প্রতিশ্রুত ট্যাঙ্কের মাত্র এক চতুর্থাংশ ইউক্রেনকে দিচ্ছে পশ্চিমারা
ব্রিটেনের সানডে টাইমস রোববার জানিয়েছে, এপ্রিলের শুরুর মধ্যে ইউক্রেন পশ্চিম-প্রতিশ্রুত ট্যাঙ্কগুলোর এক চতুর্থাংশের কম পাবে। এতে
আমাদের চারপাশে কত সমৃদ্ধির ইতিহাস আছে, তার ইয়ত্তা নেই। বাংলার জমিনে মহান রাব্বুল আলামিনের রহমতে প্রকৃতি থেকে অকৃপণভাবে অনেক কিছু দান করেছেন। তার মধ্যে খেজুর গাছ একটি। এই খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে তা থেকে গুড় পাটালি তৈরী হয়। রসনাতৃপ্তির জন্য একসময় বাদামী চিনি তৈরী হতো। যার ওষুধি গুণও আছে। বাদামী চিনির খ্যাতি শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বজুড়ে। এ কারণে এর নাম হয় ব্রাউন সুগার। এই ব্রাউন সুগারের অনেক কাহিনী আছে। যা আজ শুধুই ইতিহাস। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বিশ্বের কোথাও কখনো বাদামী চিনি উৎপাদন সম্ভব হয়নি। শুধুমাত্র বাংলাদেশে উৎপাদন হত একসময়। বাংলার খেজুর গুড়, পাটালি ও বাদামী চিনির দারুণ কদর ছিল সারা বিশ্বেই। খেজুর গুড় শিল্পকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল এক বিশাল বাণিজ্য। নতুর প্রজন্মের কাছে খেজুরের গুড় থেকে ব্রাউন সুগার উৎপাদনের কথা গল্পকাহিনী হয়ে গেছে। সেইসময় আখ নয়, খেজুরের গুড় থেকে ব্রাউন সুগার উৎপাদন করে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে বাংলায়। খেজুরের গাছকে বলা হয় মধুবৃক্ষ। মধুর মতো মিষ্টি রস জ্বালিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় উৎপাদন করা হত বাদামী চিনি।
কালেরগর্ভে হারিয়ে যাওয়া বাংলার ঐতিহ্য ব্রাউন সুগার কারখানা চালু করার এখনো উদ্যোগ নেয়া সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্রাউন সুগার কারখানা চালু না হোক অন্তত যারা খেজুরের রস থেকে গুড় ও পাটালি তৈরী করেন, তাদের মাধ্যমে ক্ষুদ্র পরিসরে ঘরে ঘরে ব্রাউন সুগার উৎপাদনের একটা উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এটি সম্ভব হলে বাংলার বাদামী চিনির ঐতিহ্য ও গৌরব আবার ফিরে আসবে। সৃষ্টি হবে বিশাল মৌসুমী কর্মযজ্ঞ। সমৃদ্ধ হবে গুড় শিল্প। তাতে উম্মোচিত হবে দেশের অর্থনীতির এক নতুন দ্বার।
গ্রামবাংলার ঐতিহ্য আর গৌরবের প্রতীক হচ্ছে খেজুর গাছ। আল্লাহপাকের নিয়ামক খেজুরগাছ থেকে ফোঁটা ফোঁটা রস সংগ্রহ করে পুরো শীত মৌসুমে খেজুরের রসে ভিজানো পিঠা ও পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে গ্রাম জনপদে। একসময় খেজুর রস, গুড় ও পাটালির বিরাট খ্যাতি ছিল। তখন গ্রামে মাঠে সারি সারি ছিল খেজুরের গাছ । এখন একবারেই কমে গেছে। খেজুর গাছ চোখে পড়ে খুব কম। যার জন্য সেই খেজুর গুড় আর নেই। কিছু কিছু এলাকায় পাওয়া যায় ঠিকই কিন্তু পর্যাপ্ত নয়। গুড় ও পাটালিতে ভেজালের কারবারও শুরু হয়েছে। খেজুরের এককাট রসের তৈরী দানা, ঝোলা ও নলেন গুড়ের স্বাদ ও ঘ্রাণই আলাদা। রসনা তৃপ্তিতে এর জুড়ি নেই। গৌরব আর ঐতিহ্য এখনো ফিরিয়ে আনা সম্ভব। দরকার শুধু সরকারী উদ্যোগের। সরকারী পৃষ্টপোষকতা ও উদ্যোগ নেয়া হলে দেশের চাহিদা পুরণ ছাড়াও প্রতিবছর বিদেশে গুড় ও পাটালি রফতান করে কাড়ি কাড়ি টাকা আয় করা সম্ভব বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাদের কথা, এর জন্য বাড়তি খরচ কিংবা আবাদী জমি নষ্ট করার প্রয়োজন পড়বে না। দেশের সড়ক পথ, রেল পথ, জমির আইল, পতিত জমি ও বাড়ীর আঙ্গিনায় কোটি কোটি খেজুর গাছ লাগানো সম্ভব। তাতে সমৃদ্ধ হবে গুড় শিল্প।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, যশোরের কপোতাক্ষ নদপাড়ে প্রথম খেজুরের গুড় থেকে বাদামী চিনি তৈরী করা হয়। খেজুরের গুড় রাখা হতো মাটির ভাড় বা হাড়িতে। এরপর কপোতাক্ষ নদীতে জন্মানো এক ধরনের শৈবাল বা স্থানীয় ভাষায় ‘পাটা শেওলা’ দিয়ে মাটির ভাড় ঢেকে দেয়া হত। সপ্তাহ দুই পরে মাটির ভাড়ের ওই খেজুরের গুড় পরিণত হত বাদামী চিনিতে। যা অত্যন্ত সুস্বাদু। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটানো ছাড়াও বাদামী চিনি রফতানি হত বিদেশেও। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার ব্রাউন সুগার প্রচুর আমদানি করতো। দেশে-বিদেশে ব্রাউন সুগারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে গড়ে ওঠে ব্রাউন সুগার উৎপাদনের বড় একটি কারখানা।
জানা যায়, ১৮৬১ সালে যশোরের চৌগাছার তাহেরপুরে কপোতাক্ষ নদের পাড়ে ইংল্যান্ডের মি. নিউ হাউস কারখানা স্থাপন করে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ব্রাউন সুগার উৎপাদন করে বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হন। তাহেরপুর স্থানটি মি. নিউ হাউসের পছন্দ হবার কারণ ছিল নৌপথে যাতায়াত সুবিধার জন্য। কপোতাক্ষ আর ভৈরবের সংযোগস্থল হওয়ায় উত্তর ও দক্ষিণে সহজে যাতাযাত করা যেত। তখন কপোতাক্ষ নদ ছিল প্রমত্তা। ভৈরবও ছিল নাব্য নদ। তাহেরপুর চিনি কারখানা স্থাপনের পর সেখানে বড় বাজারও বসে। স্থাপিত হয় চিনি কারখানার ইংরেজ কর্মীদের আবাসস্থল। তাহেরপুরে কপোতাক্ষ নদের ঘাটে এসে ভীড় করত দেশী বিদেশী জাহাজ। মূলত একটি বাণিজ্যিক নগর হিসাবে গড়ে ওঠে তাহেরপুর। ১৮৮০ সাল পর্যন্ত মিঃ নিউ হাউসের ব্রাউন সুগার কারখানাটি চলে। পরে তিনি কারখানাটি বিক্রি করে স্বদেশে ফিরে যান। কারখানাটি ক্রয় করে ইংল্যান্ডের ‘এমেট এ্যান্ড চেম্বার্স কোম্পানি’। তারাও নানা কারণে ১৮৮৪ সালে বিক্রি করে দেন বালুচরের জমিদার রায় বাহাদুর ধনপতি সিংহের কাছে। ১৯০৬ সালে তাঁর মৃত্যু হলে তাঁর বংশধররা এটি চালাতে ব্যর্থ হন। এরপর ১৯০৯ সালে কাশিমবাজারের মহারাজ মনীন্দ্রচন্দ্র, নাড়াজোলের রাজ্যবাহাদুর ও কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সারদাচারণ মিত্রসহ কয়েকজন মিলে কারখানাটি ক্রয় করে নাম দেন ‘তাহেরপুর চিনি কারখানা’। নতুন ব্যবস্থাপনায় বৃটেন, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশেষজ্ঞ আনা হয় কারখানাটিতে। ১৯১৫ সালের দিকে এটি বন্ধ ঘোষনা করা হয়। এরপর আর কোনদিন কারখানাটি উৎপাদনের মুখ দেখেনি।
তথ্যানুসন্ধানে আরো জানা যায়, যশোরের খালিশপুর, মহেশপুর, কোটচাঁদপুর, চৌগাছা, গঙ্গানন্দপুর, বোদখানা, ঝিকরগাছা, খাজুরা, রাজারহাট, রূপদিয়া, তালা, বসুন্দিয়া, ফুলতলা, কালীগঞ্জ, নোয়াপাড়া, নাভারণ, ইছাখাদা, কেশবপুর ও ত্রিমোহিনীসহ বিভিন্নস্থানে একরকম ঘরে ঘরে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চিনি কারখানা গড়ে ওঠে প্রাচীন পদ্ধতিতে। এক হিসাবে দেখা যায়, ১৮৭৪ সালে চৌগাছা-কোটচাঁদপুরের কারখানাগুলো থেকেই ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪শ’ ৭৫ মন চিনি পাওয়া যেত। যশোর গেজেটিয়ারের এক তথ্যে জানা যায়, ১৯০১সালের দিকে বাংলাদেশে মোট ২১ লাখ ৮০ হাজার ৫শ’ ৫০ মন চিনি উৎপাদিত হত। এরমধ্যে শুধু যশোরেই উৎপাদিত হত ১৭ লাখ ৯ হাজার ৬০ মন চিনি। বয়োবৃদ্ধদের কথা, নতুন প্রজন্মের কাছে খেজুরের গড় থেকে ব্রাউন সুগার বা বাদামী চিনি উৎপাদনের বিষয়টি অনেকটা কল্পকাহিনীর মতো মনে হয়। তাদের মতে, অতীতে সারাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশী খেজুর গাছ জন্মাত যশোরে।
ব্রাউন সুগার উৎপাদনের কারাখানা তাহেরপুর যশোরের চৌগাছা উপজেলার একটি গ্রাম। চৌগাছা থেকে সোজা উত্তরে ১৬ কিলোমিটার দুরে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর শহর। এরই মাঝামাঝি হাকিমপুর (জাংগালিয়া) বাজার থেকে পশ্চিমে ২ কিলোমিটার গেলেই তাহেরপুর। সেখানে বিদেশী এক ব্যক্তি রিসোর্ট নির্মাণ করছেন। তাহেরপুর এখন তার সমস্ত গৌরব হারিয়ে ফেলেছে। সারি সারি খেজুর গাছের অস্তিত্ব নেই। আছে আম, জাম, কাঠালের নিবিড় বাগান ও হলুদ ক্ষেত। সেখানে ব্রাউন সুগার কারখানার ধ্বংসাবশেষ আছে। মাটিতে পোতা কিছু পাইপ, সান বাঁধানো চাতাল। নিস্তেজ হয়ে আছে কপোতাক্ষ ও ভৈরব নদ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।