Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ অর্জনে অগ্রগতি

এ এইচ এম মুস্তফা কামাল, এমপি | প্রকাশের সময় : ৯ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে গিয়েছেন। তার হাত ধরেই এদেশের মানুষ স্বাধীনতা লাভ করেছিল। মাটি ও মানুষকে নিয়েই তিনি কাজ করে গিয়েছেন। সংবিধানে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলে গিয়েছেন। তিনি চেয়েছিলেন সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে বৈষম্যহীন একটি অবস্থা। জাত-পাতের কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। উত্তর-দক্ষিণ বা পূর্ব-পশ্চিম কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। নারী-পুরুষে ভেদাভেদ থাকবে না। গ্রাম আর শহরে কোনো পার্থক্য থাকবে না। কাউকে পিছনে ফেলে রাখা যাবে না। এই নীতিতেই প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাটি সাজিয়েছিলেন এদেশের মানুষকে বৈষম্যের শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত করতে এবং দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে। তিনি তার কাজটি শেষ করে যেতে পারেন নাই। ঘাতকদের নির্মম বুলেট তাঁকে থামিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তাঁর আদর্শ বিলীন হয়নি। বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার জননেত্রী শেখ হাসিনা সেই আদর্শ বাস্তবায়নের পথে দেশকে অনেক দূর নিয়ে এসেছেন।

মানব মুক্তির যে দর্শন বঙ্গবন্ধু জাতিক দিয়েছিলেন সেটাই আজকের বৈশ্বিক পরিমন্ডলে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) হিসেবে গৃহীত হয়েছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় অনেক সামাজিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকলেও অনেকগুলো অর্থনৈতিক বিষয় অনুল্লেখিত ছিল। একই সাথে পরিবেশগত বিষয়াদি এবং জলবায়ু পরিবর্তনকে নিয়ে আসা হয়েছে এসডিজিতে। সারাবিশ্বের সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরাও এ বিষয়ে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করছি। এমডিজিতে আমাদের অর্জন ছিল প্রশংসনীয়। আমরা চাই এসডিজি অর্জনেও আমরা অন্যান্য দেশের চেয়ে এগিয়ে থাকবো। আমরা ১৭টি অভীষ্ট লক্ষ্যেই কিছু কিছু অর্জন করছি এবং আমাদের নির্দিষ্ট করা লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছি। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রাগুলোর সর্বশেষ অগ্রগতি নিম্নরূপ:
১. দারিদ্র্য বিলোপ: বিশ্বব্যাংকের মান অনুযায়ী, দিনপ্রতি ১.৯ ডলারের নিচের আয়ের এবং জাতীয় দারিদ্র্যসীমা দ্বারা পরিমাপকৃত চরম দারিদ্র্য হ্রাসে আমাদের অগ্রগতি সঠিক পথেই রয়েছে। অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে সামাজিক সুরক্ষার পরিধি ক্রমেই বাড়ছে এবং মোট সরকারি ব্যয়ের অংশ হিসেবে সেবা খাতসমূহের (স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা) ওপর ব্যয়িত অর্থে অগ্রগতিও সঠিক ধারায় রয়েছে। কার্যত, শিক্ষা খাতে ব্যয় নির্ধারিত লক্ষ্যকে অতিক্রম করে যেতে পারে। ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪.৩% ও চরম দারিদ্র্যের হার ১২.৯% এবং ২০১৮ সালে দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ২১.৮% ও ১১.৩%। অধিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশাকে সামনে রেখে বর্ধমান অসমতা হ্রাসের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসের মাইলফলক অর্জন করা সম্ভবপর হবে।
২. ক্ষুধা মুক্তি: ক্ষুধা মুক্তি অভীষ্ট লক্ষ্যের অন্যতম প্রধান সূচক, কৃষি পরিস্থিতি সূচকে বাংলাদেশ (০.৫), ভারত (০.৪), নেপাল (০.২) এবং শ্রীলংকার তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। পুষ্টির সূচকের ক্ষেত্রে শিশুদের খর্বিত বিকাশ ২০১৬ সালে ৩৮.৫৯% যা কমে ২০১৭ সালে দাঁড়িয়েছে ৩৭.৮২%। কৃষি খাতে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ধানের মোট উৎপাদন ছিল ৩৩.৮০ মিলিয়ন টন, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩৬.২৮ মিলিয়ন টনে উন্নীত হয়। ধান চাষে উৎপাদন ৩.০৪৭ টন/হেক্টর থেকে ৩.১২ টন/হেক্টরে উন্নীত হয়েছে। ২০১৫-১৬ সালে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল ৫৮.১৩% যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৬-১৭ সালে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৫৮.১৯% হয়েছে।
৩. সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ: শিশু ও মায়ের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সূচকসমূহ ২০২০ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সঠিক পথে রয়েছে। ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুহার ২০১৬ সালে প্রতি হাজারে জীবিত জন্মে ৩৫ জন ছিল, যা ২০১৭ সালে কমে ৩১ জন হয়েছে এবং নবজাতক মৃত্যুহার ২০১৬ সালে প্রতি হাজারে ১৯ জন থেকে কমে ২০১৭ সালে ১৭ জনে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে মাতৃ মৃত্যুহার ২০১৬ সালে প্রতি হাজারে ছিল ১৭৮ জন যা ২০১৭ সালে কমে গিয়ে জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যুর হার হয়েছে ১৭২ জন। দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী দ্বারা কৃত প্রসব হার ১৯৯৪ সালে ৯.৫ শতাংশ থেকে ২০১৪ সাল নাগাদ ৪২.১ শতাংশ এবং ২০১৬ সাল নাগাদ ৫০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ফলে ২০২০ সালের মধ্যে তা ৬৫.৭ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সঠিক পথে রয়েছে।
৪. গুনগত শিক্ষা: প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় জেন্ডার সমতা সূচক (জিপিআই) ১ ছাড়িয়ে গেছে এবং গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তা ১ এর উপরে রয়েছে যা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। সরকারের ব্যপক উদ্যোগ গ্রহণের ফলে বিদ্যালয়ে ঝরে পড়ার হার ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে। সামগ্রিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষায় ২০১৬ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৯.২% (ছেলে ২২.৩% এবং মেয়ে ১৬.১%)। উচ্চ মাধ্যমিকে (কলেজ, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি) ২০১৫ সালে মোট ঝরে পড়ার হার ছিল ২২.২৪%।
২০১৫ সালের ন্যায় ২০১৭ এবং ২০১৮ সালেও কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করলেও নারীর অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কম ছিল। ২০১৭ এর হিসাব মতে, শিক্ষা খাতে ২০১৭ সালে বাজেট বরাদ্দ ছিল জিডিপির মাত্র ২.৯৪%। আগামীতে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে একটি শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে। আর সে জন্য শিক্ষা খাতকে অন্যতম অগ্রাধিকারমূলক খাত হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে সরকারি অর্থায়ন ও ব্যয় বাড়াতে হবে এবং এ খাতটিকে আগামী দিনের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপজীব্য করে তুলতে ঢেলে সাজানো হবে।
৫. জেন্ডার সমতা: গত দশকে জেন্ডার বৈষম্য হ্রাসে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে সফল হয়েছে। ২০১৭ সালের সামগ্রিক বৈশ্বিক জেন্ডার গ্যাপ সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ মোট জেন্ডার পার্থক্যকে প্রায় ৭২ শতাংশে নামিয়ে এনে শীর্ষে উঠে এসেছে। জাতীয় সংসদে মহিলা সংসদ সদস্যদের অনুপাত বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ২১ শতাংশ পৌঁছেছে। এছাড়াও, ২০১৭ সালে নারীর গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩.৫ বছর যা পুরুষের (৭০.৬ বছর) চেয়ে বেশি। জেন্ডার ক্ষমতায়নে বর্তমানে বাংলাদেশের বৈশ্বিক র‌্যাংকিং ৪৭তম। অন্যদিকে, ২০১৬-১৭ সালে উৎপাদন কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৩৬.৩% যা ২০৩০ সালে ৫০% উন্নীত করা হবে আগামী দিনে সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ। এর জন্য কারিগরি শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিসহ সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নারী অগ্রাধিকারমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।
৬. নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন: এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে স্বীকৃতির অংশ হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এসডিজি-৬ এর জন্য জাতিসংঘের পানি সম্পর্কিত উচ্চ পর্যায়ের প্যানেলের সদস্য করা হয়েছে। ২০১৭ সালের হিসাব মতে, বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ৯৮% নিরাপদ খাবার পানি পাচ্ছে এবং ৭৬% নিরাপদ স্যানিটেশনের সুবিধা পাচ্ছে। মোট জনসংখ্যার ৯৮% নিরাপদ খাবার পানি পাচ্ছে এবং ৭৬% নিরাপদ স্যানিটেশনের সুবিধা পাচ্ছে। এমডিজি লক্ষ্য অর্জনে দেশের অতীত রেকর্ডের দিকে তাকালে বোঝা যায় ২০৩০ সালের মধ্যে এ দুইটি সূচকে ১০০% লক্ষ্যমাত্রা অর্জন খুবই সম্ভব। তবে আন্তর্জাতিক পানি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত এবং নৌপরিবহন বিষয়ক সূচকগুলোতে সফলতা অর্জনে আগামীতে সরকার আরও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
৭. সাশ্রয়ী, দূষণমুক্ত জ্বালানি: বিশ্বব্যাপী ২০১৫ সালে বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত জনসংখ্যার হার ছিল ৮৭%। এর বিপরীতে ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৮৫.৩% লোক বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত, যা বর্তমানে প্রায় ৯০%। বিশ্বব্যাপী ২০১৫ সালে বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি পেয়ে ৮৭.০৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান অগ্রগতি চলমান থাকলে ২০২০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত জনসংখ্যার হারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনপূর্বক ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে। উন্নত বিশ্বের দেশ হিসেবে আবির্ভূত হওয়াকে সামনে রেখে ২০৪১ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ সেক্টর ব্যবস্থাপনার জন্য ইলেকট্রিসিটি মাস্টার প্ল্যান ২০১৬ প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে, জ্বালানি সক্ষমতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলেও বাংলাদেশ নির্মল জ্বালানি ও প্রযুক্তির ওপর প্রাথমিক নির্ভরতা এবং মোট চূড়ান্ত শক্তি ব্যবহারে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশ সম্পর্কিত অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রায় পিছিয়ে রয়েছে।
৮. শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: বিগত তিন বছরে (২০১৪-১৫ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে) বাংলাদেশের গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ শতাংশেরও বেশি। জিডিপির এই অভূতপূর্ব অর্জনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে নিম্নগতি। ফলে, মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারে প্রদর্শিত হচ্ছে ঊর্ধ্বমুখী ধারা এবং ২০২০ সালের সংশ্লিষ্ট লক্ষ্য অর্জন এখন প্রায় অবশ্যম্ভাবী। কর্মে নিযুক্ত মাথাপিছু প্রকৃত জিডিপির গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ২০১৫ সালের ৪.৪৯ শতাংশ থেকে ২০১৬ সালে ৪.৯৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অত্যন্ত খুশির বিষয় হলো এ সূচকে ২০২০ সালের লক্ষ্যমাত্রা ২০১৭ সালেই অর্জিত হয়েছে। সা¤প্রতিক সময় সার্বিক বেকারত্ব হারের পরিস্থিতির উন্নতিও লক্ষণীয়। ২০১০ সালের ৪.৬ শতাংশ থেকে ২০১৭ সালে এ হার ৪.২ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রবাসী কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অর্জিত হয়েছে লক্ষণীয় অগ্রগতি। ২০১৫ অর্থবছরে প্রবাসে গমনকারী বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা ছিল ৪ লক্ষ ৬১ হাজার; পরবর্তী দুই অর্থবছরে আরও প্রায় ১৫ লক্ষ ৯০ হাজার কর্মী বিদেশে গমন করেন। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রবাসে ২০ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রথম দুই বছরেই এ লক্ষ্যমাত্রার ৮০ ভাগ অর্জিত হয়েছে। প্রবাসী কর্মসংস্থানের ঊর্ধ্বমুখী গতিধারা প্রবাসী আয়ের পরিমাণও ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করেছে, যা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতির সঞ্চার করছে।
৯. শিল্প, উদ্ভাবন এবং অবকাঠামো: জিডিপিতে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদান ক্রমবর্ধমান ধারা প্রদর্শন করছে এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৮.৯৯% অর্জন করেছে। দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার সাথে সাথে ২০২০ সালের মাইলফলক (২১.৫%) সহজেই অতিক্রম করতে পারবে বাংলাদেশ। কিছু বার্ষিক উঠানামাসহ অবকাঠামো খাতে আন্তর্জাতিক ঋণ সহায়তার মোট পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সা¤প্রতিক প্রবৃদ্ধির ধারা অক্ষুণ্ন থাকলে ২০২০ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে বলে প্রতীয়মান হয়। মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত জনসংখ্যার অনুপাত দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রায় শতভাগে পৌঁছেছে। তৃতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ২০১৭ সালেই অর্জিত হয়েছে ২০২০ সালের লক্ষ্যমাত্রা (৯২.৫৫%)।
১০. অসমতা হ্রাস: বর্তমান সরকার শুরু থেকেই একটি দরিদ্র-বান্ধব উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করেছে, যার মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি দারিদ্র্য ও অসমতার হ্রাস। অনগ্রসর অঞ্চলের উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধি ও এর কার্যকারিতা বাড়ানো, ক্ষুদ্রঋণের প্রসার ও ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্পের জন্য ঋণের যোগান, কৃষি ও পল্লী উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব প্রদান, আয়-অনুপাতিক ব্যক্তি আয়কর ব্যবস্থার ওপর জোর দিয়ে কর ব্যবস্থার সংস্কার প্রভৃতি ও অসমতা হ্রাসের লক্ষ্যে সরকারের গৃহীত নীতিমালার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
১১. টেকসই নগর ও জনপদ: উপজেলা কেন্দ্রসমূহকে (৪৯৩টি) ছোট ছোট শহরে পরিণত করার লক্ষ্যে সরকার সেখানে নাগরিক সেবা সরবরাহ বৃদ্ধি করছে। গ্রামীণ প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রগুলোকে আবাসনকেন্দ্রে পরিণত করার লক্ষ্যে চলছে উন্নয়ন কার্যক্রম। অন্যদিকে বড় শহরগুলোতে বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামের জন্য পরিবহন, রাস্তা-ঘাট উন্নয়ন, পয়ঃনিষ্কাশন, ভূ-উপরিস্থিত পানি সরবরাহ ইত্যাদি নানা খাতে অনেকগুলো বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে সকল প্রকার নাগরিক সুবিধা আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সরকার নিশ্চিত করতে পারবে।
১২. পরিমিত ভোগ ও টেকসই উৎপাদন: ১৯৭০ সাল থেকে বৈশ্বিক ভোগ ব্যয় গড়ে প্রতিবছর ৩ শতাংশ করে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে লক্ষ লক্ষ মানুষ ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় ভোগের সংস্থান করতে পারছে না। তাই ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডা বাস্তবায়নের মূলে রয়েছে পরিমিত ভোগ ও টেকসই উৎপাদন। ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক সম্মেলনে ‘টেকসই উৎপাদন ও ভোগ বিষয়ক কর্মসূচির ১০ বছর মেয়াদি কাঠামো’ গৃহীত হয়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের জন্য এ সংক্রান্ত একটি জাতীয় কাঠামোর খসড়া পরিকল্পনা কমিশন প্রণয়ন করেছে।
১৩. জলবায়ু কার্যক্রম: দুর্যোগের কারণে মৃত, নিখোঁজ ও সরাসরি দুর্যোগ আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রতি ১,০০,০০০ জনে গত কয়েক বছর ধরে কমে গিয়েছে। এখন এটি দাঁড়িয়েছে ১২,৮৮৮ জনে, ২০২০ সালের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৬,৫০০ জনে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ১,৫০০ জনে নামিয়ে আনা। জলবায়ু পরিবর্তনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালীন সময়ে ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকায় সরকার ১৬.৪ কি. মি. উপকূলবর্তী বেড়িবাঁধ ও ৭,২১৮টি ঘূর্ণিঝড় সহনশীল বাড়ি নির্মাণ করেছে। নদী ভাঙন প্রবণ এলাকায় মানুষের নিরাপত্তার জন্য সরকার ৩৫২.১২ কি.মি. বাঁধ এবং ১৫৭ কি.মি. সুরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করেছে। এছাড়াও, কৃষি ও সেচ ব্যবস্থাপনার জন্য ৮৭২ কি.মি. খাল খনন/পুনঃখনন করা হয়েছে এবং ৬৫টি পানি সংরক্ষণ অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে।
১৪. জলজ জীবন: বাংলাদেশ সম্প্রতি বিশাল জলসীমা অর্জন করেছে। এই জলসীমা প্রাকৃতিক গ্যাস, অন্যান্য খনিজ সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। এই সম্পদগুলোর টেকসই ব্যবস্থাপনাই এখন দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সম্প্রতি সরকার সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে দু’টি সমুদ্র অঞ্চলকে ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে একটি ইলিশ প্রজনন ক্ষেত্র এবং অন্যটি তিমি মাছ সংরক্ষণশালা। মোট ১,১৮,৮১৩ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে সংরক্ষিত অঞ্চল হলো ২.০৫ ভাগ। বিগত ১০ বছরের অর্জিত গুরুত্বপূর্ণ সাফল্যের মধ্যে ইলিশ সংরক্ষণ ও উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হওয়া অন্যতম।
১৫. স্থলজ জীবন: বর্তমানে দেশে বনভূমির পরিমাণ ১৭.৫০ ভাগ, যা ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০২০ সাল নাগাদ ২০ ভাগে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বনভূমির গুণগতমানের উন্নয়ন বর্তমানে প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করার জন্য বাংলাদেশ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো গাছ কাটার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (ইসিএ) ঘোষণা, বিশেষ জীব বৈচিত্র্য অঞ্চল স্থাপন এবং দু’টি শকুন সংরক্ষণ অঞ্চল স্থাপন।
১৬. শান্তি, ন্যায়বিচার ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান: উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে হত্যাকান্ডের শিকার ব্যক্তিদের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গিয়েছে (প্রতি ১,০০,০০০ জনে ১.৮ জন)। বাংলাদেশ সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে মানব পাচার এবং তরুণদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন কমে এসেছে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও উন্নয়ন সাধনের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগ হতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
১৭. অভীষ্ট অর্জনে অংশীদারিত্ব: বৈদেশিক উৎস যেমন বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) ও উন্নয়ন সহায়তা (ওডিএ) বাংলাদেশের বাজেট বাস্তবায়নে প্রায় ১৫ শতাংশ অর্থায়ন করে। ২০১৬ সালে প্রকৃত উন্নয়ন সহায়তা ছিল ৩.৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১৬.৭ শতাংশ বেশি। উল্লেখ্য, বর্তমানে উন্নয়ন সহায়তার তুলনায় জাতীয় বাজেটের আকার বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৮ সালে উন্নয়ন সহায়তা বেড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। বর্তমান বছরগুলোতে অন্যান্য সূচকের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগের সুযোগ-সুবিধা যথেষ্ট উন্নত হয়েছে। অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ, অপটিক্যাল ফাইবারের ক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে অবদান রাখছে। যদিও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে অন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সমর্থন খুবই জরুরি। ১৬৯টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ৪১টির জন্য সরকারি উন্নয়ন সহায়তা (ওডিআই)-সহ আন্তর্জাতিক সহায়তা বৃদ্ধি ও সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ব্যতীত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের মতো একটি সমন্বিত ও বহুমুখী উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন কঠিন হবে।
লেখক: মন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: উন্নয়ন

২৩ ডিসেম্বর, ২০২২
১৮ ডিসেম্বর, ২০২২
২৮ অক্টোবর, ২০২২
২ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন