ভারসাম্যহীন নীতি ছাড়া কিছুই নয়। এরফলে বর্ধিত মূল্যে গ্যাস কিনতে গিয়ে শিল্প-বাণিজ্যিক ও আবাসিক গ্রাহকদের ব্যয় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার সাথে লাগোয়া বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমার সম্প্রতি সাতটি নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কার ও গ্যাস উত্তোলন করছে। তাহলে স্বভাবতই বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় পর্যাপ্ত এমনকি আশাতীত পরিমাণে গ্যাস মজুদ থাকার বিষয়টি সুনিশ্চিত। যদিও এই গ্যাস সম্পদ অবহেলিত। আর অবহেলার কারণেই একদিন বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় মজুদ গ্যাস একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে। নিকটতম প্রতিবেশী দেশের গ্যাসক্ষেত্রের মাধ্যমেও তা শুষে নেয়া হতে পারে। এই প্রাকৃতিক সম্পদের সময়োচিত সদ্ব্যবহার জাতীয় স্বার্থেই অপরিহার্য।
এলএনজির অবকাঠামো স্থাপন : গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানির লি. (জিটিসিএল) সূত্র জানায়, গত নভেম্বর মাসে কর্ণফুলী নদীর তলদেশের ভেতর দিয়ে (সাব-মেরিন) এলএনজির রূপান্তরিত গ্যাস সরবরাহের জন্য সঞ্চালন পাইপলাইন স্থাপন সম্পন্ন হয়। এর মধ্যদিয়ে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয় এলএনজির গ্যাস। জাতীয় গ্রিড লাইনের মাধ্যমে এলএনজির রূপান্তরিত গ্যাস সরবরাহের জন্য কক্সবাজারের মহেশখালী থেকে চট্টগ্রামের আনোয়ারা এবং আনোয়ারা-ফৌজদারহাট (সীতাকুন্ড) এই দুই ভাগে মোট ১২১ কিলোমিটার দীর্ঘ দুটি সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে জ্বালানি বিভাগ। এরমধ্যে ৩০ সেন্টিমিটার ব্যাসের ৯১ কি.মি. দীর্ঘ মহেশখালী-আনোয়ারা পাইপলাইন নির্মাণের কাজ গত জুন-জুলাইয়ে শেষ হয়। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রামে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। অপর ৩০ কি.মি. দীর্ঘ ৪২ সেন্টিমিটার ব্যাসের আনোয়ারা-ফৌজদারহাট সঞ্চালন পাইপলাইন স্থাপনের পর এটি জাতীয় গ্রিডলাইনের সঙ্গে যুক্ত হয়। এই পাইপলাইন দিয়ে ঢাকায় গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। সরাসরি গ্যাসের সরবরাহ আসছে কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপের মাতারবাড়ী এলএনজি টার্মিনাল এবং এর সঙ্গে যুক্ত রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট থেকে।
প্রাথমিকভাবে কাতারের রাস-গ্যাস কোম্পানির সাথে পেট্রোবাংলার চুক্তি অনুযায়ী বার্ষিক ২৫ লাখ মেট্রিক টন এলএনজি কাতার থেকে আমদানি করা হচ্ছে। তাছাড়া ওমান থেকে এলএনজি আমদানির লক্ষ্যে ওমান ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল এবং মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের সাথেও এলএনজি আমদানির বিষয়ে জিটুজি চুক্তির উদ্যোগ নেয়া হয়। এলএনজির উৎস থেকে পুরোদমে গ্যাসের জোগান পাওয়া গেলে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ২ হাজার ৫শ’ শিল্প-কারখানায় গ্যাস সংযোগ দেয়া হবে। আনোয়ারা এবং মিরসরাই অর্থনৈতিক জোনে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে কয়েক হাজার শিল্প-কারখানা স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলেছে। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান হবে এলএনজির গ্যাস নির্ভর। শিল্পোদ্যোক্তারা আশা করছেন, চাহিদার সমানতালে গ্যাসের জোগান বৃদ্ধি পেলে বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত বন্দরনগরীসহ চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিনিয়োগ-শিল্পায়নে দীর্ঘদিনের খরা বা বন্ধ্যাত্ব কেটে যাবে। হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের দুয়ার খুলে যাবে। রফতানি প্রবাহ এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয় বৃদ্ধি পাবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।