পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পানির অপর নাম জীবন, কারণ পানি ছাড়া কোনো প্রাণিই বাঁচতে পারে না। কিন্তু সেই পানি নিরাপদ না হলে তা জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। দূষিত পানি অনেক সময় মৃত্যুর কারণও হতে পারে। বর্ণহীন এই তরল পদার্থটি ছাড়া প্রাণি ও উদ্ভিদের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কাজের জন্যও আমাদের পর্যাপ্ত পানি প্রয়োজন।
প্রাপ্ত বয়স্ক একজন মানুষের দৈনিক ২ থেকে ৩ লিটার পানি পান করতে হয়। শহর এলাকায় কর্মজীবী মানুষেরা বোতলজাত পানি বা জার পানির উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। এই বোতলজাত পানি বা জার পানি প্রতিদিন হোটেল-রেস্তোরাঁ, অফিস, বাসাবাড়ি ও রাস্তার পাশের দোকান থেকে শুরু করে উৎসব-অনুষ্ঠান এবং ভ্রমণপথে খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু এসব বোতলজাত খাবার পানি সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ নয়। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-এর পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায়, ঢাকা শহরের ৪৭ পয়েন্টের পানযোগ্য পানির নমুনার মাইক্রোবায়োলজিক্যাল কোয়ালিটি পরীক্ষা করা হয়। এই গবেষণায় ৪২টি নমুনাতে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি ছিল যার মধ্যে ১২টি নমুনাতে ই-কোলাই’র উপস্থিতি পাওয়া যায়। বিএআরসি’র একটি প্রকল্পের আওতাধীন ‘কোয়লিটিটিভ এসেসমেন্ট অফ বোতল ড্রিংকিং ওয়াটার এন্ড ইভালুয়েশন অফ পেস্টিসাইডস রেসিডিউ এট রো এন্ড কুকড ভেজিটেবল ওয়াসড’ নামক গবেষণা কাজে রাজধানী ঢাকা শহরের ২৪টি এলাকা থেকে ৩৫টি ব্র্যান্ডের বোতলজাত ও ২৫০টি জার পানির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরীক্ষায় প্রায় অধিকাংশ জারের পানি দূষিত প্রমাণিত হয় এবং মাত্র কয়েকটি ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানি নিরাপদ বলে প্রমাণিত হয়। বিএআরসির প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসব বোতলজাত ও জারের পানিতে আছে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া। যেমন: ই-কোলাই। বিএআরসি’র গবেষণায় ১০০ মিলি জার পানির নমুনায় ই-কোলাই এর উপস্থিতি ছিল ১ থেকে ১৬০০ এমপিএনের বেশি। এই ব্যাকটেরিয়া থেকে হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া, মাথাব্যথা, বমিভাব, পেটব্যথা, জ্বর-ঠাÐার মতো রোগ। এছাড়া এটি আস্তে আস্তে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। ঢাকায় নাগরিকদের নিরাপদ পানি সরর্বরাহের দায়িত্ব মূলত ঢাকা ওয়াসার। কিন্তু ওয়াসার সরবরাহকৃত পানিতে দুর্গন্ধ ও ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির অভিযোগ বহুদিনের। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এর পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অপর এক গবেষণায়, ঢাকা ওয়াসার মডস জোন-৪ এর ২০টি পয়েন্টের সরবরাহকৃত পানির নমুনার মাইক্রোবায়োলজিক্যাল কোয়ালিটি পরীক্ষা করা হয়। এই গবেষণায় ১২টি নমুনাতে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি ছিল, যার মধ্যে ৪টি নমুনাতে ই-কোলাই উপস্থিতি পাওয়া যায়। স¤প্রতি বিশ্বব্যাংকের ‘এক্সেস টু ক্লিন ওয়াটার উইল রিডিউস প্রোভাইডস ফাস্টার’ নামক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে পরিশোধিত ও সরবরাহকৃত পানির ৪১ শতাংশেই ই-কোলাই’র মতো ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া যুক্ত। এছাড়াও বলা হয়েছে, পানি ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি উন্নতির ফলে বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ মানুষ পরিষ্কার পানি পাচ্ছে, কিন্তু তা সত্তে¡ও পানির গুণাগুণ খুবই নিম্নমানের এবং সারা দেশের ৮০ শতাংশ পানির পাইপের উৎসেই ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং ডঐঙ (ডড়ৎষফ ঐবধষঃয ঙৎমধহরুধঃরড়হ) এর আদর্শ মানমাত্রা অনুযায়ী পানীয় জলে শূন্য (০) ই-কোলাই এবং শূন্য (০) টোটাল কলিফর্ম থাকতে হবে।
ভূগর্ভস্থ পানি নানাভাবে দূষিত হতে পারে এর মধ্যে অন্যতম একটি হলো, বৃষ্টির পানির সাথে ভূপৃষ্ঠের দূষণ মিশ্রিত হয়ে পরি¯্রবন প্রক্রিয়ায় ভূগর্ভে জমা হওয়া। অপরদিকে ভূপৃষ্ঠস্থ পানি দূষণের কারণ অনেক, এর মধ্যে কয়েকটি হলো, বিভিন্ন কল-কারখানার বর্জ্য পরিশোধন ব্যতীত নিকটস্থ জলাশয় মিশে যাওয়া; বিশেষ করে নদীতে নির্গত করা, গৃহস্থলী ময়লা আবর্জনা পুকুর, খাল-বিল ও অন্যান্য জলাশয়ে নিক্ষেপ এবং পানিতে থালা-বাসন ধোয়া, মানুষ ও গবাদি-পশুর গোসল, পাটের আঁশ ছাড়ানোর সনাতন পদ্ধতির কারণে পানি দূষিত হয়। প্রাকৃতিক কারণে পশু, পাখি ও বিভিন্ন জলজ প্রাণির মৃতদেহ পানিতে মিশে পানি দূষিত হয়। এছাড়াও শহরের ড্রেইনলাইনের ময়লা আবর্জনা মিশ্রিত দূষিত পানি নদীতে মিশে পানি দূষিত হয়। এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-১৬ শীর্ষক এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৪৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশে নদীর পানি সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে আর নদী অববাহিকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অবনতি হয়েছে নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গা অববাহিকার পানি। প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, পানি নিরাপত্তার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ঝুঁকিপূর্ণ। এদেশের মাটির ওপরের ও নিচের দু’ধরনের পানির অবস্থাই খারাপ। বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের প্রবণতা অনেক বেশি। এদেশে প্রতি বছর ৩০ দশমিক ২১ ঘন কিলোমিটার পানি উত্তোলন করা হয় ভূগর্ভ থেকে, যার ৮৬ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষিকাজে, বাকি ১৩ শতাংশ গৃহস্থালি কাজে এবং ১ শতাংশ পানি শিল্পের কাজে ব্যবহৃত হয়। পরিবেশগত ঝুঁকি বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে ভূগর্ভস্থ থেকে ব্যাপক হারে পানি উত্তোলন।
দূষিত পানি ব্যবহারের ফলে ডায়রিয়া রোগ হয় এই তথ্য সবারই জানা। কিন্তু দূষিত পানি থেকে ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগও হতে পারে এমনই তথ্য দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি’। তাদেও প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, দূষিত পানিতে এমন কিছু রাসায়নিক আছে, যা মানুষের প্যানক্রিয়াসের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ফলে ইনসুলিনের স্বাভাবিক নিঃসরণ বন্ধ হয়ে মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। দীর্ঘদিন দূষিত পানি ব্যবহারের কারণে শরীরে টক্সিন (বিষাক্ত পদার্থ) জমা হয়, যা বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। দূষিত পানির ফলে কিডনি রোগ, দীর্ঘমেয়াদী লিভার সমস্যা এবং চক্ষুরোগী বাড়ছে।
পুকুর, কুয়া, খাল ও অন্যান ছোট জলাশয়ে যেখানে বাহ্যিক কোন দূষণ নেই এমন পানিকে ছেঁকে নিয়ে ফিটকিরি দিয়ে পরিষ্কায় করা যায়, এভাবে দ্রবীভূত অবাঞ্চিত উপাদান যেমন- ফাইটোপ্লাংকটন তলানি আকারে জমা হয়। এছাড়া বর্তামানে পানি নিরাপদ করতে একধরনের বড়ি ব্যবহার করা হয়, যা হ্যালোজেন ট্যাবলেট বা হ্যালোট্যাব নামে পরিচিত। বিংশ শতাব্দির এই যুগে পানি বিশুদ্ধকরণের অনেক অত্যাধুনিক পদ্ধতি রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হল আল্ট্রাভায়োলেট রিভার্স ওসমোসিস প্রযুক্তি।
সুস্থ শরীর নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য পানি অন্যতম একটি নিয়ামক। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন এর গবেষণা অনুযায়ী প্রতিদিন মাত্র ৫০০ মিলি লিটার পানি পান করলে দেহের বিপাক প্রক্রিয়া ৩০% বৃদ্ধি পায় এবং ২ লিটার পানি পান করলে ৪০০ কিলোজুল শক্তি উৎপাদন হয়। তাই আমাদের সকলের উচিত পরিমিত পরিমানে পানি পান করা ও নিজেদের কর্মকাÐের মাধ্যমে যেন পানি দূষণ না হয় সেদিকে লক্ষ রাখা।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।